

প্রিয়াঙ্কা দত্ত – বিপ্লবী রাসবিহারী বসুকে তো আমরা সকলেই চিনি। যাঁর বিপ্লবী কার্য কলাপ একসময় ব্রিটিশ শাসকদের ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিল, সেই রাসবিহারী বসুর মাথার দাম তৎকালীন বারো হাজার টাকা ধার্য করা হয়েছিলো। আবার সেই রাসবিহারী বসুই কিনা জাপানের জনপ্রিয় ভারতীয় স্বাদের এক অভিনব খাদ্য বস্তুর জন্য আজও টোকিও শহরে বিখ্যাত? পরস্পর বিরোধী হলেও ঘটনাটা সত্যি।
১৯১২ সালে দিল্লীর শোভাযাত্রায় লর্ড হার্ডিঞ্জকে আক্রমণের মূল পান্ডা হিসাবে যখন রাসবিহারী বসুর নাম উঠে এলো তখন তিনি দেরাদুন বন গবেষণা বিভাগে ব্রিটিশ সরকাররের রীতিমত বিশ্বস্ত এক করণিক এবং ব্রিটিশ শাসকদের বিশেষ আস্থাভাজন এক ব্যাক্তি। অথচ গোপন বিপ্লবী কার্যকলাপে তখন তিনি বাংলা, পাঞ্জাব আর বর্তমান উত্তর প্রদেশের প্রধান সংগঠক। ছদ্মবেশ ধরনে যেমন তিনি অসাধারণ পটুত্বের অধিকারী ছিলেন তেমনই শাসক মহলের অন্দরে বসে তাদের বিরুদ্ধেই বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের ব্লু প্রিন্ট তৈরী করতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। এমনই সব বৈপরীত্য ছিল তাঁর সারাজীবনের সঙ্গী।
তবে এই ষড়যন্ত্রের খবর যখন ইংরেজ শাসন কর্তাদের কানে পৌঁছোয়, মি. বসুর খোঁজে দিল্লী থেকে বাংলা সর্বত্র শুরু হয় চিরুনী তল্লাশি। কিন্তু কখনও অ্যাংলো ইন্ডিয়ানের বেশে, কখনও ঝাড়ুদার সেজে বা কখনও বৈষ্ণব সাধু সেজে তিনি অনবরত পুলিশকে বোকা বানাতে থাকেন। অবশেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মীয় পি.এন. ঠাকুরের ছদ্মবেশে ১৯১৫ সালে জাহাজে চেপে তিনি জাপানে পালিয়ে যান।
জাপানে তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দেশের বাইরে থেকে বৈপ্লবিক কার্যকলাপে ইন্ধন যোগানো। সেই সূত্রে বিভিন্ন প্যান এশিয়ান নেতাদের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে উঠে এবং তাঁরা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁকে সাহায্যের আশ্বাস দেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকাররের গুপ্তচররা জাপানে মি. বসু কে চিনতে পারে ও ব্রিটিশ সরকাররের তরফ থেকে জাপান সরকারের ওপর প্রত্যার্পণের চাপ আসতে থাকে। এমতাবস্থায় রাসবিহারী বসু ক্রমাগত বাসা ও বেশ বদলের মাধ্যমে নানা জায়গায় আত্মগোপন করে থাকতেন। একসময় এভাবেই তিনি এসে উপস্থিত হন টোকিও শহরের সোমা পরিবারে আশ্রয়ে। তাঁদের ছিল নাকামুরায়া নামে এক পারিবারিক বেকারির ব্যবসা। সেই কারখানাতেই বেশ কিছুদিনের জন্য আত্মগোপন করেন মি. বসু। সেই সময় সোমা পরিবারে কর্তা আইজো সোমা ও কর্ত্রী কোকো সোমা নিজেদের জীবন বাজী রেখে তাঁকে পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করেন। এমনকি তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে কোকো সোমার দুধের শিশুটিও সঠিক পরিচর্যার অভাবে মারা যায়। একজন বিদেশী আগন্তুকের জন্য সোমা পরিবারে এতবড় বলিদান মি. বসু কখনও ভুলতে পারেননি। কিছুদিন পর রাসবিহারী বসুর উপর থেকে ব্রিটিশ সরকাররের বিধিনিষেধ উঠে গেলে , তিনি সোমা পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নেন এবং কোকো সোমা কে “মা” বলে সম্বোধন করেন। এভাবেই তাঁদের মধ্যে এক অচ্ছেদ্য বন্ধন গড়ে ওঠে। সেই সময় কৃতজ্ঞতা বসত তিনি একটি ভোজ সভার আয়োজন করেন এবং সেখানে সম্পূর্ন বাঙালি স্বাদের খাবার পরিবেশন করে সকলকে তাক লাগিয়ে দেন। সেই থেকেই তাঁর রান্নার প্রশংসা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
ব্রিটিশ সৈনিকরা ভারতীয় খাবারের অনুকরণে জাপানে রাইসু কারি নামে এক পদ সৃষ্টি করে যা ছিল ভাত আর সবুজ আপেল, ময়দা ও ভিনিগার দিয়ে তৈরী একরকম তরকারি। জাপানে অনেকেই এটি পছন্দ করতেন। কিন্তু স্বদেশিকতা যাঁর রক্তে তিনি ভারতীয় স্বাদের এমন বেহাল দশা সহ্য করতে পারবেন না সেটাই স্বাভাবিক। তাই মিঃ বসু আসলে রাইস কারির স্বাদ কেমন হয় তা জাপান বাসীকে চেখে দেখার সুযোগ করে দিলেন।
