১০০ বছরের বেশি বাঁচার রহস্য: এক ছোট্ট ইতালিয়ান শহরের জীবনযাত্রায় লুকিয়ে

প্রীতি গুপ্তাঃ ইতালির দক্ষিণাঞ্চলের সিলেন্টো উপকূলবর্তী এক শান্ত শহর Acciaroli। এই শহরে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে—এখানে শতবর্ষী মানুষদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি! কেন এই শহরের মানুষ এতটা দীর্ঘজীবী? গত দশ বছর ধরে একদল বিজ্ঞানী খুঁজে চলেছেন এই প্রশ্নের উত্তর। এবং তারা বলছেন, উত্তরটা লুকিয়ে আছে এখানকার মানুষদের রক্ত, মস্তিষ্ক ও অলিভ অয়েলে

কী বলছে গবেষণা?

২০১৫ সালে শুরু হয়েছিল Cilento Initiative on Aging Outcomes (CIAO) নামের দশ বছর ধরে চলা একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা, যেখানে বিশ্লেষণ করা হয়েছে কীভাবে ইতালির এক বিশেষ অঞ্চলের এত মানুষ দীর্ঘ জীবন কাটায় । এক্ষেত্রে গবেষকরা Acciaroli-তে মিলিত হয়ে  শতবর্ষী বাসিন্দাদের জীবনধারা, খাদ্যাভ্যাস এবং জেনেটিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেছেন।

গবেষণার প্রধান ইতালীয় বিশেষজ্ঞ ডা. সালভাতোরে ডি সোমা বলছেন, “এই এলাকার শতবর্ষীরা শুধু দীর্ঘজীবী নন, তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে চমৎকারভাবে সুস্থ।”তাদের মধ্যে অ্যান্টি-অ্যাজিকিং—অর্থাৎ বহু ধরনের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা—দেখা যায়। এমনকি, তাদের জেনেটিক উপাদান, জৈবপ্রযুক্তি ও জীবনধারার মধ্যে রয়েছে এমন কিছু গভীর সমীকরণ, যা অন্যত্র পাওয়া যায় না।”

রহস্যের মূল চাবিকাঠি – খাদ্যাভ্যাস জীবনধারা

. ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য (Mediterranean Diet)

এই অঞ্চলের ৯০% মানুষই মেনে চলেন ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্যাভ্যাস—যার মধ্যে রয়েছে প্রচুর শাকসবজি, ফলমূল, বাদাম, লেগুম, সম্পূর্ণ শস্য, এবং অলিভ অয়েল। লাল মাংস খুবই কম পরিমাণে খাওয়া হয় এই অঞ্চলে।
ডা. ডি সোমা বলেন, “ভূমধ্যসাগরীয় ডায়েট কোনো ডায়েট প্ল্যান নয়, এটা এক জীবনের ধারা।”

মাত্র ৬ দিনের জন্যও এই খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন করলে শরীরে উপকারী মেটাবোলাইট বাড়ে, যা টাইপ ২ ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।

. অলিভ অয়েলের গুণাগুণ

সিলেন্টোর নিজস্ব অলিভ অয়েলে থাকে কম পরিমাণ ক্ষতিকর ফ্যাটি অ্যাসিড এবং এমন যৌগ, যা হৃদরোগ ও মস্তিষ্কের ক্ষয় প্রতিরোধে সহায়ক।

. সক্রিয় সামাজিক শারীরিক জীবন

এখানকার শতবর্ষীরা প্রতিদিন হাঁটাহাঁটি করেন, বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান। তাদের মস্তিষ্ক স্থির, আবেগ নিয়ন্ত্রিত, এবং তারা জীবনের প্রতি দায়িত্বশীল মনোভাব পোষণ করেন।

জিন এবং কোষের গভীরে লুকিয়ে থাকা রহস্য

গবেষকরা বলছেন, এই দীর্ঘজীবনের পেছনে জেনেটিক ও এপিজেনেটিক (gene expression নিয়ন্ত্রণকারী রাসায়নিক চিহ্ন) কারণও রয়েছে। শতবর্ষীদের শরীরে এমন কোষ-উত্তর প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে যা বয়ঃজনিত রোগ যেমন Alzheimer’s বা Parkinson’s প্রতিরোধ করে।

তাদের রক্তের রহস্য কী বলে?

গবেষণায় দেখা গেছে, শতবর্ষীদের রক্তে এমন উপাদান রয়েছে যা তাদের বয়স অনুপাতে অনেক বেশি তরুণ রাখে। গড়ে তারা জৈবিকভাবে তাদের প্রকৃত বয়সের চেয়ে ৮.বছর কম বয়স্ক দেখায়!

