দেবী দুর্গা নয়,এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই সময় তাদের আরাধ্য অসুরের পূজা করে

উত্তরাপথঃ প্রতি বছর মহালয়া থেকে শুরু করে টানা নয় দিন সারা রাজ্য মন্দের উপর ভালোর জয় উদযাপনের আনন্দে ব্যস্ত থাকে। তারা দেবী ও তার সন্তানদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন নিয়ে একদিকে যখন আড়ম্বরপূর্ণ উদযাপনে ব্যস্ত  ঠিক সেইসময় উপজাতীয় সম্প্রদায় যারা নিজেদেরকে অসুর বা মুলনিবাসি বলে পরিচয় দেয় তারা ব্যস্ত তাদের আরাধ্য মহিষাসুরের পূজা করতে । উপজাতির মানুষেরা নির্দয়ভাবে তাদের রাজা মহিষাসুরের মৃত্যুতে শোক পালন করতে নিজেদের ঘরের ভিতর তালাবদ্ধ করে রাখে উৎসবের কয়দিন।তাদের কাছে দেবী দুর্গা উচ্চ বর্ণের প্রতিনিধি, তিনি তাদের রাজা মহিষাসুরকে প্রতারিত করে হত্যা করেছিলেন।আদিবাসীরা মনে করেন দুর্গা পূজা আসলে উচ্চ বর্ণের দ্বারা আদিবাসীদের উপর আধিপত্য অর্জন পালনের এক উৎসব।

এবার আসা যাক অসুর জাতি প্রসঙ্গে, অসুর হল ভারতের একটি ছোট অস্ট্রোএশিয়াটিক জাতিগোষ্ঠী যারা প্রাথমিকভাবে ঝাড়খন্ড ও পশ্চিমবঙ্গের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে বাস করে।এই বর্ণের লোকেরা নিজেদের মহিষাসুরের বংশধর বলে মনে করে। ঐতিহাসিকদের মতে, মহাভারতের সময় ঝাড়খণ্ড মগধের অধীনে আসে এবং সেই সময়টা ছিল বাহুবলী জরাসন্ধের শাসনকাল।এরপর জরাসন্ধের বংশধররা প্রায় এক হাজার বছর ধরে মগধকে একভাবে শাসন করেছিল বলে অনুমান করা হয়। জরাসন্ধ ছিলেন জাতিতে অসুর, আজ বাংলায় ও ঝাড়খণ্ডে বসবাসকারী বর্তমান আদিবাসী সম্প্রাদায়ের মানুষেরা নিজেদের মহাভারত যুগের অসুরদের বংশধর বলে মনে করেন। বর্তমানে অসুর সম্প্রদায়ের মানুষেরা হিন্দু ক্যালেন্ডার মাসের আশ্বিনের পূর্ণিমার রাতে মহিষাসুরের মৃত্যুতে শোক করার জন্য একত্রিত হয়।

আদিবাসী সমাজের এই বিশ্বাস থেকে সমগ্র বাংলা যখন উৎসবে আনন্দে মগ্ন, তখন আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকেদের সময় কাটে শোক পালনের মাধ্যমে। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ায় আদিবাসীরা দুর্গা পূজার কয়দিন মহিষাসুরের পূজা করে। এটি এই অঞ্চলের আদিবাসীদের একটি জনপ্রিয় ঐতিহ্য।এই উপলক্ষে তাদের দ্বারা একটি বড় মেলার আয়োজন করা হয়। অসুর পূজার ঐতিহ্য আজ বাংলার আরও বেশ কিছু আদিবাসী গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে যা ‘হুদুর দুর্গা’ পালন নামেও পরিচিত।আদিবাসীদের মধ্যে মহিষাসুরকে শহীদ রূপে দেখা যায়। উপজাতি ও দলিত সম্প্রদায় যেমন বাগদি, সাঁওতালি, মুন্ডা এমনকি নমশূদ্ররাও শোকে অংশ নেয়। দুর্গাপূজার নয় দিনে, তারা বেশিরভাগ দিন দিনের বেলা তাদের বাড়ির ভিতরে কাটায় । তারা কেবল রাতে  প্রার্থনা করার জন্য  বাইরে আসে।

আদিবাসীদের এই পালন পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল উপজাতি এবং মধ্যপ্রদেশের কোরকু উপজাতিদের মধ্যে দেখা যায়। তারাও নিজেদের মহিষাসুরের বংশধর বলে বিশ্বাস করে।মহিষাসুরের পূজা শুধু আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মহীশূর থেকে ১৩ কিমি দূরে চামুন্ডি পাহাড়ে মহিষাসুরের একটি বিশাল মূর্তি রয়েছে। মূর্তিটির এক হাতে কোবরা আর অন্য হাতে তলোয়ার। এমনকি মহীশূর নামটি মহিষাসুরানা ওরু (মহিষাসুরের দেশ) থেকে এসেছে। কিংবদন্তি অনুসারে মহিষাসুর ছিলেন মহীশূরের রাজা। তিনি অসুর (শয়তান) ছিলেন না, কিন্তু খুব ভালো শাসক ছিলেন। তাই তৈরি করা হয়েছে মহিমান্বিত মূর্তি। রঙিন আঁকা মূর্তিটি চামুন্ডি পাহাড়ের প্রধান আকর্ষণ এবং পর্যটনের একটি বিশিষ্ট স্থান হয়ে উঠেছে।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Scroll to Top