

উত্তরাপথঃ বিজ্ঞান, ভাষা আর ইতিহাসের এক অসাধারণ মেলবন্ধন ঘটেছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়। পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্মীয় গ্রন্থগুলোর অন্যতম, হিব্রু বাইবেলের লেখক কে ছিলেন—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একদল গবেষক নিয়েছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) সাহায্য।
এই বহুবিধ বিষয়ে দক্ষ গবেষকদলের মধ্যে রয়েছেন ডিউক ইউনিভার্সিটির গণিতবিদ শিরা ফেইগেনবাউম-গোলোভিন। তিনি ও তাঁর আন্তর্জাতিক সহকর্মীরা AI, পরিসংখ্যানগত মডেলিং এবং ভাষাবিজ্ঞানের সমন্বয়ে শুরু করেন এই জটিল অনুসন্ধান।
বাইবেল বিশ্লেষণে AI: কল্পনার চেয়েও বেশি
প্রথমে তাঁরা হিব্রু বাইবেলের প্রথম নয়টি বই (Enneateuch) বিশ্লেষণ করে তিনটি ভিন্ন লেখন শৈলী বা “স্ক্রাইবাল ট্র্যাডিশন” চিহ্নিত করেন। তারপর সেই শৈলীগুলোর ভিত্তিতে বাকি অধ্যায়গুলোর সম্ভাব্য লেখক নির্ধারণের জন্য AI মডেল ব্যবহার করেন। বিশেষ আকর্ষণীয় বিষয় হলো, এই মডেল তার সিদ্ধান্তের যৌক্তিক ব্যাখ্যাও দিতে পারে।
এক গণিতবিদের যাত্রা: পাত্র থেকে পবিত্র গ্রন্থে
২০১০ সালে, ফেইগেনবাউম-গোলোভিন ইসরায়েলের হাইফা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ ইসরায়েল ফিন্কেলস্টাইনের সঙ্গে কাজ শুরু করেন।তারা প্রত্নতত্ত্বে পটারি টুকরোতে খোদাই করা অক্ষরগুলো বিশ্লেষণ করে তাদের শৈলী, আকার ও বৈচিত্র্য বিবেচনা করেন। তাঁদের ধারণা ছিল, এই নিয়মিত বিশ্লেষণ পুরানো ধর্মগ্রন্থের লেখক খুঁজে বেরনোর কাজে সহায়ক হতে পারে।


গবেষক দল এবং গবেষণার গভীরতা
এই বৃহৎ গবেষণাদলে ছিলেন প্রত্নতত্ত্ববিদ, ধর্মতত্ত্ববিদ, পদার্থবিদ, গণিতবিদ ও কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা—যেমন আলন কিপনিস, অ্যাক্সেল বিউলার, এলি পিয়াসেতজকি ও থমাস রোমার।
তাঁরা হিব্রু বাইবেলের তিনটি মূল ভাগ বিশ্লেষণ করেন:
- দ্বিতীয় বিবরণ (Deuteronomy)
- ইতিহাসভিত্তিক গ্রন্থ (Joshua to Kings)
- পুরোহিত লেখা (Priestly texts in Torah)
বিশ্লেষণে দেখা যায়, দ্বিতীয় বিবরণ ও ইতিহাসভিত্তিক গ্রন্থের ভাষা একে অপরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, কিন্তু পুরোহিত লেখার ভাষা ভিন্ন। এই ফলাফল ইতিমধ্যেই বাইবেল বিশেষজ্ঞদের ধারণার সঙ্গে মিলে যায়।
একেকটি সাধারণ শব্দেও রয়েছে ভিন্নতা!