তবে আশ্চর্যের বিষয়, তাদের দেহে প্রদাহজনিত (inflammatory) উপাদান বাড়লেও, পাশাপাশি আছে উচ্চমাত্রায় প্রদাহ-বিরোধী উপাদান, যা তাদের কোষ ও টিস্যুকে রক্ষা করে।

রক্ত সঞ্চালনেও বিস্ময়

তাদের দেহে রক্ত সঞ্চালন এতটাই ভালো যে, ৩০ বছরের কম বয়সীদের সঙ্গেও তুলনায় তারা এগিয়ে। Bio-ADM নামক একটি হরমোনের মাত্রা কম থাকায়, তাদের রক্তনালীর গঠন ভালো থাকে। PAM নামের এক উৎসাহদায়ক এনজাইমের উপস্থিতিও তাদের রক্ত প্রবাহ ও মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা উন্নত করে।

আসলে এই ছোট্ট গ্রামটির রহস্য হচ্ছে আদর্শ জীবনযাপন ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস। যদিও এই বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন, তবে আধুনিক বিজ্ঞান দেখাচ্ছে যে, জীবনধারাকে একটু পরিবর্তন করলেই দীর্ঘ ও স্বাস্থ্যবতী জীবন পাওয়া আসাধ্য নয়।

এই সহজ উপায়ে দীর্ঘজীবন?

অস্ট্রেলিয়ার ডা. রবার্ট হেটজেল একটি ছোট পরীক্ষায় ২৩ জনকে দিয়ে করিয়েছেন পাঁচটি নিয়ম:

১. ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য খাওয়া
২. প্রতিদিন ৬০ মিনিট ব্যায়াম
৩. ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম
৪. মস্তিষ্ক চর্চা করা (পাজল, সঙ্গীত, শিল্প)
৫. সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা

দেখা গেছে, বেশ কয়েকজন রোগী ওজন কমানো সহ মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটিয়েছেন।

শেষ কথা

এই গবেষণাগুলি একটাই বিষয় প্রমাণ করছে—লম্বা ও সুস্থ জীবন শুধু জিনগত সৌভাগ্যের ওপর নির্ভর করে না। এটি আসে সঠিক খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম, ইতিবাচক মানসিকতা, সামাজিক বন্ধন প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে থাকার মধ্য দিয়ে

আর তাই, কি ভাবছেন? আজি  নিজের জীবনেও  কিছু ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনুন ও এক স্বাস্থ্যকর জীবন উপভোগ করুন।তাহলে দেখছেনতো , এই ছোট্ট গ্রামটি থেকেও আমাদের জন্য শেখার অনেক কিছু আছে।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Bandna Festival: ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পাঁচ দিন বাঁদনার আমেজে মশগুল থাকে

বলরাম মাহাতোঃ চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী কার্তিক অমাবস্যার আগের দিন থেকে মোট পাঁচ দিন ব্যাপী বাঁদনার(Bandna Festival) আমেজে মশগুল থাকে ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অবশ্য, পরবের শুভ সূচনা হয় তারও কয়েকদিন আগে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক শাসন ব্যবস্থার চূড়ামণি হিসাবে গাঁয়ের মাহাতো, লায়া, দেহরি কিম্বা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি নির্ধারণ করেন- ৩, ৫, ৭ বা ৯ ক’দিন ধরে গবাদি পশুর শিং-এ তেল মাখাবে গৃহস্বামী! রুখামাটির দেশের লোকেরা কোনোকালেই মাছের তেলে মাছ ভাজা তত্ত্বের অনুসারী নয়। তাই তারা গোরুর শিং-এ অন্য তেলের পরিবর্তে কচড়া তেল মাখানোয় বিশ্বাসী। কারণ কচড়া তেল প্রস্তুত করতে গোধনকে খাটাতে হয় না যে! কচড়া তেলের অপ্রতুলতার কারণে বর্তমানে সরষের তেল ব্যবহৃত হলেও, কচড়া তেলের ধারণাটি যে কৃষিজীবী মানুষের গবাদি পশুর প্রতি প্রেমের দ্যোতক, তা বলাই বাহুল্য! এভাবেই রাঢ বঙ্গে গোবর নিকানো উঠোনে হাজির হয়- ঘাওয়া, অমাবস্যা, গরইয়া, বুঢ়ি বাঁদনা ও গুঁড়ি বাঁদনার উৎসবমুখর দিনগুলি। পঞ্চদিবসে তেল দেওয়া, গঠ পূজা, কাঁচি দুয়ারি, জাগান, গহাইল পূজা, চুমান, চউক পুরা, নিমছান, গোরু খুঁটা, কাঁটা কাঢ়া প্রভৃতি ১১টি প্রধান পর্ব সহ মোট ১৬টি লোকাচারের মাধ্যমে উদযাপিত হয় বাঁদনা পরব(Bandna Festival )। .....বিস্তারিত পড়ুন

