ইভারমেকটিনঃ ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে বিপ্লব আনছে এই একটি ট্যাবলেট

উত্তরাপথঃ একটি সাধারণ ট্যাবলেট এখন ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নতুন আশা জাগাচ্ছে। এই ট্যাবলেট খেলেই মানুষ হয়ে উঠছে মশার জন্য ‘মারণাস্ত্র’—কারণ রক্ত চুষতেই মারা যাচ্ছে মশা!

সম্প্রতি কেনিয়া ও মোজাম্বিকে পরিচালিত একটি বিশাল গবেষণায় দেখা গেছে, ইভারমেকটিন নামের একটি অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক ওষুধ ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ ২৬% পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে। এক মাসে একবার ওষুধ খেলেই কাজ হচ্ছে, এবং বাড়তি বোনাস হিসেবে কমেছে উকুন ও চুলকানির সমস্যাও কমে যায় ,অর্থাৎ—এক ঢিলে অনেক পাখি!

আইভারমেকটিন একটি নিরাপদ এবং সহজলভ্য ওষুধ। গবেষণায় দেখা গেছে পুরো গ্রাম এটি  ব্যবহার করলে ম্যালেরিয়া ছড়ানো ২৬% কমে যায়। BOHEMIA Project-এর অধীনে (Broad One Health Endectocide-based Malaria Intervention in Africa) গবেষণাটি করা হয়েছিল । কেনিয়ার কোয়ালে কাউন্টি-তে (৫–১৫ বছর বয়সী শিশুদের নিয়ে)এবং মোজাম্বিকের মোপিয়া জেলায় (৫ বছরের নিচে শিশুদের নিয়ে)। সেখানে তিন মাস ধরে প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট ডোজে (৪০০ মাইক্রোগ্রাম/কেজি) ইভারমেকটিন খাওয়ানো হয় বর্ষাকালের শুরুতে, যেটা ম্যালেরিয়ার প্রধান মৌসুম।

কেনিয়ার কোয়ালে কাউন্টিতে দেখা গেছে, যারা ইভারমেকটিন নিয়েছে, তাদের মধ্যে ম্যালেরিয়ার হার ২৬% কমেছে। ২০,০০০-এর বেশি শিশুকে নিয়ে ৫৬,০০০ বার ডোজ দেওয়া হয়েছে, এবং কোথাও বড় কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।বোহেমিয়া ট্রায়াল নামের এই গবেষণাটি দেখিয়েছে যে এই ওষুধ ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে অতিরিক্ত সুরক্ষা দিতে পারে। গবেষণাটি পরিচালনা করেছে বার্সেলোনা ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল হেলথ (আইএসগ্লোবাল), সঙ্গে ছিল লা কাইক্সা ফাউন্ডেশন, মানহিসা হেলথ রিসার্চ সেন্টার এবং কেমরি-ওয়েলকাম ট্রাস্ট। ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ(The New England Journal of Medicine )।

২০২৩ সালে বিশ্বে ম্যালেরিয়ায় ২৬৩ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল এবং ৫৯৭,০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল। মশারী বা স্প্রে এখন আর আগের মতো কার্যকর নয়, কারণ মশারা এগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে গেছে। এমনকি মশারা এখন বাইরে বা দিনের বেলায় কামড়ায়, যখন মানুষ মশারীর নিচে থাকে না। তাই নতুন কিছুর দরকার ছিল, আর আইভারমেকটিন সেই সমাধান হতে পারে।

আইভারমেকটিন সাধারণত  রিভার ব্লাইন্ডনেস  বা ফাইলেরিয়ার মতো রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এটি কিন্তু মশাকেও মেরে ফেলতে পারে যদি তারা এই ওষুধ খাওয়া মানুষকে কামড়ায়। মশারা যেহেতু কীটনাশকের বিরুদ্ধে শক্তিশালী হয়ে উঠছে, তাই এই ওষুধ ম্যালেরিয়া কমাতে নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে। এটি নতুন কোনো ওষুধ নয়, বহু বছর ধরে নিরাপদভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।এই গবেষণার ফলাফল The New England Journal of Medicine-এ প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র ভেক্টর কন্ট্রোল উপদেষ্টা দল গবেষণার ফলাফল পর্যালোচনা করে ভবিষ্যতে আরও গবেষণার সুপারিশ করেছে।