রোমার বলেন, “আমরা দেখতে পাই প্রতিটি লেখক গোষ্ঠীর শব্দ ব্যবহারে রয়েছে ভিন্নতা—even ‘না’, ‘যে’, ‘রাজা’—এসব সাধারণ শব্দেও।” গবেষণায় ব্যবহৃত AI মডেল ৫০টি পরিচিত অধ্যায় থেকে লেখক শনাক্ত করতে পারে সুনির্দিষ্ট সূত্র অনুযায়ী।
পরবর্তী ধাপে, তাঁরা বিতর্কিত অধ্যায় বিশ্লেষণ করেন, যেগুলোর লেখক সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা দ্বিধান্বিত। AI সেগুলোও যথার্থভাবে নির্ধারণ করতে পারে, এবং কারণ ব্যাখ্যা করে দেয় কোন শব্দ বা বাক্যাংশের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত এসেছে।
সীমিত তথ্যেও সফলতা
চ্যালেঞ্জ ছিল অনেক—বাইবেলের অনেক অংশই বারবার সম্পাদনা হয়েছে। আসল লেখার ধরন খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল, এবং প্রাপ্ত তথ্যও ছিল সীমিত। তাই প্রচলিত মেশিন লার্নিং নয়, তাঁরা ব্যবহার করেছেন এক নতুন পরিসংখ্যানগত পদ্ধতি, যা কম তথ্যেও কার্যকর।
আকর্ষণীয় আবিষ্কার
‘সামুয়েল’ বইয়ের দুই অংশে একই ঘটনা বলা হলেও AI মডেল দেখায়, ১ সামুয়েলের ভাষা কোনও বিদ্যমান লেখনশৈলীর সঙ্গে মিল না থাকলেও, ২ সামুয়েল মিলে যায় Deuteronomistic History-এর লেখন শৈলীর সঙ্গে।
ভবিষ্যতের দিগন্ত
এই গবেষণা শুধু বাইবেলেই সীমাবদ্ধ নয়। ফেইগেনবাউম-গোলোভিন বলেন, “যদি কেউ আব্রাহাম লিঙ্কনের নামে থাকা একটি প্রাচীন দলিল যাচাই করতে চান, তাহলে এই পদ্ধতি বলে দিতে পারবে সেটা আসল না নকল।” তাঁরা এখন এই প্রযুক্তি ডেড সি স্ক্রল বা অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থ বিশ্লেষণেও কাজে লাগাতে আগ্রহী।
বিজ্ঞান আর মানববিদ্যার যুগলবন্দী
ফেইগেনবাউম-গোলোভিন বলেন, “এই গবেষণা দেখায় যে বিজ্ঞান আর মানববিদ্যার এক অভিনব সহাবস্থান সম্ভব। আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি এমন এক দলে কাজ করতে পেরে যারা সত্যি নতুন কিছু আবিষ্কারের জন্য প্রচলিত সীমা অতিক্রম করে।”
বাইবেলের লেখক নির্ধারণে এই AI ভিত্তিক গবেষণা শুধু ধর্মীয় ইতিহাসই নয়, প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ প্রয়োগেরও এক চমৎকার উদাহরণ। এটা দেখিয়ে দিয়েছে, মানুষের ভাষা, বিশ্বাস, এবং ইতিহাসের গভীর রহস্য উন্মোচনে এখন AI-ও হতে পারে এক নির্ভরযোগ্য সহযোগী।
সূত্রঃ Critical biblical studies via word frequency analysis: Unveiling text authorship” by Shira Faigenbaum-Golovin, Alon Kipnis, Axel Bühler, Eli Piasetzky, Thomas Römer and Israel Finkelstein, 3 June 2025, PLOS ONE.
DOI: 10.1371/journal.pone.0322905
আরও পড়ুন
বিশ্বকাপ ২০২৩: পাকিস্তানকে হারিয়ে Afghanistan এ ঈদের মতো পরিস্থিতি
আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০২৩-এর ২২ তম ম্যাচে আফগানিস্তান পাকিস্তানকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছে। সেই ম্যাচে পাকিস্তানকে ৮ উইকেটে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে আফগানিস্তান। এই প্রথম ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে হারাল আফগানিস্তান আর এই পাকিস্তানকে হারিয়ে আফগানিস্থানে(Afghanistan)এখন ঈদের মতো পরিস্থিতি।এক আফগানিস্থানি সমর্থকের মতে এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এবং নিজেদের মত করে তারা তাদের এই খুশী উদযাপন করেছেন। এক্স হ্যান্ডেলে এক সমর্থকের মতে, সেদিন উদযাপন ছিল, পার্টি ছিল। এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এছাড়াও, এটি ছিল ২০২৩ বিশ্বকাপের তৃতীয় বড় আপসেট । টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় বাবর আজমের দল। প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান দল ২৮২ রান করে। জবাবে আফগানিস্তান দল ২৮৩ রান তাড়া করে ৪৯ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্য অর্জন করে। এই ম্যাচে হারের পর বেশ ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল অধিনায়ক বাবর আজমকে। ম্যাচ-পরবর্তী উপস্থাপনার সময়, তিনি দলের ত্রুটিগুলি তালিকাভুক্ত করেছিলেন এবং পরাজয়ের জন্য নিজেদের দায়ী করেছিলেন। .....বিস্তারিত পড়ুন
Electoral Bond এর গোপনীয়তা সরিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে, জানাতে হবে প্রাপ্ত অনুদানের পরিমাণ