Free Gift in Politics: ভারতের নির্বাচন ও ফ্রি গিফট সংস্কৃতি

উত্তরাপথঃ ফ্রি গিফট (Free gift in politics)এর রাজনীতি সম্প্রতি ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করছে। বিনামূল্যে কোটি কোটি জনগণকে উপহার প্রদান যা রাজকোষের উপর অতিরিক্ত বোঝা ফেলবে এই সত্যটি জানা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক দলগুলি ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য ফ্রি গিফট (Free gift in politics) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনের দৌড়ে একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।এক সময় প্রয়াত তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতা বিনামূল্যে শাড়ি, প্রেসার কুকার, ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন সেট ইত্যাদির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের আগে যে বিনামূল্যের সংস্কৃতি শুরু করেছিলেন তা পরবর্তী কালে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি দ্রুত অনুসরণ করেছিল। এরপর ২০১৫ সালে আম আদমি পার্টি নেতৃত্ব দিল্লির ভোটারদের কাছে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, জল, বাস ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

Karar Oi Lauh Kapat: কাজী নজরুলের এই গানকে ঘিরে  বিতর্কে এ আর রহমান

উত্তরাপথঃ বিতর্কে 'পিপ্পা' ছবির সঙ্গীত পরিচালক অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান।সম্প্রতি কবি কাজী নজরুল ইসলামের পরিবার একটি হিন্দি ছবিতে কবির জনপ্রিয় গান 'করার ঐ লৌহ কাপাত...' (Karar Oi Lauh Kapat )।কিন্তু এ আর রহমানের সঙ্গীত পরিচালনায় ওই গানটি যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে আপত্তি জানিয়েছে নজরুল পরিবার।বিতর্কের পর যে চুক্তির আওতায় ওই গানটি ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে তা প্রকাশ্যে আনার দাবি তুলেছে কবির পরিবার।'পিপ্পা' শিরোনামের হিন্দি চলচ্চিত্রটি যেখানে (Karar Oi Lauh Kapat )গানটি ব্যবহার করা হয়েছে তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া একজন ভারতীয় সেনা সৈনিককে কেন্দ্র করে একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। ছবির সঙ্গীত পরিচালক অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান। গানের কথা ঠিক রেখেও সুর পাল্টানোর অভিযোগে ভারত ও বাংলাদেশে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।কবির পরিবারের অভিযোগ, গানটি ব্যবহারের অনুমতি দিলেও সুর পরিবর্তনের অনুমতি দেওয়া হয়নি।পরিবারের সদস্যরাও ছবিটি থেকে গানটি বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Roop Kishor Soni: একটি আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য তুলে ধরেছেন

উত্তরাপথঃ রাজস্থান মানেই ওজনদার রূপার গহনা ,আর তার উপর কারুকাজ। প্রচলিত এই ধারনা ভেঙ্গে আজ রূপোর গহনাকে আধুনিকতার সাথে শিল্পের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন যে ব্যক্তি তিনি হলেন রূপ কিশোরী সোনী(Roop Kishor Soni)।তিনি ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে তার অসাধারণ শিল্প কর্মের জন্য জাতীয় পুরুস্কার পান। রাজস্থানের জয়সলমেরের শহরের এই শিল্পী ৩.৮ গ্রাম ওজনের ০.৯ সেমি চওড়া রৌপ্য আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য খোদাই করেছেন।এই ছোট রূপার আংটিতে শিল্পী তাজমহল, সিডনি অপেরা হাউস, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, চীনের গ্রেট ওয়াল, আইফেল টাওয়ার, বিগ বেন, পিসার হেলানো টাওয়ার এবং মিশরীয় পিরামিডের চিত্র এক সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন।এছাড়াও তিনি আরও দুটি পৃথক ডিজাইনের অত্যাশ্চর্য আংটি  তৈরি করেছেন।৮.৬ গ্রাম ওজনের একটি রিংয়ে তিনি সূর্যাস্তের সময় ভারতীয় উট সাফারি সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভারতীয় বিশেষত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন,এবং অন্যটিতে বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবী ছবি এবং মন্দির খোদাই করেছিলেন। শিল্পী বলেছেন যে তিনি তার বাবার কাছ থেকে তার শৈল্পিক দক্ষতা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সেই সাথে তিনি বলেন "আমার বাবাও একজন জাতীয় পুরুস্কার প্রাপ্ত শিল্পী ছিলেন। তিনি আমাকে শিল্পের এই দক্ষতা শিখিয়েছিলেন কারণ তিনি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে শিল্পের ফর্মটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।" .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top