নীরব নায়ক ইরুলারা, এদের সংগৃহীত বিষেই তৈরি হয় অ্যান্টিভেনম

প্রীতি গুপ্তাঃ যেখানে সাধারণ মানুষ সাপ দেখলেই আতঙ্কে পিছু হটে, সেখানে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের ইরুলা  নামে এক আদিবাসী গোষ্ঠী প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সাপের বিষ সংগ্রহ করেই জীবন চালিয়ে আসছে। এই বিষ থেকেই তৈরি হয় অ্যান্টিভেনম, যা প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ  সহ বিভিন্ন প্রানীর প্রাণ রক্ষা করে সাপের কামড় থেকে।

কারা এই ইরুলা জনগোষ্ঠী? তামিলনাড়ুর উত্তর-পূর্ব উপকূলে বসবাসকারী ইরুলা জাতি ভারতের অন্যতম প্রাচীন আদিবাসী সম্প্রদায়। তাদের প্রায় ৩ লক্ষ জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই সাপ ধরায় পারদর্শী। শুধু পুরুষ নয়, তাদের মহিলারা এবং এমনকি শিশুরাও ছোটবেলা থেকে নগ্ন হাতে সাপ ধরার প্রশিক্ষণ পায়। এ এক অভাবনীয় দক্ষতা, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয়ে আসছে।া

এই জনগোষ্ঠীর প্রধান দেবী কান্নিয়াম্মা—এক কুমারী দেবী, যার সঙ্গে সাপের গভীর সম্পর্ক আছে। তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে পুরোহিতরা অনেক সময় সাপের মতো ফিসফিস করে মন্ত্র বলে দেবীর আত্মাকে প্রতীকীভাবে প্রকাশ করেন। এই সাপের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সংযোগই তাদের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু।

প্রসঙ্গত একসময় ইরুলারা সাপ মেরে তার চামড়া বিক্রি করেই জীবন চালাত। ১০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত দামে এই চামড়া ট্যানারিদের কাছে বিক্রি হতো এবং ইউরোপ-আমেরিকায় রপ্তানি হতো। কিন্তু ১৯৭২ সালে ওয়াইল্ডলাইফ প্রোটেকশন অ্যাক্ট বলবৎ হলে সাপ মারা নিষিদ্ধ হয়। এতে একরাতে ভেঙে পড়ে ইরুলা জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ভিত।

এরপর ১৯৭৮ সালে বিখ্যাত সাপ বিশারদ রমুলাস হুইটেকার গড়ে তোলেন Irula Snake Catchers Industrial Cooperative Society (ISCICS)। এটি ইরুলা জনগোষ্ঠীর মালিকানাধীন, পরিচালিত এবং নিয়ন্ত্রিত একটি প্রতিষ্ঠান। এখানে প্রায় ৩৫০ সদস্য প্রতিদিন ধানক্ষেতে গিয়ে সাপ ধরেন এবং তাদের থেকে বিষ সংগ্রহ করেন। এরপর ২১ দিনের মধ্যে সেগুলিকে চিহ্ন দিয়ে মুক্ত করে দেওয়া হয়।

ভারতে প্রতিবছর প্রায় ৫০,০০০ মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়। ISCICS হল ভারতের অন্যতম প্রধান অ্যান্টিভেনম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, যেখানে বার্ষিক প্রায় ১৫ লক্ষ ভায়াল অ্যান্টিভেনম উৎপাদিত হয়। এই বিষ ছাড়া সাপের কামড়ের প্রতিকার সম্ভব নয়।

ইরুলাদের দক্ষতা শুধুমাত্র ভারতেই নয়, বিদেশেও স্বীকৃত। আমেরিকার ফ্লোরিডা ইভারগ্লেডস ন্যাশনাল পার্কে বার্মিজ পাইথনের উৎপাত ঠেকাতে ইরুলার দুই সদস্য মাসিবদিভেল-কে ডাকা হয়। তারা মাত্র দুই মাসে ৩৪টি পাইথন ধরেন—যা প্রশিক্ষিত কুকুর বা স্থানীয় শিকারিদের পক্ষেও সম্ভব ছিল না।