উত্তরাপথঃ বুধবার, নির্বাচনী বন্ড (Electoral Bond)প্রকল্পের আইনি বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের শুনানি হয়। শীর্ষ আদালত তার মন্তব্যে বলেছে, 'নির্বাচনী বন্ডগুলি রাজনৈতিক দলগুলিকে বেনামী অর্থ প্রদান করে, কারণ তাদের কেনাকাটা সম্পর্কিত রেকর্ডগুলি স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কাছে উপলব্ধ যা শুধুমাত্র তদন্তকারী সংস্থাগুলি অ্যাক্সেস করতে পারে৷ এর আগে নির্বাচনী বন্ড’ (Electoral Bond) সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টে (Supreme Court) কেন্দ্র দাবি করেছিল, রাজনৈতিক দলগুলির আয়ের উৎস জানার অধিকার নেই জনতার।এবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তৎপর হল নির্বাচন কমিশন (Election Commission of India)।বুধবার বিকেল ৫টার মধ্যে যাবতীয় হিসেব জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কমিশনের তরফে।নির্বাচনী বন্ডের (Electoral Bond)মামলায় কেন্দ্রের আর্জি সত্বেও সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক দলগুলিকে আয়ের উৎস জানাতে বলেছিল। আদলত নির্দেশ দিয়েছিল, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক দল কত অনুদান মিলেছে, সেই তথ্য বন্ধ খামে জানাতে হবে।এর আগেও নির্বাচনী বন্ডের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একাধিক মামলা হয়েছে শীর্ষ আদালতে। মামলাকারীরা অভিযোগ করেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলি এই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ বিদেশ থেকে পেতে পারে এর ফলে গণতন্ত্র ধ্বংস হবে। যদিও কোনও রাজনৈতিক দলই এই দাবি মানতে চায়নি। ৩ অক্টোবর মামলার শুনানিতে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সব তথ্য দিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এই রায়ের পরেই তৎপর হল কমিশন। .....বিস্তারিত পড়ুন
রাতের ঘামের সমস্যা এবং এ সম্পর্কে আপনি কি করতে পারেন
উত্তরাপথঃ রাতের ঘামের সমস্যা শরীরের কুলিং সিস্টেমের একটি স্বাভাবিক অংশ, তাপ মুক্তি এবং সর্বোত্তম শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে।তবে রাতের ঘাম একটি সাধারণ সমস্যা যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে।এর অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্য ঘুম ব্যাহত হতে পারে, যার ফলে ক্লান্তি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। আপনি যদি রাতে অতিরিক্ত ঘাম অনুভব করেন, তাহলে তার অন্তর্নিহিত কারণটি চিহ্নিত করা এবং এটি মোকাবেলার জন্য কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রাতের ঘামের কিছু সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করা হল।মেনোপজ: যে কেউ, বয়স বা লিঙ্গ নির্বিশেষে, রাতের ঘাম অনুভব করতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন
দীপাবলির সময় কেন পটকা ফোটানো নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা যায় না ?
উত্তরাপথঃ দীপাবলির পরের দিন, যখন কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (CPCB) শহরের বায়ু মানের সূচকের তালিকা প্রকাশ করে,তখন দেখা যায় রাজধানী দিল্লি বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দূষিত শহরের প্রথমেই রয়েছে। CPCB-এর মতে, ১২ নভেম্বর বিকেল ৪ টায় দিল্লির বায়ু মানের সূচক ছিল ২১৮ যা ভোরের দিকে বেড়ে ৪০৭ এ পৌঁছায় । ৪০০ – ৫০০ AQI এর স্তর সুস্থ ব্যক্তিদের প্রভাবিত করে। দীপাবলির সারা রাত, লোকেরা পটকা ফাটিয়ে দীপাবলি উদযাপন করে। ১৩ নভেম্বর বিকেল ৪ টায় কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ আবার তথ্য প্রকাশ করে এই তালিকায়, দিল্লির গড় বায়ু মানের সূচক ছিল ৩৫৮ যা 'খুব খারাপ' বিভাগে পড়ে। বায়ু দূষণের এই পরিস্থিতি শুধু দিল্লিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। নয়ডার বায়ু মানের সূচক ১৮৯ থেকে ৩৬৩ এ এবং রোহতক, হরিয়ানার ১৩৭ থেকে বেড়ে ৩৮৩ হয়েছে। দীপাবলির দুই দিন দিল্লি ,নয়ডা ,কলকাতা, মুম্বাই সহ দেশের অন্যান্য শহরেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। এই দিনগুলিতে মানুষ বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে বাধ্য হয়েছে। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জাতীয় রাজধানী দিল্লি এবং নয়ডায় সবুজ পটকা ছাড়া যে কোনও ধরণের আতশবাজি ফাটান সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ। আদালত সবুজ পটকা পোড়ানোর সময়ও নির্ধারণ করে দিয়েছে রাত ৮টা থেকে ১০টা। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশের মানে কী? আদালতের এই আদেশ কি এখন প্রত্যাহার করা উচিত? পুলিশ কেন এই আদেশ কার্যকর করতে পারছে না? এর জন্য কি পুলিশ দায়ী নাকি সরকারের উদাসীনতা রয়েছে এর পেছনে? .....বিস্তারিত পড়ুন