এর মাঝে অবশ্য সোমা পরিবার ও রাসবিহারী বসুর জীবনে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। মিঃ বসু কে গ্রেফতারির হাত থেকে রক্ষা করতে তাঁকে জাপানি নাগরিকত্ব দেওয়া জরুরী হয়ে পড়ে। তখন জাপানের নেতারা তাঁর সঙ্গে সোমা পরিবারে বড় মেয়ে তোশিকোর বিবাহের প্রস্তাব দেন। এতে দুপক্ষই অত্যন্ত বিব্রত বোধ করে। কিন্তু পরিস্থিতি ও সুরক্ষার খাতিরে অত্যন্ত সাধারন ভাবে তোশিকো ও রাসবিহারীর চার হাত এক হয়ে যায়। এই কাহিনীতে আকস্মিকতা থাকলেও এর পরিণাম খুব একটা সুখকর হয়নি। রাসবিহারী বসু সংসার পাতলেন ঠিকই কিন্তু দেশমাতৃকার প্রতি আনুগত্য এতটুকুও কমলো না। এর মধ্যেও তিনি চালিয়ে নিয়ে গেলেন নানা বৈপ্লবিক কার্যকলাপ। ফলস্বরূপ তাঁদেরকে প্রায় সতের বার বাসা বদলাতে হয়। ইতিমধ্যে তাঁদের দুই সন্তানের জন্ম হয়। অন্ধকার, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আত্মগোপন করে থাকতে থাকতে অসহ্য শারীরিক ও মানসিক চাপে তোশিকো নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন এবং দুই সন্তানকে রেখে মাত্র আঠাশ বছর বয়সে পরলোকে পারি দেন। সম্পূর্ন একা হয়ে যান রাসবিহারী।
তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছোট হলেও তাতে রচিত হয়েছিল ইন্ডোজাপান সংস্কৃতির এক অদ্ভুত মেলবন্ধন। তোশিকোকে তিনি বাঙালি আদবকায়দা, রন্ধন প্রক্রিয়া, শাড়ি পড়া এমনকি রবীন্দ্র সংগীত পর্যন্ত শিখিয়েছিলেন। আসলে স্বদেশ থেকে দূরে থাকলেও তাঁর মন পড়েছিল ভারতেই। প্রতি মুহূর্তে তিনি বিদেশেই স্বদেশিয়ানা কে উদযাপিত করতে চাইতেন। স্ত্রী বিয়োগের পর তিনি সোমা পরিবারের ও তাঁর দুই সন্তানের সমস্ত দ্বায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। নাকামুরা বেকারীর দোতলায় প্রতিষ্ঠা করেন এক ইন্দোজাপান রেস্তোরাঁর “ইন্দো নো মোনো” বা ভারতীয় তোরণ। যা আজও সগর্বে স্বদেশপ্রেম ও দাম্পত্য প্রেমের অবিচ্ছেদ্য ধারাকে বয়ে নিয়ে চলেছে একই গতিতে। এখানেই রাসবিহারী বসু তাঁর বিখ্যাত রাইসু কারির স্বাদ আর নাম বদলে পরিবেশন করেন নাকামুরায়া কারি। স্বল্প সময়ের মধ্যেই তার জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। এমনকি এই রেস্তোরাঁ ছিলো জাপানের স্টক এক্সচেঞ্জের প্রথম ফুড কোম্পানী।
বলা বাহুল্য এখানে তিনি রেস্তোরাঁর আড়ালে গোপনে বিপ্লবী কার্য পরিচালনা করতেন। এখানে সংঘটিত হয়েছে অনেক গোপন বৈঠক। পরবর্তি কালে তিনিই ইন্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্স লীগ ও ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি গঠনের মত অসাধারণ কাজ করেন ও সুভাষ চন্দ্র বসু কে নেতাজি সম্বোধন করে তার দ্বায়িত্ব ভার অর্পণ করেন। বর্ধমানের সুবলদহ গ্রামে জন্মে, বিদেশ বিভূঁই থেকেও স্বদেশের প্রতি অসামান্য দ্বায়িত্ব পালন করে শ্রী রাসবিহারী বসু আজও প্রতিটা ভারতবাসীর মনে অমর হয়ে আছেন। যদিও স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। ১৯৪৫ সালে আমানুষিক পরিশ্রমে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে টোকিও শহরে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর স্ত্রীর পাশে তাঁকেও সমাধিস্থ করা হয়। ভারতের স্বাধীনতার সূর্য আর দেখা হয়নি তাঁর।