ISGlobal-এর ম্যালেরিয়া নির্মূল উদ্যোগের পরিচালক রেজিনা রাবিনোভিচ বলেছেন, “এই গবেষণার ফলাফল ভবিষ্যতের ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। একটিমাত্র নিরাপদ ওষুধ দিয়ে আমরা একটি নতুন প্রতিরোধ কৌশলের দিকে এগোতে পারি।”

পরিশেষেইভারমেকটিন কোনো জাদু নয়—কিন্তু একে বিজ্ঞান ও সচেতনতার সঙ্গে ব্যবহার করলে এটি হতে পারে ম্যালেরিয়া নির্মূলের শক্তিশালী হাতিয়ার। এক মাসে একটি ট্যাবলেট খেলেই যদি একটি শিশুর প্রাণ বাঁচে, তবে সেটি ভাবার মতোই বড় ব্যাপার।

সূত্র : “Ivermectin to Control Malaria — A Cluster-Randomized Trial” by Carlos Chaccour, Marta Maia, Mercy Kariuki, Paula Ruiz-Castillo, Caroline Wanjiku, Lydia Kasiwa, Aurelia Brazeal, Aina Casellas, Mwanajuma Ngama, Truphena Onyango, Eldo Elobolobo, Karisa Kazungu, Mary Mael, Winnie Wangari, Khadija Nuru, Rachel Otuko, Almudena Sanz, Isaac Ringera, Allan Matano, Starford Mitora, Marta Ribes, Joe Brew, Nika Gorski, Patricia Nicolas, Sara Stanulovic, Isaiah Omondi, Joanna Furnival-Adams, Laura Túnez, Jamal Mbarak, Vegovito Vegove, Esther Yaa, Shadrack Mramba, Yegon Kibet, Naomi Nyambura, Charles Rotich, Scholastica Wanjiru, Musa Vura, Faith Wanjiku, Leslie Sam, Lisa Collins, Kang Xia, Felix Hammann, Francisco Saúte, Matthew Rudd, Cassidy Rist, Caroline Jones, Joseph Mwangangi and N. Regina Rabinovich, 23 July 2025, New England Journal of Medicine.
DOI: 10.1056/NEJMoa2411262

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


সম্পাদকীয়-  রাজনৈতিক সহিংসতা ও আমাদের গণতন্ত্র

সেই দিনগুলো চলে গেছে যখন নেতারা তাদের প্রতিপক্ষকেও সম্মান করতেন। শাসক দলের নেতারা তাদের বিরোধী দলের নেতাদের কথা ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন।  আজ রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে।  কেউ কারো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়।  আগ্রাসন যেন রাজনীতির অঙ্গ হয়ে গেছে।  রাজনৈতিক কর্মীরা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খুন বা মানুষ মারার মত অবস্থার দিকে ঝুঁকছে। আমাদের দেশে যেন রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না।আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে বেশি মানুষ নিহত হচ্ছেন।  ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) অনুসারে, ২০১৪ সালে, রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৪০০ জন প্রাণ হারিয়েছিল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২০০০ জন মারা গিয়েছিল।  আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য গর্বিত হতে পারি, কিন্তু এটা সত্য যে আমাদের সিস্টেমে অনেক মৌলিক সমস্যা রয়েছে যা আমাদের গণতন্ত্রের শিকড়কে গ্রাস করছে, যার জন্য সময়মতো সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। .....বিস্তারিত পড়ুন

সেলফির উচ্চ রেটিং কি আপনাকে আরওপাতলা হতে উৎসাহিত করছে ?

উত্তরাপথঃ সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে সেলফি তোলা এবং নিজেকে পাতলা হিসাবে দেখানোর মধ্যে একটি সম্পর্ক থাকতে পারে। যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক সেন্ট জন ইউনিভার্সিটির রুথ নাইট এবং ইউনিভার্সিটি অফ ইয়র্কের ক্যাথরিন প্রেস্টন সম্প্রতি PLOS ONE জার্নালে তাদের ফলাফল প্রকাশ করেছেন।সেখানে সেলফির উচ্চ রেটিং এবং আমাদের শরীরের গঠনের মধ্যে যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।    বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ায় সেলফি হল এক জনপ্রিয় ছবি দেওয়ার ধরন। যিনি সেলফি তোলেন তিনি ক্যামেরাকে তাদের শরীর থেকে দূরে রেখে নিজেই নিজের ছবি তোলে। আগের গবেষণায় বলা হয়েছে সেলফিগুলি দেখার ফলে ছবির বিষয়গুলি সম্পর্কে দর্শকদের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Roop Kishor Soni: একটি আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য তুলে ধরেছেন

