অসময়ের অতিথি – 3I/ATLAS

Hubble Space Telescope থেকে তোলা 3I/ATLAS-এর ছবি| ছবিটি Curiosity নামক X-handle থেকে সংগৃহীত|

ড. সায়ন বসু :আমাদের সৌরজগতের বিশাল বিস্তৃতিতে, মাঝে মধ্যে বাইরে থেকে আসা কিছু কিছু মহাজাগতিক বস্তু আমাদের মহাবিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের কথা মনে করিয়ে দেয়।

১ জুলাই ২০২৫ তারিখে, চিলির রিও হুর্তাদোতে ATLAS (অ্যাস্টেরয়েড টেরেস্ট্রিয়াল-ইমপ্যাক্ট লাস্ট অ্যালার্ট সিস্টেম) সার্ভে টেলিস্কোপ ব্যবহার করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একটি ক্ষীণ, দ্রুত গতিশীল মহাজাগতিক বস্তু শনাক্ত করেন যা আগে দেখা যায়নি। এই মহাজাগতিক বস্তুটি হলো একটি আন্তঃনাক্ষত্রিক ধূমকেতু যার নাম 3I/ATLAS| এই ধূমকেতুটিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা C/2025 N1 এবং A11pl3Z নামেও চেনেন| এটি 1I/Oumuamua এবং 2I/Borisov এর পরে সৌরজগতের মধ্য দিয়ে যাওয়া তৃতীয় নিশ্চিত আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তু (Interstellar Object), তাই এর উপসর্গ “3I”। নতুন আবিষ্কৃত ধূমকেতুটি সূর্যের সাপেক্ষে ৬১ কিমি/সেকেন্ড (১৪০,০০০ মাইল প্রতি ঘণ্টা; ২২০,০০০ কিমি/ঘন্টা) বেগে সৌরজগতের ভিতরে প্রবেশ করেছে, যা পৃথিবী থেকে ৩.৫০ AU (৫২৪ মিলিয়ন কিমি; ৩২৫ মিলিয়ন মাইল) এবং সূর্য থেকে ৪.৫১ AU দূরে অবস্থিত| এটি আপাতত আমাদের গ্যালাকটিক সমতলের কাছে সার্পেন্স কৌডা এবং ধনু রাশির সীমানা বরাবর আকাশে চলাচল করছে। 

সব থেকে মজাদার হলো এই ধূমকেতুর উৎপত্তি কোথা থেকে সেটি| এর গতি এবং গতিপথ দেখায় যে এটি মহাকর্ষীয়ভাবে সূর্যের সাথে আবদ্ধ নয় – অর্থাৎ এটি অবশ্যই অন্য কোনও নক্ষত্রমণ্ডলে উৎপন্ন হয়েছে এবং দুর্ঘটনাক্রমে আমাদের নক্ষত্রমণ্ডলে প্রবেশ করেছে।এই ধূমকেতুটি ২৯শে অক্টোবর ২০২৫ তারিখে সূর্যের সবচেয়ে কাছে এসে পৌঁছায়, সূর্য থেকে ২০৩ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্বে, যা পৃথিবী এবং মঙ্গলের কক্ষপথের মধ্যে অবস্থিত। ধূমকেতুটি আকাশগঙ্গা ছায়াপথের পাতলা ডিস্ক অথবা পুরু ডিস্ক থেকে উদ্ভূত বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন| যদি 3I/ATLAS পুরু ডিস্ক থেকে উদ্ভূত হয়, তাহলে ধূমকেতুটি কমপক্ষে ৭ বিলিয়ন বছর বয়সী হতে পারে| অর্থাৎ এটি সৌরজগতের চেয়েও পুরনো। 

এবার প্রশ্ন হলো ধূমকেতু কি? ধূমকেতু আসলে তৈরি হয় নক্ষত্রমণ্ডল তৈরির সময় অবশিষ্ট উপাদান দিয়ে। এখানে আমরা বলছি ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগের ধুলো এবং বরফের কথা। ধূমকেতুর কেন্দ্রস্থলে একটি কঠিন নিউক্লিয়াস বা “নোংরা তুষারগোলক” থাকে, যা হিমায়িত জল, ধুলো এবং কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, মিথেন এবং অ্যামোনিয়ার মতো উদ্বায়ী পদার্থ দিয়ে তৈরি। যখন একটি ধূমকেতু সূর্যের কাছাকাছি আসে, তখন সূর্যের তাপ ধূমকেতুর পৃষ্ঠের বরফকে গ্যাসে পরিণত করে, যার ফলে নিউক্লিয়াসের চারপাশে একটি অস্থায়ী বায়ুমণ্ডল বা কোমা তৈরি হয়। নির্গত ধুলো এবং গ্যাসের জন্যে ধূমকেতুটিকে অস্পষ্ট দেখায় এবং ধূমকেতুর পিছনে একটি লেজ তৈরি হয় যা লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে। ধূমকেতুর দুটি লেজ থাকে। একটি সাদা এবং ধূমকেতু থেকে বেরিয়ে আসা ধুলো দ্বারা গঠিত, অন্যটি নীলাভ এবং বৈদ্যুতিকভাবে চার্জযুক্ত অণু বা আয়ন দিয়ে তৈরি। আয়ন লেজটি ধূমকেতুর অবস্থান নির্বিশেষে সরাসরি সূর্য থেকে দূরে থাকে। 