ইরুলাদের গ্রাম ভাদানেমেলি আজ চেন্নাই শহর সম্প্রসারণের ফলে তীব্র সঙ্কটের মুখোমুখি। সমুদ্র উপকূলে গড়ে উঠছে বিলাসবহুল রিসর্ট, দখল হচ্ছে প্রাকৃতিক এলাকা। পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এখন বলছে, অ্যান্টিভেনম তৈরি হোক বন্দী সাপের থেকে—যা ইরুলাদের দক্ষতাকে অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছে।

বর্তমানে ইরুলা সমাজের অনেকেই চায় তাদের সন্তানরা স্কুলে যাক, চাকরি করুক, যেন তাদের জীবনে নিরাপত্তা ও সম্মান থাকে। ফলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে এই অসাধারণ দক্ষতা। এটি শুধুমাত্র একটি আদিবাসী গোষ্ঠীর ইতিহাস নষ্ট হয়ে যাওয়া নয়, বরং ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ নষ্ট হয়ে যাওয়া।

তাদের এই গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারত সরকার ৭৪তম প্রজাতন্ত্র দিবসে ইরুলা সমাজের দুই সদস্য বদিভেল গোপাল এবং মাসি সদাইয়ান-কে পদ্মশ্রী প্রদান করে।ইরুলা জাতির এই অনন্য দক্ষতা ও ঐতিহ্য শুধু ভারতের নয়, বিশ্বের জন্যও এক মূল্যবান সম্পদ। শহরায়ন ও আধুনিকীকরণের চাপে যাতে এই জ্ঞান ও সংস্কৃতি বিলুপ্ত না হয়, তার দায়িত্ব আমাদের সকলের।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Roop Kishor Soni: একটি আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য তুলে ধরেছেন

উত্তরাপথঃ রাজস্থান মানেই ওজনদার রূপার গহনা ,আর তার উপর কারুকাজ। প্রচলিত এই ধারনা ভেঙ্গে আজ রূপোর গহনাকে আধুনিকতার সাথে শিল্পের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন যে ব্যক্তি তিনি হলেন রূপ কিশোরী সোনী(Roop Kishor Soni)।তিনি ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে তার অসাধারণ শিল্প কর্মের জন্য জাতীয় পুরুস্কার পান। রাজস্থানের জয়সলমেরের শহরের এই শিল্পী ৩.৮ গ্রাম ওজনের ০.৯ সেমি চওড়া রৌপ্য আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য খোদাই করেছেন।এই ছোট রূপার আংটিতে শিল্পী তাজমহল, সিডনি অপেরা হাউস, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, চীনের গ্রেট ওয়াল, আইফেল টাওয়ার, বিগ বেন, পিসার হেলানো টাওয়ার এবং মিশরীয় পিরামিডের চিত্র এক সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন।এছাড়াও তিনি আরও দুটি পৃথক ডিজাইনের অত্যাশ্চর্য আংটি  তৈরি করেছেন।৮.৬ গ্রাম ওজনের একটি রিংয়ে তিনি সূর্যাস্তের সময় ভারতীয় উট সাফারি সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভারতীয় বিশেষত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন,এবং অন্যটিতে বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবী ছবি এবং মন্দির খোদাই করেছিলেন। শিল্পী বলেছেন যে তিনি তার বাবার কাছ থেকে তার শৈল্পিক দক্ষতা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সেই সাথে তিনি বলেন "আমার বাবাও একজন জাতীয় পুরুস্কার প্রাপ্ত শিল্পী ছিলেন। তিনি আমাকে শিল্পের এই দক্ষতা শিখিয়েছিলেন কারণ তিনি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে শিল্পের ফর্মটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।" .....বিস্তারিত পড়ুন

Electoral Bond এর গোপনীয়তা সরিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে, জানাতে হবে প্রাপ্ত অনুদানের পরিমাণ

উত্তরাপথঃ বুধবার, নির্বাচনী বন্ড (Electoral Bond)প্রকল্পের আইনি বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের শুনানি হয়। শীর্ষ আদালত তার মন্তব্যে বলেছে, 'নির্বাচনী বন্ডগুলি রাজনৈতিক দলগুলিকে বেনামী অর্থ প্রদান করে, কারণ তাদের কেনাকাটা সম্পর্কিত রেকর্ডগুলি স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কাছে উপলব্ধ যা শুধুমাত্র তদন্তকারী সংস্থাগুলি অ্যাক্সেস করতে পারে৷ এর আগে নির্বাচনী বন্ড’ (Electoral Bond) সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টে (Supreme Court) কেন্দ্র দাবি করেছিল, রাজনৈতিক দলগুলির আয়ের উৎস জানার অধিকার নেই জনতার।এবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তৎপর হল নির্বাচন কমিশন (Election Commission of India)।বুধবার বিকেল ৫টার মধ্যে যাবতীয় হিসেব জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কমিশনের তরফে।নির্বাচনী বন্ডের (Electoral Bond)মামলায় কেন্দ্রের আর্জি সত্বেও সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক দলগুলিকে আয়ের উৎস জানাতে বলেছিল। আদলত নির্দেশ দিয়েছিল, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক দল কত অনুদান মিলেছে, সেই তথ্য বন্ধ খামে জানাতে হবে।এর আগেও নির্বাচনী বন্ডের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একাধিক মামলা হয়েছে শীর্ষ আদালতে। মামলাকারীরা অভিযোগ করেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলি এই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ বিদেশ থেকে পেতে পারে এর ফলে গণতন্ত্র ধ্বংস হবে। যদিও কোনও রাজনৈতিক দলই এই দাবি মানতে চায়নি। ৩ অক্টোবর মামলার শুনানিতে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সব তথ্য দিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এই রায়ের পরেই তৎপর হল কমিশন। .....বিস্তারিত পড়ুন

ফ্লিম রিভিউ -ওপেনহাইমার

উত্তরাপথ: বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান দ্বারা পরিচালিত”ওপেনহাইমার” একটি মাস্টারপিস মুভি। ছবিতে জে. রবার্ট ওপেনহেইমার, এক নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পারমাণবিক বোমার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।এই সিনেমায় ওপেনহাইমার এর জটিল জীবনকে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই হিসেবে 'ওপেনহাইমার'কে বায়োপিক বলা যেতে পারে।  কারণ এটি একজন মানুষের গল্প। এই ছবির গল্প তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত।ছবির শুরুতে পারমাণবিক বোমা তৈরির আবেগের কথা বলা হয়েছে।  যেখানে নায়ক কিছু না ভেবে নিবেদিতপ্রাণভাবে এমন একটি অস্ত্র তৈরিতে নিয়োজিত থাকে যা বিশ্বকে ধ্বংস করতে পারে।  অস্ত্র তৈরি হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে নায়ক তার কাজের ফলাফল দেখে অপরাধবোধে পূর্ণ হয়।  এবং তৃতীয় পর্যায়টি হল রাজনীতি  যা ওপেনহাইমারকে মোকাবেলা করতে হয়েছে।  পুরো সিনেমাটি রঙিন হলেও রাজনৈতিক অংশ সাদা-কালো রাখা হয়েছে।  এই তিনটি সময়কালে যা কিছু ঘটছে, তা সবই একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। .....বিস্তারিত পড়ুন

বিশ্বকাপ ২০২৩: পাকিস্তানকে হারিয়ে Afghanistan এ ঈদের মতো পরিস্থিতি

আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০২৩-এর ২২ তম ম্যাচে আফগানিস্তান পাকিস্তানকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছে। সেই ম্যাচে পাকিস্তানকে ৮ উইকেটে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে আফগানিস্তান। এই প্রথম ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে হারাল আফগানিস্তান আর এই পাকিস্তানকে হারিয়ে আফগানিস্থানে(Afghanistan)এখন ঈদের মতো পরিস্থিতি।এক আফগানিস্থানি সমর্থকের মতে এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এবং নিজেদের মত করে তারা তাদের এই খুশী উদযাপন করেছেন। এক্স হ্যান্ডেলে এক সমর্থকের মতে, সেদিন উদযাপন ছিল, পার্টি ছিল। এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এছাড়াও, এটি ছিল ২০২৩ বিশ্বকাপের তৃতীয় বড় আপসেট । টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় বাবর আজমের দল। প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান দল ২৮২ রান করে। জবাবে আফগানিস্তান দল ২৮৩ রান তাড়া করে ৪৯ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্য অর্জন করে। এই ম্যাচে হারের পর বেশ ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল অধিনায়ক বাবর আজমকে। ম্যাচ-পরবর্তী উপস্থাপনার সময়, তিনি দলের ত্রুটিগুলি তালিকাভুক্ত করেছিলেন এবং পরাজয়ের জন্য নিজেদের দায়ী করেছিলেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top