১৯৮৫ সালের জেএএল বিমানের দুর্ঘটনা: ৪০ বছর পরেও অশ্রুজলে স্মরণ

উত্তরাপথঃ আকাশপথে ভরসা রেখেই মানুষ যাত্রা করে—দ্রুত পৌঁছানোর আশায়, নতুন স্বপ্নের খোঁজে। কিন্তু ১৯৮৫ সালের ১২ আগস্টের সেই ভয়াল বিকেল জাপানের আকাশকে করে দিয়েছিল রক্তিম। জাপান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ১২৩, টোকিও থেকে ওসাকার পথে উড়েছিল; কিন্তু ৪৫ মিনিট পরই গুনমা প্রিফেকচারের পাহাড়ি অরণ্যে মিলে বিমানটির ভগ্নাবশেষ । ৫২৪ জন যাত্রীর মধ্যে প্রাণ বাঁচাতে পেরেছিলেন মাত্র চারজন। এ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে একক বিমান দুর্ঘটনায় সর্বাধিক প্রাণহানির ঘটনা।

চল্লিশ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু শোক কি এত সহজে ফিকে হয়? আজও পরিবারের সদস্যরা হাতে ফুল নিয়ে ভেজা পাহাড়ি পথ বেয়ে ওঠেন ওসুতাকা রিজের সেই শোকস্তম্ভে। কেউ খুঁজে ফেরেন সন্তানের হাসি, কেউ ভাইয়ের মুখ, কেউ বা হারানো স্বামী-স্ত্রীর ছায়া। ৭৮ বছরের কুনিকো মিয়াজিমা তাঁর ৯ বছরের ছেলেকে হারিয়েছিলেন সেই রাতে। তিনি বলেন, জায়গা শুধু শোকের নয়, জীবনের গুরুত্ব বোঝানোর এক জায়গা।

শোকস্তম্ভের সামনে নীরব প্রার্থনায় দাঁড়িয়ে থাকে শত শত মানুষ। আকাশে রঙিন বেলুন উড়ে যায়—যেন হারানো আত্মাদের মুক্তির বার্তা। বিকেল ৬টা ৫৬ মিনিটে, দুর্ঘটনার সঠিক সময়ে, বাজে নীরবতার ঘণ্টা।

সেদিন বিমানে ছিলেন জনপ্রিয় গায়ক কিউ সাকামোতোও, যার গান সুকিয়াকি আজও প্রজন্মের পর প্রজন্মকে স্পর্শ করে। কিন্তু তাঁর সুরও থেমে যায় অকালেই, অসংখ্য স্বপ্নের মতো।

সরকারি তদন্ত জানায়—ভুল মেরামতই সেই মর্মান্তিক পরিণতির কারণ। বিমানের লেজের চাপরোধী অংশটি ভেঙে গিয়ে পুরো হাইড্রলিক সিস্টেম অকেজো হয়ে পড়ে। এক মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণ হারায় বিশাল জাহাজটি, আর শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ে পাহাড়ি জঙ্গলে।

আজও পরিবারগুলো পাহাড়ে ওঠে, যদিও অনেকের আজ বয়সের ভারে পাহাড়ে উঠা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। তবুও তাঁরা থেমে যান না, কারণ এই স্মরণই তাঁদের দায়িত্ব—যেন ভবিষ্যতে আর কোনো পরিবারকে এমন দুঃখের অন্ধকারে ডুবে যেতে না হয়।

জেএএল এখন নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। নতুন কর্মীদের প্রশিক্ষণের সময় তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় দুর্ঘটনাস্থলে, দেখানো হয় ধ্বংসাবশেষ আর যাত্রীদের লেখা শেষ চিঠি। যেন তারা বুঝতে পারে, প্রতিটি দায়িত্বের পেছনে লুকিয়ে আছে অসংখ্য জীবনের ভার।

জাপানের এই পাহাড় আজ শুধু শোকের স্থান নয়, বরং সতর্কতার প্রতীক। সময় হয়তো অনেক ক্ষত ঢেকে দেয়, কিন্তু মায়ের চোখের জল শুকায় না, ভাইয়ের শূন্যতা ভরে ওঠে না। আর হয়তো সেজন্যই, প্রতি বছর ১২ আগস্টের  এই পাহাড়ি নীরবতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আকাশপথে শুধু যাত্রী নয়, স্বপ্নও উড়ে চলে।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Free Gift in Politics: ভারতের নির্বাচন ও ফ্রি গিফট সংস্কৃতি

উত্তরাপথঃ ফ্রি গিফট (Free gift in politics)এর রাজনীতি সম্প্রতি ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করছে। বিনামূল্যে কোটি কোটি জনগণকে উপহার প্রদান যা রাজকোষের উপর অতিরিক্ত বোঝা ফেলবে এই সত্যটি জানা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক দলগুলি ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য ফ্রি গিফট (Free gift in politics) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনের দৌড়ে একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।এক সময় প্রয়াত তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতা বিনামূল্যে শাড়ি, প্রেসার কুকার, ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন সেট ইত্যাদির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের আগে যে বিনামূল্যের সংস্কৃতি শুরু করেছিলেন তা পরবর্তী কালে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি দ্রুত অনুসরণ করেছিল। এরপর ২০১৫ সালে আম আদমি পার্টি নেতৃত্ব দিল্লির ভোটারদের কাছে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, জল, বাস ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

সেলফির উচ্চ রেটিং কি আপনাকে আরওপাতলা হতে উৎসাহিত করছে ?