টোকিও শহরে প্রাণকেন্দ্রে আজও নাকামুরায়া কারি ও তার স্রষ্টার স্মৃতি স্বমহিমায় বিরাজ করছে। জাপানিরা আজও তাঁকে চেনেন “ইন্দো শিশি” বা ভারতীয় বীরপুরুষ হিসাবে। তিনি জাপানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ও অন্যান্য পুরস্কারেও ভূষিত হন। এখন হয়ত আমরা ভাবতে পারি একজন বাঙালির এই সব অসামান্য অবদানের বদলে স্বাধীন হয়ে আমরা তার কী প্রতিদান দিয়েছি? শুধু মাত্র একটা রাস্তার নামকরণ বা একটা মূর্তি স্থাপন করা নয়, প্রতিমুহূর্তে তাঁর মত দেশপ্রেমিকদের কার্যকে হৃদয়ঙ্গম ও অনুসরণ করে তার সঠিক পর্যালোচনা করলে তবুও হয়ত কিছুটা ঋণ শোধ হবে। স্বাধীন ভারতবাসী হিসাবে তাঁদের প্রতি এটুকু সম্মান তো আমরা দেখাতেই পারি।
আরও পড়ুন
প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক
উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন
রাতের ঘামের সমস্যা এবং এ সম্পর্কে আপনি কি করতে পারেন
উত্তরাপথঃ রাতের ঘামের সমস্যা শরীরের কুলিং সিস্টেমের একটি স্বাভাবিক অংশ, তাপ মুক্তি এবং সর্বোত্তম শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে।তবে রাতের ঘাম একটি সাধারণ সমস্যা যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে।এর অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্য ঘুম ব্যাহত হতে পারে, যার ফলে ক্লান্তি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। আপনি যদি রাতে অতিরিক্ত ঘাম অনুভব করেন, তাহলে তার অন্তর্নিহিত কারণটি চিহ্নিত করা এবং এটি মোকাবেলার জন্য কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রাতের ঘামের কিছু সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করা হল।মেনোপজ: যে কেউ, বয়স বা লিঙ্গ নির্বিশেষে, রাতের ঘাম অনুভব করতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন
সেলফির উচ্চ রেটিং কি আপনাকে আরওপাতলা হতে উৎসাহিত করছে ?
উত্তরাপথঃ সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে সেলফি তোলা এবং নিজেকে পাতলা হিসাবে দেখানোর মধ্যে একটি সম্পর্ক থাকতে পারে। যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক সেন্ট জন ইউনিভার্সিটির রুথ নাইট এবং ইউনিভার্সিটি অফ ইয়র্কের ক্যাথরিন প্রেস্টন সম্প্রতি PLOS ONE জার্নালে তাদের ফলাফল প্রকাশ করেছেন।সেখানে সেলফির উচ্চ রেটিং এবং আমাদের শরীরের গঠনের মধ্যে যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ায় সেলফি হল এক জনপ্রিয় ছবি দেওয়ার ধরন। যিনি সেলফি তোলেন তিনি ক্যামেরাকে তাদের শরীর থেকে দূরে রেখে নিজেই নিজের ছবি তোলে। আগের গবেষণায় বলা হয়েছে সেলফিগুলি দেখার ফলে ছবির বিষয়গুলি সম্পর্কে দর্শকদের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন
Free Gift in Politics: ভারতের নির্বাচন ও ফ্রি গিফট সংস্কৃতি
উত্তরাপথঃ ফ্রি গিফট (Free gift in politics)এর রাজনীতি সম্প্রতি ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করছে। বিনামূল্যে কোটি কোটি জনগণকে উপহার প্রদান যা রাজকোষের উপর অতিরিক্ত বোঝা ফেলবে এই সত্যটি জানা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক দলগুলি ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য ফ্রি গিফট (Free gift in politics) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনের দৌড়ে একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।এক সময় প্রয়াত তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতা বিনামূল্যে শাড়ি, প্রেসার কুকার, ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন সেট ইত্যাদির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের আগে যে বিনামূল্যের সংস্কৃতি শুরু করেছিলেন তা পরবর্তী কালে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি দ্রুত অনুসরণ করেছিল। এরপর ২০১৫ সালে আম আদমি পার্টি নেতৃত্ব দিল্লির ভোটারদের কাছে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, জল, বাস ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন