প্লাস্টিকের রাসায়নিকে হৃদরোগে মৃত্যুর ঝুঁকি ভারতে সর্বোচ্চ!

উত্তরাপথঃ একটি নতুন বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য—প্লাস্টিক তৈরিতে ব্যবহৃত একধরনের রাসায়নিক প্রতিদিন ব্যবহারের ফলে ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী হৃদরোগজনিত কারণে ৩ লক্ষ ৫৬ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।প্লাস্টিক তৈরিতে ব্যবহৃত এই রাসায়নিকের নাম ফথালেটস (Phthalates)। এগুলো বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতভাবে ব্যবহৃত হলেও মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এর কারণে মৃত্যুর হার অনেক বেশি—বিশ্বের মোট মৃত্যুর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ এই অঞ্চলগুলিতে ঘটেছে।

এখন প্রশ্ন কিভাবে ফথালেটস আমাদের শরীরে ক্ষতি করে? সাধারণত ফথালেটস ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন প্রসাধনী, ডিটারজেন্ট, প্লাস্টিক পাইপ, কীটনাশক, খাবার সংরক্ষণের পাত্র ও চিকিৎসা সামগ্রীতে। এগুলো শরীরে প্রবেশ করে অতি সূক্ষ্ম কণায় ভেঙে যায়, এটি সাধারণত শ্বাস-প্রশ্বাস, খাদ্যগ্রহণ বা ত্বকের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, এর ফলে ওবেসিটি, ডায়াবেটিস, বন্ধ্যাত্ব, ক্যান্সার এমনকি হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়ে।

এ গবেষণাটি পরিচালনা করেছে NYU Langone Health-এর গবেষকরা, যারা বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন ডাইইথাইলহেক্সাইল ফথালেট (DEHP) নামক একটি উপাদানকে। এটি DEHP প্লাস্টিককে নমনীয় করে তুলতে ব্যবহৃত হয় এবং মূলত খাবারের পাত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জামে বেশি ব্যবহার হয়।

গবেষণায় বলা হয়েছে, DEHP হৃদপিণ্ডের ধমনিতে প্রদাহ তৈরি করে, যা সময়ের সাথে হৃদরোগ বা স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়ায়। তারা হিসাব করে দেখেছেন যে, ২০১৮ সালে শুধু ৫৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী মানুষের মধ্যেই এই রাসায়নিকের কারণে ৩ লক্ষ ৫৬ হাজার ২৩৮টি মৃত্যু হয়েছে, যা ওই বয়সের শ্রেণিতে হৃদরোগজনিত মৃত্যুর ১৩ শতাংশ।

  • অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটি সত্যি যেভারতে সবচেয়ে বেশি DEHP জনিত কারণে হৃদরোগজনিত মৃত্যু হয়েছে,০৩,৫৮৭ জন।
  • এরপরেই রয়েছে চীন ইন্দোনেশিয়া
  • পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য মিলে বিশ্বব্যাপী DEHP-সম্পর্কিত মৃত্যুর ৪২% এবং পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল মিলে ৩২%।

এই বিশ্লেষণটি প্রতিষ্ঠিত করে যে, যেসব দেশে প্লাস্টিক উৎপাদনের হার বেশি অথচ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে দুর্বল সেইসব দেশের মানুষ বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।

গবেষণার প্রধান লেখক সারাহ হাইম্যান বলেন,”ফথালেটস-এর মত রাসায়নিকের সঙ্গে যদি বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হৃদরোগের সম্পর্ক থাকে, তাহলে এটি মানব স্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় হুমকি।”

সহ-গবেষক লিওনার্দো ত্রাসান্দে বলেন,”এই গবেষণাটি দেখিয়ে দেয় কোন কোন অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে এবং বিশ্বব্যাপী এই রাসায়নিক ব্যবহারে কঠোর নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা কতটা জরুরি।”

তবে গবেষকরা স্পষ্ট করে বলেছেন, এই গবেষণা DEHP একাই হৃদরোগের কারণ তা প্রমাণ করে না, বরং এটি একাধিক ফথালেটের সম্মিলিত প্রভাবে হতে পারে। পাশাপাশি এই গবেষণাটি শুধু ৫৫-৬৪ বছর বয়সীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ, ফলে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

গবেষক দল ভবিষ্যতে এই রাসায়নিকের ব্যবহার কমালে তা কীভাবে বৈশ্বিক মৃত্যুহার কমাতে পারে, সেটি পর্যবেক্ষণ করবেন। এছাড়া ফথালেটস-এর কারণে প্রিম্যাচিউর বার্থসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে গবেষণা সম্প্রসারণের পরিকল্পনাও রয়েছে।


এই গবেষণা আমাদেরকে এক গুরুতর বার্তা দেয়—দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত প্লাস্টিকজাত পণ্য আমাদের অজান্তেই প্রাণঘাতী প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষত ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে প্লাস্টিকের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে কিন্তু সুরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল, সেখানে সরকার ও সাধারণ মানুষ উভয়েরই উচিত সতর্ক হওয়া এবং বিকল্প উপায় খোঁজা অত্যন্ত প্রয়োজন।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


PAN-Aadhar link: কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে নিষ্ক্রিয় করেছে

উত্তরাপথ : আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link)করার সময়সীমা শেষ হওয়ার পরে কেন্দ্রীয় সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ড নিষ্ক্রিয় করেছে৷ আপনি যদি এখনও প্যান কার্ডের সাথে আধার কার্ড লিঙ্ক না করে থাকেন, তাহলে আপনি সরকারের এই কঠোর পদক্ষেপের আওতায় এসেছেন। আপনি যদি আপনার আধার কার্ডকে প্যানের সাথে লিঙ্ক করতে চান তবে আপনি জরিমানা দিয়ে এটি সক্রিয় করতে পারেন। কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে আধারের সাথে লিঙ্ক না করার কারণে নিষ্ক্রিয় করেছে। একটি আরটিআই-এর জবাবে, সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস জানিয়েছে যে আধার কার্ডের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link) করার সময়সীমা ৩০ জুন শেষ হয়েছে। যারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আধার কার্ড এবং প্যান কার্ড লিঙ্ক করেননি তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দেশে ৭০ কোটি প্যান কার্ড বর্তমানে ভারতে প্যান কার্ডের সংখ্যা ৭০.২ কোটিতে পৌঁছেছে। এর মধ্যে প্রায় ৫৭.২৫ কোটি মানুষ আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক করেছেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক

উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই  সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন

NASA Carbon Emission: পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে

উত্তরাপথঃ কার্বন নির্গমন (NASA Carbon Emission) সম্পর্কে নাসার সর্বশেষ আবিষ্কার পৃথিবীর জন্য এক সতর্কতা সংকেত। মহাকাশ সংস্থার মতে, পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে, যার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। NASA এর এই আবিষ্কারটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, সেইসাথে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেছে।নাসার সর্বশেষ গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে পৃথিবীর মহাসাগর এবং ভূমি-ভিত্তিক বাস্তুতন্ত্র আগের চেয়ে কম কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে গত এক দশকে ভূমি এবং মহাসাগর দ্বারা শোষিত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৫% হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Vijay Stambh : চিতোরগড় দুর্গে বিজয় স্তম্ভ হিন্দু – মুসলিম সহাবস্থানের প্রতীক

উত্তরাপথঃ খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে মৌর্য রাজবংশ কর্তৃক স্থাপিত চিতোরগড় দুর্গ সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গ তার বিশাল কাঠামো, রাজপ্রাসাদ, একাধিক  সুদৃশ্য মন্দির সহ সুন্দর জলাশয়ের জন্য বিখ্যাত।৭০০-একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এই দুর্গটিতে প্রায় ৬৫টি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে যা রাজপুত এবং ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীর সূক্ষ্মতার প্রমান দেয়। বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh)) হল এই দুর্গে অবস্থিত,সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কাঠামো।এই আশ্চর্য-অনুপ্রেরণামূলক স্তম্ভটি কেবল তার উচ্চতার জন্য বিখ্যাত নয়,এটি রাজপুতদের অদম্য সাহস এবং অধ্যবসায়ের গল্পও বলে যা চিতোরগড় দুর্গেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে।বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh), নাম থেকে বোঝা যায়, বিজয়ের প্রতীক।  প্রাচীনকালে যে কোনো যুদ্ধ অভিযানের সাফল্যের পর সেই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে রাজারা মন্দির, স্তূপ, স্মৃতিস্তম্ভ ও স্তম্ভ নির্মাণ করতেন।  ৯ তলা এই বিজয় স্তম্ভটি ১৯৪০ থেকে ১৪৪৮ সালের মধ্যে মহারানা কুম্ভ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top