উত্তরাপথঃ সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে সেলফি তোলা এবং নিজেকে পাতলা হিসাবে দেখানোর মধ্যে একটি সম্পর্ক থাকতে পারে। যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক সেন্ট জন ইউনিভার্সিটির রুথ নাইট এবং ইউনিভার্সিটি অফ ইয়র্কের ক্যাথরিন প্রেস্টন সম্প্রতি PLOS ONE জার্নালে তাদের ফলাফল প্রকাশ করেছেন।সেখানে সেলফির উচ্চ রেটিং এবং আমাদের শরীরের গঠনের মধ্যে যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।    বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ায় সেলফি হল এক জনপ্রিয় ছবি দেওয়ার ধরন। যিনি সেলফি তোলেন তিনি ক্যামেরাকে তাদের শরীর থেকে দূরে রেখে নিজেই নিজের ছবি তোলে। আগের গবেষণায় বলা হয়েছে সেলফিগুলি দেখার ফলে ছবির বিষয়গুলি সম্পর্কে দর্শকদের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন

দীপাবলির সময় কেন পটকা ফোটানো নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা যায় না ?

উত্তরাপথঃ দীপাবলির পরের দিন, যখন কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (CPCB) শহরের বায়ু মানের সূচকের তালিকা প্রকাশ করে,তখন  দেখা যায় রাজধানী দিল্লি বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দূষিত শহরের প্রথমেই রয়েছে। CPCB-এর মতে, ১২ নভেম্বর বিকেল ৪ টায় দিল্লির বায়ু মানের সূচক ছিল ২১৮ যা ভোরের দিকে বেড়ে ৪০৭ এ পৌঁছায় । ৪০০ – ৫০০ AQI  এর স্তর সুস্থ ব্যক্তিদের প্রভাবিত করে। দীপাবলির সারা রাত, লোকেরা পটকা ফাটিয়ে দীপাবলি উদযাপন করে। ১৩ নভেম্বর বিকেল ৪ টায় কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ আবার তথ্য প্রকাশ করে এই তালিকায়, দিল্লির গড় বায়ু মানের সূচক ছিল ৩৫৮ যা 'খুব খারাপ' বিভাগে পড়ে।   বায়ু দূষণের এই পরিস্থিতি শুধু দিল্লিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না।  নয়ডার বায়ু মানের সূচক ১৮৯ থেকে ৩৬৩ এ এবং রোহতক, হরিয়ানার ১৩৭ থেকে বেড়ে ৩৮৩ হয়েছে। দীপাবলির দুই দিন দিল্লি ,নয়ডা  ,কলকাতা, মুম্বাই সহ দেশের অন্যান্য শহরেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। এই দিনগুলিতে মানুষ বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে বাধ্য হয়েছে। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জাতীয় রাজধানী দিল্লি এবং নয়ডায় সবুজ পটকা ছাড়া যে কোনও ধরণের আতশবাজি ফাটান সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ। আদালত সবুজ পটকা পোড়ানোর সময়ও নির্ধারণ করে দিয়েছে রাত ৮টা থেকে ১০টা। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশের মানে কী?  আদালতের এই আদেশ কি এখন প্রত্যাহার করা উচিত?  পুলিশ কেন এই আদেশ কার্যকর করতে পারছে না?  এর জন্য কি পুলিশ দায়ী নাকি সরকারের উদাসীনতা রয়েছে এর পেছনে? .....বিস্তারিত পড়ুন

ওজন হ্রাস (weight loss) মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে

উত্তরাপথঃ এপ্রিলে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, শাকসবজি, সামুদ্রিক খাবার এবং গোটা শস্য সমৃদ্ধ একটি ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য খাওয়া - এমনকি শুধুমাত্র খাদ্যের নির্দেশিকা অনুসরণ করে   ওজন হ্রাস (weight loss)মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে বলে মনে করা হয়।সাম্প্রতি ডিউক ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত, একটি  গবেষণায় দেখা গেছে যে ওজন হ্রাস মস্তিষ্কে বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ৯ মাস পর্যন্ত ধীর করে (aging process) দিতে পারে। গবেষণায় ৬০ থেকে ৭৮ বছর বয়সের মধ্যে ৪৭ জন অংশগ্রহণকারীকে জড়িত করা হয়েছিল, যাদের প্রত্যেকেরই ওজন বেশি বা স্থূল ছিল এবং তাদের অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যগ্রহণ  ছিল। তাদের এলোমেলোভাবে একটি ক্যালোরি-সীমাবদ্ধ গ্রুপ বা একটি নিয়ন্ত্রণ গ্রুপে বরাদ্দ করা হয়েছিল।ক্যালোরি-সীমাবদ্ধতা গোষ্ঠীর সদস্যদের একটি খাদ্য পরিকল্পনা অনুসরণ করে, যার লক্ষ্য ছিল তাদের আনুমানিক প্রয়োজনের চেয়ে ১০ – ১৫% কম ক্যালোরি গ্রহণ করা। অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রণ গ্রুপ তাদের খাদ্য পরিবর্তন করেনি .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top