

ছবি- এক্স হ্যান্ডেল থেকে নেওয়া।
প্রীতি গুপ্তাঃ যখন সুজান কলিন্সের লেখা “দ্য হাঙ্গার গেমস” বইগুলো প্রকাশ পেয়েছিল, তখনকার পাঠকরা হয়তো ভাবতেও পারেননি যে, বইয়ের সেই বিভীষিকাময় দৃশ্যগুলো বাস্তবের পৃথিবীতেও একদিন ঘটবে। কিন্তু আজ গাজার মাটিতে, এই ভয়াবহতা প্রতিদিন ঘটছে – এবং বিশ্বের চোখ যেন এই নরককেও দেখতে ব্যর্থ।
গাজা উপত্যকা মার্চ মাস থেকে সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। প্রতিটি পরিবার এখন একবেলা খাবারের জন্য লড়াই করছে – কেউ কেউ তো দিনের পর দিন না খেয়ে কাটাচ্ছেন। মানবিক বিপর্যয় এখন আর একটিমাত্র ‘সংকট’ নয়, বরং তা এক নির্মম অস্ত্র হয়ে উঠেছে।
ত্রাণ নয়, মৃত্যুর ফাঁদ
মে মাসের শেষ দিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত Gaza Humanitarian Foundation (GHF) সীমিত কিছু ত্রাণ বিতরণ শুরু করে। কিন্তু সেগুলো ছিল পরিকল্পিতভাবে বিশৃঙ্খল এবং প্রাণঘাতী। গাজাবাসীদের জন্য এটি যেন একটি মরন-খেলা – খাদ্যের জন্য জীবন বাজি রাখার খেলা।
ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত “নেটজারিম করিডোর”– একে স্থানীয়রা বলেন “মৃত্যুর করিডোর”। এই জায়গা ঘিরে আছে বালু, সৈন্য, বিদেশি মিলিশিয়া এবং ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক। কোনও নির্দিষ্ট সময়সূচি নেই – কখনো ভোর ৪টায়, কখনো আরও দেরিতে গেট খোলা হয়। লোকজন আগের রাত থেকেই অপেক্ষা করতে থাকেন।
দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই শত শত ক্ষুধার্ত মানুষ ছুটে যান একটি খাদ্যের বাক্সের আশায়। কোনও সারি নেই, নেই নিয়ন্ত্রণ, নেই নিরাপত্তা। চারপাশে শুধু ধুলো, আর্তনাদ, আতঙ্ক। ড্রোনগুলো মাথার ওপর চক্কর দেয়, তারপর হঠাৎ এক ঘোষণা – “চার মিনিট! যত পারো নিয়ে নাও!”
বালির মধ্যে কিছু খাদ্যের বাক্স ফেলে রাখা হয়। তা কখনোই যথেষ্ট হয় না। হঠাৎ লড়াই শুরু হয় – কেউ কেউ ছুরি চালায়, মুষ্টিযুদ্ধ বেধে যায়, শিশুদের কান্না, মহিলাদের হাঁটুপরে হামাগুড়ি – এইসব দৃশ্য যেন বাস্তবের ‘হাঙ্গার গেমস’।
আর তারপর আসে গুলির শব্দ। মে মাসের শেষ থেকে এখন পর্যন্ত ৫০০’র বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, এবং ৪,০০০’রও বেশি আহত হয়েছেন ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গুলিতে – শুধুমাত্র ত্রাণ সংগ্রহ করতে যাওয়ার সময়।
একজন স্থানীয়ের বাবা , ১৪ জুন সকালে পরিবারকে খাবার জোগার করতে গিয়ে আর ফেরেননি। গুলিতে তার মৃত্যু হয়। আরেকজন যুবক, খামিস – যার নিজেরই ভাই আগেই নিহত হয়েছেন – পরিবার চালাতে গিয়ে ২৪ জুন ত্রাণ হাবের কাছে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান।
এইরকম হাজারো গল্প আছে – যেগুলো আমরা কোনও দিন জানতেও পারব না।
কেন এই নৃশংসতা?
