চাঁদে কলোনি, ২৯ কোটি ক্ষুধার্ত ৫৩টি দেশ খাদ্য সংকটে: এটাই কি উন্নয়ন?

উত্তরাপথঃ বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) সাম্প্রতিক ‘গ্লোবাল ফুড ক্রাইসিস’ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে যে উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে, তা মানব সভ্যতার বিবেককে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো। ২০২৪ সালে টানা ষষ্ঠ বছর বিশ্ব জুড়ে গভীর খাদ্য সংকট চলছে এবং শিশুদের অপুষ্টি আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। অথচ এই সময়েই আমরা গর্বের সঙ্গে প্রযুক্তির উন্নয়ন, অবকাঠামোর প্রসার এবং মহাকাশে কলোনি গড়ার দাবি করছি। প্রশ্ন উঠছে—এটাই কি সত্যিকারের উন্নয়নের মানদণ্ড?

আজ আমরা এমন এক যুগে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে একদিকে স্পেস স্টেশন, রোবোটিক চাঁদযান ও AI-এর বিস্ময়কর উন্নয়নের গল্প শুনি, অন্যদিকে প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষ না খেয়ে রাত কাটান। বিশ্ব যখন ‘উন্নয়ন’ শব্দের মহিমা প্রচারে ব্যস্ত, তখন মানবিক বিপর্যয়গুলোর দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখাও হয় না।

সম্প্রতি খবরে প্রকাশ, ২০২৪ সালে বিশ্বের ৫৩টি দেশ বা অঞ্চলে প্রায় ২৯.কোটি মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছেন। ২০২৩ সালের তুলনায় এই সংখ্যা বেড়েছে ১.৩৭ কোটি। অর্থাৎ, পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি, বরং সংকট আরও গভীর হয়েছে।

বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এই দুরবস্থার মূল কারণ। এসব কারণে ২০টি দেশে প্রায় ১৪ কোটি মানুষ চরম ক্ষুধার্ত অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছেন। এসব অঞ্চলে মানবিক সহায়তা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে, খাদ্য সরবরাহও বাধাপ্রাস্ত হচ্ছে। এটি শুধু একটি ব্যর্থ রাজনৈতিক অবস্থানের দৃষ্টান্ত নয়, এটি মানবিক মূল্যবোধেরও মৃত্যু।

খাদ্য সংকটের আরেক বড় কারণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ধস, যেখানে মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের কারণে ১৫টি দেশে প্রায় ৫.৯৪ কোটি মানুষ প্রায় অভুক্ত থাকতে বাধ্য হচ্ছে। পাশাপাশি, খরা ও বন্যা ১৮টি দেশে ৯.কোটি মানুষকে খাদ্য সংকটে ফেলেছে।

এরচেয়েও ভয়াবহ হলো, এই সংকটে আন্তর্জাতিক সাহায্যের হারও নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। খাদ্য ও পুষ্টি সহায়তার জন্য যেসব তহবিল বরাদ্দ করা হতো, তা এখন থমকে গেছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার আগ্রহ কমছে, অন্যদিকে প্রচলিত বড় দেশগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছাও প্রশ্নের মুখে।আজ ২১শ শতকে দাঁড়িয়ে ক্ষুধার ছবি—এ একটি সভ্যতার পরাজয়। যদি এই উন্নয়ন মানুষকে খেতে না দিতে পারে, যদি এই প্রযুক্তি শিশুদের অপুষ্টি কমাতে না পারে, তাহলে এই উন্নয়নের অর্থ কী? উন্নয়নের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সর্বজনীন কল্যাণ, শুধুমাত্র প্রযুক্তি বা অর্থনৈতিক ‘শ্রী’বৃদ্ধি নয়।

এমন পরিস্থিতিতে, বিশ্বের প্রতিটি দেশের সরকারের উচিত তাদের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পুনর্মূল্যায়ন করা এবং সঙ্কটাপন্ন এলাকাগুলিতে  খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা সুসংগঠিত করা ও ত্রান সরবরাহ খাতে  বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা।

একটি সভ্যতার বিকাশের মাপকাঠি হওয়া উচিত তার সবচেয়ে দুর্বল জনগোষ্ঠীর কল্যাণে সে কতটা সচেষ্ট তাঁর উপর ভিত্তি করে । যতদিন না পর্যন্ত একজন শিশু খালি পেটে ঘুমায়, একজন মা সন্তানকে দুধ খাওয়াতে না পারে, ততদিন পর্যন্ত আমাদের উন্নয়ন শুধু ‘চাঁদে কলোনি গড়ার’ অলীক স্বপ্নেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

আমরা প্রযুক্তির চূড়ায় উঠতে পারি, কিন্তু যদি আমাদের পায়ের নিচে থাকা মাটি শুকিয়ে যায়, তবে সে উন্নয়ন মানুষের জন্য নয়, শুধুই যন্ত্রের জন্য বা কতিপয় শ্রেনীর জন্য। এখনই সময়, বৈশ্বিক উন্নয়নের সংজ্ঞাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার—যেখানে মানুষ, মানবতা, খাদ্য ও স্বাস্থ্যই হবে অগ্রাধিকার।২১শ শতকের উন্নয়ন যদি কোটি কোটি মানুষের ক্ষুধার কান্না থামাতে না পারে, তাহলে তা শুধুই একটি নির্মম রূপকথা। উন্নয়ন তখনই পূর্ণতা পাবে, যখন প্রতিটি মানুষ দু’বেলা খাবার পাবে—চাঁদে নয়, পৃথিবীর বুকে।

তথ্যসূত্র: FAO Global Report on Food Crises 2024, UN WFP, UNICEF

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


NASA Carbon Emission: পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে

উত্তরাপথঃ কার্বন নির্গমন (NASA Carbon Emission) সম্পর্কে নাসার সর্বশেষ আবিষ্কার পৃথিবীর জন্য এক সতর্কতা সংকেত। মহাকাশ সংস্থার মতে, পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে, যার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। NASA এর এই আবিষ্কারটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, সেইসাথে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেছে।নাসার সর্বশেষ গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে পৃথিবীর মহাসাগর এবং ভূমি-ভিত্তিক বাস্তুতন্ত্র আগের চেয়ে কম কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে গত এক দশকে ভূমি এবং মহাসাগর দ্বারা শোষিত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৫% হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক

উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই  সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন

Roop Kishor Soni: একটি আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য তুলে ধরেছেন

উত্তরাপথঃ রাজস্থান মানেই ওজনদার রূপার গহনা ,আর তার উপর কারুকাজ। প্রচলিত এই ধারনা ভেঙ্গে আজ রূপোর গহনাকে আধুনিকতার সাথে শিল্পের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন যে ব্যক্তি তিনি হলেন রূপ কিশোরী সোনী(Roop Kishor Soni)।তিনি ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে তার অসাধারণ শিল্প কর্মের জন্য জাতীয় পুরুস্কার পান। রাজস্থানের জয়সলমেরের শহরের এই শিল্পী ৩.৮ গ্রাম ওজনের ০.৯ সেমি চওড়া রৌপ্য আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য খোদাই করেছেন।এই ছোট রূপার আংটিতে শিল্পী তাজমহল, সিডনি অপেরা হাউস, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, চীনের গ্রেট ওয়াল, আইফেল টাওয়ার, বিগ বেন, পিসার হেলানো টাওয়ার এবং মিশরীয় পিরামিডের চিত্র এক সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন।এছাড়াও তিনি আরও দুটি পৃথক ডিজাইনের অত্যাশ্চর্য আংটি  তৈরি করেছেন।৮.৬ গ্রাম ওজনের একটি রিংয়ে তিনি সূর্যাস্তের সময় ভারতীয় উট সাফারি সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভারতীয় বিশেষত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন,এবং অন্যটিতে বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবী ছবি এবং মন্দির খোদাই করেছিলেন। শিল্পী বলেছেন যে তিনি তার বাবার কাছ থেকে তার শৈল্পিক দক্ষতা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সেই সাথে তিনি বলেন "আমার বাবাও একজন জাতীয় পুরুস্কার প্রাপ্ত শিল্পী ছিলেন। তিনি আমাকে শিল্পের এই দক্ষতা শিখিয়েছিলেন কারণ তিনি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে শিল্পের ফর্মটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।" .....বিস্তারিত পড়ুন

সহযাত্রী

দীপা - আর তো এগারো বছর আটমাস বারোদিন চাকরি , তাই না ? অংশু - বাপরে বরাবরই তোমার স্মৃতিশক্তি প্রবল , এতোটা মনে আছে ? দীপা- ঘোরো টো টো করে আর কটা বছর , আফটার রিটায়ার্ড মেন্ট কি করবে ? অংশু - ফার্ম হাউস ,গাছপালা পশুপাখি নিয়ে থাকবো। দীপা- বাঃ উন্নতি হয়েছে। যে অংশুবাবু কখনও একটা ফুলের চারা লাগায়নি সে কিনা ফার্ম হাউস করবে … অংশু - সময়ের সাথে সব বদলায় ম্যাডাম , আচ্ছা তোমার কনুইয়ের নীচে সেই পোড়া দাগটা দেখি তো গেছে কিনা … দীপা- তুমি অনেক রোগা হয়ে গেছো , তা ওজন কত শুনি ? অংশু - সত্তর বাহাত্তর হবে বোধহয় মাপিনি, দীপা - তা কেনো মাপবে ? একটা অগোছালো মানুষ। অংশু - যাক বাবা তাও অপদার্থ শব্দ টা বলোনি। দীপা - ভাবোনা ডিভোর্স হয়েছে বলে সে অধিকার নেই। সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়েও আসলে সমাজটাই শেখোনি , আর কি শিখেছো বলো, ঐ ছেলে পড়ানো , সেমিনার আর লেখালেখি। তা ধন্যবাদ তোমার রূপালী ঠৌট উপন্যাস এবছর একাডেমি পেলো , দারুণ লেখো তুমি, আগের চেয়ে অনেক ধার। অংশু- বাঃ তুমি পড়েছো ? দীপা- সব পড়েছি , তোমার রিসেন্ট উপন্যাসের নায়িকা মেঘনা টি কে ? মানে কার আড়ালে কাকে লিখেছো ? অংশু - এও কি বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপিকাকে বলে দিতে হবে ? দীপা- বারোটা বছর সময়ের শাসনে অনেক বদলালেও আমি বোধহয় সেই বড্ড সেকেলেই রয়ে গেলাম। অংশু - একা একাই কাটিয়ে দিলে বারো বছর। দীপা- একই প্রশ্ন আমিও করতে পারি। অংশু - আচ্ছা দীপা আজ না হয় শেষবারের মতো বলি, আমার মধ্যে কি ছিলো না বলোতো ? কেনো পারোনি এই বাউন্ডুলে ভবঘুরে মানুষটার সাথে চিরকালের ঘর বাঁধতে ? আমি কি ভালোবাসতে জানি না ? .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top