ধূমকেতু 3I/ATLAS সূর্যের সবচেয়ে কাছে আসার সময় বিজ্ঞানীদের প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশী উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে যা খুবই আশ্চর্যের। বর্তমানে সূর্যকে পর্যবেক্ষণকারী মহাকাশযানগুলি ধূমকেতুটি নক্ষত্রের সবচেয়ে কাছের বিন্দু, পেরিহেলিয়নের দিকে আছড়ে পড়ার সাথে সাথে উজ্জ্বলতার নাটকীয় বৃদ্ধি লক্ষ্য করেছে, যা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বিভ্রান্ত করে তুলেছে। বেশিরভাগ ধূমকেতু লালচে দেখায় কারণ ধুলো থেকে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়, কিন্তু 3I/ATLAS দেখতে নীল, যা ইঙ্গিত দেয় যে কার্বন যৌগের মতো গ্যাসগুলি এর কোমাকে আলোকিত করছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়র জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী আভি লোয়েব অনুমান করেছেন যে বস্তুটি সূর্যের চেয়েও বেশি উষ্ণ কোন উৎস ধারণ করতে পারে।

সূর্যকে কেন্দ্র করে নিয়মিত প্রদক্ষিণকারী অসংখ্য ধূমকেতু থেকে 3I/ATLAS একদমই আলাদা, কারণ এই ধূমকেতুকে আমরা এই একবারই দেখতে পাবো। এর হাইপারবোলিক কক্ষপথের অর্থ হল এটি সম্ভবত অন্য কোনও নক্ষত্রমণ্ডল থেকে নির্গত হয়েছিল, সম্ভবত কোনও বড়গ্রহের সাথে মহাকর্ষীয় সংঘর্ষের পরে। একবার এটি সূর্যের কাছ দিয়ে চলে গেলে, এটি বাইরের দিকে তার যাত্রা চালিয়ে যাবে এবং আর কখনও ফিরে আসবে না পৃথিবীর আকাশে। 

দুর্ভাগ্যবশত 3I/ATLAS ধূমকেতুটিকে খালি চোখে দেখা অসম্ভব। কারণ এর বর্তমান উজ্জ্বলতা ১২ থেকে ১৪ মাত্রার মধ্যে, যা স্পষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য কমপক্ষে ৮ ইঞ্চি মাপের একটি বড় টেলিস্কোপের প্রয়োজন। 

*লেখক বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার University of Witwatersrand-এ গবেষণারত 

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


ফ্লিম রিভিউ -ওপেনহাইমার

উত্তরাপথ: বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান দ্বারা পরিচালিত”ওপেনহাইমার” একটি মাস্টারপিস মুভি। ছবিতে জে. রবার্ট ওপেনহেইমার, এক নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পারমাণবিক বোমার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।এই সিনেমায় ওপেনহাইমার এর জটিল জীবনকে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই হিসেবে 'ওপেনহাইমার'কে বায়োপিক বলা যেতে পারে।  কারণ এটি একজন মানুষের গল্প। এই ছবির গল্প তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত।ছবির শুরুতে পারমাণবিক বোমা তৈরির আবেগের কথা বলা হয়েছে।  যেখানে নায়ক কিছু না ভেবে নিবেদিতপ্রাণভাবে এমন একটি অস্ত্র তৈরিতে নিয়োজিত থাকে যা বিশ্বকে ধ্বংস করতে পারে।  অস্ত্র তৈরি হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে নায়ক তার কাজের ফলাফল দেখে অপরাধবোধে পূর্ণ হয়।  এবং তৃতীয় পর্যায়টি হল রাজনীতি  যা ওপেনহাইমারকে মোকাবেলা করতে হয়েছে।  পুরো সিনেমাটি রঙিন হলেও রাজনৈতিক অংশ সাদা-কালো রাখা হয়েছে।  এই তিনটি সময়কালে যা কিছু ঘটছে, তা সবই একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। .....বিস্তারিত পড়ুন

