মীনা উপজাতি সম্প্রদায়ের উত্থানের কাহিনী

গার্গী আগরওয়ালা মাহাতো

একটি সম্প্রদায় কিভাবে অপরাধী উপজাতি থেকে ভারতের সবচেয়ে শিক্ষিত উপজাতিতে পরিণত হল তা যে কোন হিন্দি সিনেমার ঘটনাকে হার মানাবে। মীনা ভারতের প্রাচীনতম উপজাতিগুলির মধ্যে একটি। প্রায় সমস্ত অঞ্চলে বসবাস করে তবে প্রধানত জয়পুর, আলওয়ার, দৌসা, সওয়াই মাধোপুর, কারাউলি এবং উদয়পুর জেলায় সবচেয়ে বেশী সংখ্যাই বাস করে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, রাজস্থানে মীনা উপজাতির জনসংখ্যা ছিল ৪৩.৪৬ লক্ষ। রাজস্থানের মোট আদিবাসী জনসংখ্যার যা প্রায় ৪৭ শতাংশ। মীনা শব্দটি এসেছে ‘মীন’ শব্দ থেকে যার অর্থ ‘মাছ’।  এই উপজাতির একটি বড় অংশ আজও  বিশ্বাস করে যে তাদের  উৎপত্তি ভগবান বিষ্ণুর দশম অবতার অর্থাৎ মৎস্য অবতার থেকে হয়েছে। মীনা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কারনে  আগে আলওয়ার, ভরতপুর প্রভৃতি অঞ্চলকে ‘মৎস্য অঞ্চল’ বলা হত।

মীনা উপজাতির ইতিহাস থেকে জানা যায়  তারা রাজপুতানার অনেক রাজ্যে বহু শতাব্দী ধরে বসবাস করে আসছে।  মীনা সম্প্রদায়ের লোকেরা  নিজেদের একজন জন্মগত ক্ষত্রিয় মনে করেন।  ধুন্ধর অঞ্চলের খোহগাং, আমের, ভান্ডারেজ, মাঞ্চি, গাটোর, ঘোটওয়ারা, নরেথ, শোভনপুর প্রভৃতি এলাকা শত শত বছর ধরে মীনাদের জেলা ছিল।  এই স্থানগুলি প্রাচীনকাল থেকেই মীনা শাসকদের নিয়ন্ত্রণের অধীনে ছিল। এরপর মীনা শাসক অ্যালান সিংকে পরাজিত করে  ধুনধারে কাচওয়াহা রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন হয়। এই যুদ্ধে অ্যালান সিং এবং তার প্রায় ১৫০০ মীনা সঙ্গী নিহত হয়।  মীনা মহিলারা তাদের স্বামীর সাথে সতীদাহ করেছিলেন। আজও খহগংয়ের কাছে তাদের ছত্রী ও প্রাচীর পাওয়া যায়।  এরপর মাঞ্চির মীনা শাসক রাও নাথু মীনাকে পরাজিত করে দুলহরাও তার রাজ্য বিস্তার করেন।

 পরবর্তীতে কচওয়াহা শাসক কোকিল ও মাইকুল মীনা জেলার শাসক যেমন গেটর, আমের, ঝোটওয়ারা ইত্যাদিকে পরাজিত করে তাদের রাজ্য বৃদ্ধি করেন।  এভাবে মীনার শাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে মীনাদের একটি অংশ গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে শাসক শ্রেণীকে চ্যালেঞ্জ করতে থাকে।তারপর কাচওয়াহা শাসকরা তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য কৃষিকাজ করার জন্য জমি বরাদ্দ করে। ফলস্বরূপ, তারা রাজপুতদের অধীনতা মেনে নেয়, তারপর এই মীনাদের বেশিরভাগই কৃষিকাজ শুরু করে। তাদের ‘জমিদার মীনা’ বলা শুরু হয়। সেই সময় মীনাদের অন্য আর একটি অংশ তখনও লড়াইয়ের পথ অবলম্বন করেছিল।কাচওয়াহা শাসকরা তাদের সাথেও আপস করে এবং তাদের রাজ্যের শান্তি বজায় রাখার দায়িত্ব দেয়। এই মীনারা  চৌকিদারি করতেন এবং বিনিময়ে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে চৌথ আদায় করতেন। পরবর্তী কালে এই মীনারা ‘চৌকিদার মীনা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এইভাবে মীনারা দুটি প্রধান শাখায় ভাগ হয়ে যায়। যে মীনা কৃষিকাজ করতেন, তাদের বলা হত ‘জমিদার মীনা’ এবং যারা প্রহরী কাজ করতেন, তাঁদের বলা হত ‘চৌকিদার মীনা’। ‘চৌকিদার মীনা’রা  ছিলেন জয়পুর রাজ্যের রাজকোষের অভিভাবক ও প্রহরী। পরবর্তী ব্রিটিশ শাসন কালে এই চৌকিদার মীনাদের তাদের চৌকিদারের কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং ব্রিটিশরা নিজেরাই পুলিশ দিয়ে শাসন পরিচালনা করতে থাকেন।  এই বিশাল সংখ্যক চৌকিদার মীনারা সেই সময় বেকার হয়ে পড়েন এবং তাদের  কিছু অংশ এলাকায়  চুরি-ডাকাতি করতে শুরু করে। এই অপরাধের কারণে ব্রিটিশ শাসনকালে মীনাদের একটি অপরাধী উপজাতি হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। ১৯২৪ সালে ব্রিটিশরা ক্রিমিনাল ট্রাইবাল এক্ট নামে একটি আইন আনেন তাতে অন্য আদিবাসীদের সাথে মীনাদেরও অন্তর্গত করেন। এরপর ১৯৩০ সালে জারায়ম প্রফেশনাল এক্ট চালু হয়। এই এক্ট এর মাধ্যমে প্রতিটি মীনা প্রতিদিন একবার করে থানায় উপস্থিত হওয়া  অবশ্যাম্ভাবী করা হয়। সেই সময়  যদি কোনও চুরির ঘটনা ঘটতো তবে চৌকিদার মীনাদের সমস্ত কিছুর ক্ষতিপূরণ দিতে হতো।  এরপর ধীরে ধীরে ক্ষোভ জমতে থাকে চৌকিদার মীনাদের মধ্যে। শুরু হয় ১৯৩৩ সাল থেকে এই আইনের বিরোধ এবং ১৯৪৬ একটি আইন পাশ হয় তাতে বলা হয়েছিল মীনা সম্প্রদায়কে আর থানায়  উপস্থিত হতে হবে না। স্বাধীনতার পর ১৯৫২ এই উপজাতিকে অপরাধী তালিকা থেকে “ডিনোটিফাইড লিস্ট”-এ স্থানান্তরিত করা হয়।

এই দীর্ঘ অবহেলা ও দারিদ্রের পর মীনা সম্প্রদায় ভুক্ত লোকেরা আজ ভারতের সর্বাধিক শিক্ষিত ও আর্থিক দিক  থেকে সম্পন্ন একটি জনজাতি।২০২১ সালের জনগণনা অনুসারে মীনা সমাজে ৭৮.১৮ শতাংশ ছেলে এবং ৩৩.৭০ শতাংশ মহিলা শিক্ষিত।  আজ  মীনা সম্প্রদায়ের মেয়ে শিক্ষার্থীরাও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গবেষণা করছে, সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছে, রাজস্থানে মীনা সম্প্রদায়ের বহু ছেলে মেয়ে আজ প্রশাসনিক উচ্চ পদে প্রতিষ্ঠিত। ২০১৮ সালে মিসেস প্রীতি মীনা ‘মিসেস ইন্ডিয়া ইউনিভার্স’ খেতাব জিতে উপজাতী সম্প্রদায়কে লাইমলাইটে নিয়ে এসেছিলেন।

খবরটি শেয়ার করুণ

7 thoughts on “মীনা উপজাতি সম্প্রদায়ের উত্থানের কাহিনী”

  1. সায়ন বসু

    পড়ে ভালো লাগলো … আশা করি ভবিষ্যতে ভারতের নানা রাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরও উপজাতির কথা জানতে পারবো উত্তরাপথের হাত ধরে

  2. যে রাজ্যে আছো, ইতিহাস সেখানে ঐতিহ্য। লেখাটি খুব সুন্দর হয়েছে, প্রচুর তথ্য পাওয়া গেলো। ভবিষ্যত আরো এরকম লেখা চাই।

    1. uttarapath_admin

      আপনার মতামতের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

    1. uttarapath_admin

      আপনার মতামতের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

    1. uttarapath_admin

      আপনার মতামতের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


NASA Carbon Emission: পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে

উত্তরাপথঃ কার্বন নির্গমন (NASA Carbon Emission) সম্পর্কে নাসার সর্বশেষ আবিষ্কার পৃথিবীর জন্য এক সতর্কতা সংকেত। মহাকাশ সংস্থার মতে, পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে, যার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। NASA এর এই আবিষ্কারটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, সেইসাথে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেছে।নাসার সর্বশেষ গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে পৃথিবীর মহাসাগর এবং ভূমি-ভিত্তিক বাস্তুতন্ত্র আগের চেয়ে কম কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে গত এক দশকে ভূমি এবং মহাসাগর দ্বারা শোষিত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৫% হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Vijay Stambh : চিতোরগড় দুর্গে বিজয় স্তম্ভ হিন্দু – মুসলিম সহাবস্থানের প্রতীক

উত্তরাপথঃ খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে মৌর্য রাজবংশ কর্তৃক স্থাপিত চিতোরগড় দুর্গ সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গ তার বিশাল কাঠামো, রাজপ্রাসাদ, একাধিক  সুদৃশ্য মন্দির সহ সুন্দর জলাশয়ের জন্য বিখ্যাত।৭০০-একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এই দুর্গটিতে প্রায় ৬৫টি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে যা রাজপুত এবং ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীর সূক্ষ্মতার প্রমান দেয়। বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh)) হল এই দুর্গে অবস্থিত,সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কাঠামো।এই আশ্চর্য-অনুপ্রেরণামূলক স্তম্ভটি কেবল তার উচ্চতার জন্য বিখ্যাত নয়,এটি রাজপুতদের অদম্য সাহস এবং অধ্যবসায়ের গল্পও বলে যা চিতোরগড় দুর্গেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে।বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh), নাম থেকে বোঝা যায়, বিজয়ের প্রতীক।  প্রাচীনকালে যে কোনো যুদ্ধ অভিযানের সাফল্যের পর সেই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে রাজারা মন্দির, স্তূপ, স্মৃতিস্তম্ভ ও স্তম্ভ নির্মাণ করতেন।  ৯ তলা এই বিজয় স্তম্ভটি ১৯৪০ থেকে ১৪৪৮ সালের মধ্যে মহারানা কুম্ভ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক

উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই  সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন

সেলফির উচ্চ রেটিং কি আপনাকে আরওপাতলা হতে উৎসাহিত করছে ?

উত্তরাপথঃ সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে সেলফি তোলা এবং নিজেকে পাতলা হিসাবে দেখানোর মধ্যে একটি সম্পর্ক থাকতে পারে। যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক সেন্ট জন ইউনিভার্সিটির রুথ নাইট এবং ইউনিভার্সিটি অফ ইয়র্কের ক্যাথরিন প্রেস্টন সম্প্রতি PLOS ONE জার্নালে তাদের ফলাফল প্রকাশ করেছেন।সেখানে সেলফির উচ্চ রেটিং এবং আমাদের শরীরের গঠনের মধ্যে যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।    বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ায় সেলফি হল এক জনপ্রিয় ছবি দেওয়ার ধরন। যিনি সেলফি তোলেন তিনি ক্যামেরাকে তাদের শরীর থেকে দূরে রেখে নিজেই নিজের ছবি তোলে। আগের গবেষণায় বলা হয়েছে সেলফিগুলি দেখার ফলে ছবির বিষয়গুলি সম্পর্কে দর্শকদের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top