উত্তরাপথঃ রাজস্থান মানেই ওজনদার রূপার গহনা ,আর তার উপর কারুকাজ। প্রচলিত এই ধারনা ভেঙ্গে আজ রূপোর গহনাকে আধুনিকতার সাথে শিল্পের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন যে ব্যক্তি তিনি হলেন রূপ কিশোরী সোনী(Roop Kishor Soni)।তিনি ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে তার অসাধারণ শিল্প কর্মের জন্য জাতীয় পুরুস্কার পান। রাজস্থানের জয়সলমেরের শহরের এই শিল্পী ৩.৮ গ্রাম ওজনের ০.৯ সেমি চওড়া রৌপ্য আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য খোদাই করেছেন।এই ছোট রূপার আংটিতে শিল্পী তাজমহল, সিডনি অপেরা হাউস, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, চীনের গ্রেট ওয়াল, আইফেল টাওয়ার, বিগ বেন, পিসার হেলানো টাওয়ার এবং মিশরীয় পিরামিডের চিত্র এক সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন।এছাড়াও তিনি আরও দুটি পৃথক ডিজাইনের অত্যাশ্চর্য আংটি  তৈরি করেছেন।৮.৬ গ্রাম ওজনের একটি রিংয়ে তিনি সূর্যাস্তের সময় ভারতীয় উট সাফারি সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভারতীয় বিশেষত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন,এবং অন্যটিতে বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবী ছবি এবং মন্দির খোদাই করেছিলেন। শিল্পী বলেছেন যে তিনি তার বাবার কাছ থেকে তার শৈল্পিক দক্ষতা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সেই সাথে তিনি বলেন "আমার বাবাও একজন জাতীয় পুরুস্কার প্রাপ্ত শিল্পী ছিলেন। তিনি আমাকে শিল্পের এই দক্ষতা শিখিয়েছিলেন কারণ তিনি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে শিল্পের ফর্মটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।" .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে

উত্তরাপথঃ হঠাৎ করেই একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে।২০২৩ এর ৩০ অক্টোবর  প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি মৃত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত একটি নতুন দ্বীপের জন্ম দিয়েছে। বিস্ফোরণের পর জাপানের ওগাসাওয়ারা দ্বীপ চেইনের কাছে বিশাল বিশাল পাথরের টুকরো দেখা গেছে। এ বিষয়ে জাপানি গবেষক বলেন, গত মাসে প্রশান্ত মহাসাগর জলের নিচে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের পর টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে ইওটো দ্বীপের কাছে একটি ছোট নতুন দ্বীপের উদ্ভব হয়েছে।টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ফুকাশি মায়েনো জানিয়েছেন যে নতুন দ্বীপ, এখনও যার নাম নেই প্রশান্ত মহাসাগরের ইওটো দ্বীপ থেকে ১ কিলোমিটার দূরে ১০০ মিটার ব্যাসের একটি পাথুরে দ্বীপে একটি phreatomagmatic বিস্ফোরণ ঘটেছে। টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে বিস্ফোরণটি দেখা গেছে। ভূপৃষ্ঠের নীচে জলের সাথে লাল গরম ম্যাগমা সংঘর্ষের কারণে প্রতি কয়েক মিনিটে বিস্ফোরণ ঘটে।গত ২১ অক্টোবর, ২০২৩-এ অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছিল, যা আগে ইও জিমা নামে পরিচিত ছিল এবং এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্থান ছিল। প্রায় ১০ দিন ধরে অগ্ন্যুৎপাত চলার পর, আগ্নেয়গিরির উপাদান অগভীর সমুদ্রতলের উপর জমা হয় এবং প্রায় ১৬০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় বড় বড় পাথরের আকারে সমুদ্র পৃষ্ঠের উপরে উঠে আসে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top