সহযাত্রী

দীপা - আর তো এগারো বছর আটমাস বারোদিন চাকরি , তাই না ? অংশু - বাপরে বরাবরই তোমার স্মৃতিশক্তি প্রবল , এতোটা মনে আছে ? দীপা- ঘোরো টো টো করে আর কটা বছর , আফটার রিটায়ার্ড মেন্ট কি করবে ? অংশু - ফার্ম হাউস ,গাছপালা পশুপাখি নিয়ে থাকবো। দীপা- বাঃ উন্নতি হয়েছে। যে অংশুবাবু কখনও একটা ফুলের চারা লাগায়নি সে কিনা ফার্ম হাউস করবে … অংশু - সময়ের সাথে সব বদলায় ম্যাডাম , আচ্ছা তোমার কনুইয়ের নীচে সেই পোড়া দাগটা দেখি তো গেছে কিনা … দীপা- তুমি অনেক রোগা হয়ে গেছো , তা ওজন কত শুনি ? অংশু - সত্তর বাহাত্তর হবে বোধহয় মাপিনি, দীপা - তা কেনো মাপবে ? একটা অগোছালো মানুষ। অংশু - যাক বাবা তাও অপদার্থ শব্দ টা বলোনি। দীপা - ভাবোনা ডিভোর্স হয়েছে বলে সে অধিকার নেই। সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়েও আসলে সমাজটাই শেখোনি , আর কি শিখেছো বলো, ঐ ছেলে পড়ানো , সেমিনার আর লেখালেখি। তা ধন্যবাদ তোমার রূপালী ঠৌট উপন্যাস এবছর একাডেমি পেলো , দারুণ লেখো তুমি, আগের চেয়ে অনেক ধার। অংশু- বাঃ তুমি পড়েছো ? দীপা- সব পড়েছি , তোমার রিসেন্ট উপন্যাসের নায়িকা মেঘনা টি কে ? মানে কার আড়ালে কাকে লিখেছো ? অংশু - এও কি বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপিকাকে বলে দিতে হবে ? দীপা- বারোটা বছর সময়ের শাসনে অনেক বদলালেও আমি বোধহয় সেই বড্ড সেকেলেই রয়ে গেলাম। অংশু - একা একাই কাটিয়ে দিলে বারো বছর। দীপা- একই প্রশ্ন আমিও করতে পারি। অংশু - আচ্ছা দীপা আজ না হয় শেষবারের মতো বলি, আমার মধ্যে কি ছিলো না বলোতো ? কেনো পারোনি এই বাউন্ডুলে ভবঘুরে মানুষটার সাথে চিরকালের ঘর বাঁধতে ? আমি কি ভালোবাসতে জানি না ? .....বিস্তারিত পড়ুন

Free Gift in Politics: ভারতের নির্বাচন ও ফ্রি গিফট সংস্কৃতি

উত্তরাপথঃ ফ্রি গিফট (Free gift in politics)এর রাজনীতি সম্প্রতি ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করছে। বিনামূল্যে কোটি কোটি জনগণকে উপহার প্রদান যা রাজকোষের উপর অতিরিক্ত বোঝা ফেলবে এই সত্যটি জানা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক দলগুলি ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য ফ্রি গিফট (Free gift in politics) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনের দৌড়ে একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।এক সময় প্রয়াত তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতা বিনামূল্যে শাড়ি, প্রেসার কুকার, ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন সেট ইত্যাদির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের আগে যে বিনামূল্যের সংস্কৃতি শুরু করেছিলেন তা পরবর্তী কালে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি দ্রুত অনুসরণ করেছিল। এরপর ২০১৫ সালে আম আদমি পার্টি নেতৃত্ব দিল্লির ভোটারদের কাছে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, জল, বাস ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

Karar Oi Lauh Kapat: কাজী নজরুলের এই গানকে ঘিরে  বিতর্কে এ আর রহমান

উত্তরাপথঃ বিতর্কে 'পিপ্পা' ছবির সঙ্গীত পরিচালক অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান।সম্প্রতি কবি কাজী নজরুল ইসলামের পরিবার একটি হিন্দি ছবিতে কবির জনপ্রিয় গান 'করার ঐ লৌহ কাপাত...' (Karar Oi Lauh Kapat )।কিন্তু এ আর রহমানের সঙ্গীত পরিচালনায় ওই গানটি যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে আপত্তি জানিয়েছে নজরুল পরিবার।বিতর্কের পর যে চুক্তির আওতায় ওই গানটি ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে তা প্রকাশ্যে আনার দাবি তুলেছে কবির পরিবার।'পিপ্পা' শিরোনামের হিন্দি চলচ্চিত্রটি যেখানে (Karar Oi Lauh Kapat )গানটি ব্যবহার করা হয়েছে তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া একজন ভারতীয় সেনা সৈনিককে কেন্দ্র করে একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। ছবির সঙ্গীত পরিচালক অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান। গানের কথা ঠিক রেখেও সুর পাল্টানোর অভিযোগে ভারত ও বাংলাদেশে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।কবির পরিবারের অভিযোগ, গানটি ব্যবহারের অনুমতি দিলেও সুর পরিবর্তনের অনুমতি দেওয়া হয়নি।পরিবারের সদস্যরাও ছবিটি থেকে গানটি বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top