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই ঘটনাগুলোকে “ত্রাণ হত্যাকাণ্ড” বলেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনবিদেরা একে “যুদ্ধাপরাধ” বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু বাস্তবে এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত “মানবিক অস্ত্র”। ক্ষুধাকে অস্ত্র বানিয়ে ফেলা হয়েছে।
ইসরায়েল পূর্বে যে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা UNRWA-র সাহায্য কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে, তার পেছনে এই ‘বিভাজনের নীতি’ই মূল চালিকা শক্তি। UNRWA-র নিয়মিত, সুশৃঙ্খল ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থা – যেখানে প্রতি পরিবারের জন্য আইডেন্টিটি কার্ড থাকত, এবং সবচেয়ে দুর্বলদের অগ্রাধিকার দেওয়া হতো – তা ছিল মানবিকতা ও সম্মানের প্রতীক।
কিন্তু সেই ব্যবস্থা ইসরায়েলের পছন্দ নয়। তারা চায় “ক্ষুধার খেলায়” গাজাবাসীরা একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড়াক। সামাজিক ঐক্য ভেঙে পড়ুক।
ইসরায়েল ও GHF শুরুতে এই হত্যাকাণ্ড অস্বীকার করলেও, এখন ইসরায়েলি গণমাধ্যম নিজেরাই স্বীকার করেছে যে সেনাবাহিনীকে গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।তাহলে এখন কি বিশ্ববাসী আমাদের কথা বিশ্বাস করবে? তারা কি এগিয়ে আসবে, কিছু করবে?এই যা ঘটছে, তা কোনো সিনেমা নয়, কোনও গল্প নয় – এ এক জীবন্ত গণহত্যা।
আর এই ভয়াবহতাকে যেভাবে গোটা বিশ্ব মেনে নিচ্ছে – সেটাই মানবতা হারানোর সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
একটি মানবিক ডাক:
এই সময়ে কোনও ধর্ম, জাতি, রাজনীতি নয় – শুধু মানবতাই হতে পারে আমাদের সত্যিকার পরিচয়। গাজায় যা হচ্ছে, তা চুপচাপ দেখা মানে এই অন্যায়ে অংশগ্রহণ করা। এখনই সময়, প্রতিটি বিবেকবান মানুষ, প্রতিটি সমাজ, প্রতিটি দেশ যেন জেগে উঠে বলে – “এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ হোক।”
মানবতা যেন হারিয়ে না যায় আরেকটি বালির চত্বরে।
বিঃ দ্রঃ এই প্রতিবেদনে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব মতামত।
আরও পড়ুন
Vijay Stambh : চিতোরগড় দুর্গে বিজয় স্তম্ভ হিন্দু – মুসলিম সহাবস্থানের প্রতীক
উত্তরাপথঃ খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে মৌর্য রাজবংশ কর্তৃক স্থাপিত চিতোরগড় দুর্গ সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গ তার বিশাল কাঠামো, রাজপ্রাসাদ, একাধিক সুদৃশ্য মন্দির সহ সুন্দর জলাশয়ের জন্য বিখ্যাত।৭০০-একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এই দুর্গটিতে প্রায় ৬৫টি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে যা রাজপুত এবং ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীর সূক্ষ্মতার প্রমান দেয়। বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh)) হল এই দুর্গে অবস্থিত,সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কাঠামো।এই আশ্চর্য-অনুপ্রেরণামূলক স্তম্ভটি কেবল তার উচ্চতার জন্য বিখ্যাত নয়,এটি রাজপুতদের অদম্য সাহস এবং অধ্যবসায়ের গল্পও বলে যা চিতোরগড় দুর্গেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে।বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh), নাম থেকে বোঝা যায়, বিজয়ের প্রতীক। প্রাচীনকালে যে কোনো যুদ্ধ অভিযানের সাফল্যের পর সেই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে রাজারা মন্দির, স্তূপ, স্মৃতিস্তম্ভ ও স্তম্ভ নির্মাণ করতেন। ৯ তলা এই বিজয় স্তম্ভটি ১৯৪০ থেকে ১৪৪৮ সালের মধ্যে মহারানা কুম্ভ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন
ওজন হ্রাস (weight loss) মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে
উত্তরাপথঃ এপ্রিলে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, শাকসবজি, সামুদ্রিক খাবার এবং গোটা শস্য সমৃদ্ধ একটি ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য খাওয়া - এমনকি শুধুমাত্র খাদ্যের নির্দেশিকা অনুসরণ করে ওজন হ্রাস (weight loss)মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে বলে মনে করা হয়।সাম্প্রতি ডিউক ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত, একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ওজন হ্রাস মস্তিষ্কে বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ৯ মাস পর্যন্ত ধীর করে (aging process) দিতে পারে। গবেষণায় ৬০ থেকে ৭৮ বছর বয়সের মধ্যে ৪৭ জন অংশগ্রহণকারীকে জড়িত করা হয়েছিল, যাদের প্রত্যেকেরই ওজন বেশি বা স্থূল ছিল এবং তাদের অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যগ্রহণ ছিল। তাদের এলোমেলোভাবে একটি ক্যালোরি-সীমাবদ্ধ গ্রুপ বা একটি নিয়ন্ত্রণ গ্রুপে বরাদ্দ করা হয়েছিল।ক্যালোরি-সীমাবদ্ধতা গোষ্ঠীর সদস্যদের একটি খাদ্য পরিকল্পনা অনুসরণ করে, যার লক্ষ্য ছিল তাদের আনুমানিক প্রয়োজনের চেয়ে ১০ – ১৫% কম ক্যালোরি গ্রহণ করা। অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রণ গ্রুপ তাদের খাদ্য পরিবর্তন করেনি .....বিস্তারিত পড়ুন
Karar Oi Lauh Kapat: কাজী নজরুলের এই গানকে ঘিরে বিতর্কে এ আর রহমান
উত্তরাপথঃ বিতর্কে 'পিপ্পা' ছবির সঙ্গীত পরিচালক অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান।সম্প্রতি কবি কাজী নজরুল ইসলামের পরিবার একটি হিন্দি ছবিতে কবির জনপ্রিয় গান 'করার ঐ লৌহ কাপাত...' (Karar Oi Lauh Kapat )।কিন্তু এ আর রহমানের সঙ্গীত পরিচালনায় ওই গানটি যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে আপত্তি জানিয়েছে নজরুল পরিবার।বিতর্কের পর যে চুক্তির আওতায় ওই গানটি ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে তা প্রকাশ্যে আনার দাবি তুলেছে কবির পরিবার।'পিপ্পা' শিরোনামের হিন্দি চলচ্চিত্রটি যেখানে (Karar Oi Lauh Kapat )গানটি ব্যবহার করা হয়েছে তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া একজন ভারতীয় সেনা সৈনিককে কেন্দ্র করে একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। ছবির সঙ্গীত পরিচালক অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান। গানের কথা ঠিক রেখেও সুর পাল্টানোর অভিযোগে ভারত ও বাংলাদেশে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।কবির পরিবারের অভিযোগ, গানটি ব্যবহারের অনুমতি দিলেও সুর পরিবর্তনের অনুমতি দেওয়া হয়নি।পরিবারের সদস্যরাও ছবিটি থেকে গানটি বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। .....বিস্তারিত পড়ুন
প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক
উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন