বৈদিক সংবাদঃ মৃত্যুর দেবতা যমরাজ ও ব্রাহ্মণ বালক নচিকেতার কথোপকথন এই উপনিষদের মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয়। 

মৈত্রেয়ী চৌধুরী

মৃত্যুর পর কেউ বলে আত্মার অস্তিত্ব থাকে আর কেউ বলে থাকে না। এই বিষয়ে বালক নচিকেতা মৃত্যুর দেবতাকে জিজ্ঞেস করলে যমরাজ কি বলেন? সত্যি কি আত্মা থাকে না ,আত্মা অস্তিত্ব হীন। এইসব প্রশ্নের সঠিক ব্যাখ্যা পেতেই আজকের আমাদের আলোচনা।

নচিকেতার পিতা বাজশ্রবস ঋষি একদা যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। যজ্ঞের বিধি অনুযায়ী নিজের সর্বস্ব দান করতে হব। এই বিধি অনুযায়ী তিনি কেবল পুরাতন ও অসার বস্তুগুলি দান করছিলেন, পিতার এইসব ত্রুটি নচিকেতা লক্ষ্য করছিলেন, নচিকেতা ভাবলেন পুত্র হিসেবে পিতাকে সতর্ক করে দেওয়া তার কর্তব্য , তাই পিতাকে বললে ঋষি রুষ্ট হন। নচিকেতা বলে পুত্র হিসেবে তিনি নিজেও পিতার সম্পদ, পিতা তাকে কার নিকট দান করবেন। তিনবার একই প্রশ্ন করলে রুষ্ট পিতা বলেন আমি তোমাকে যমকে অর্পণ করলাম। পিতার কথা মতো নচিকেতা যমালয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলে পিতা বাঁধা দানের চেষ্টা করলে নচিকেতা মনে করিয়ে দেন ব্রাহ্মণ হিসেবে সত্য রক্ষা করা তার কর্তব্য। এই বলে পিতার  অনুমতি নিয়ে নচিকেতা গমন করেন যমালয়ে। যমের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর নচিকেতা জানতে চান মৃত্যুর পর মানুষের কি হয়? মৃত্যুর পর আদৌ কি কিছু অবশিষ্ট থাকে? তখন শুরু হয় দুজনের মধ্যে দীর্ঘ কথোপকথন। তার ফলস্বরূপ আমরা জানতে পারি আত্মার স্বরূপ সম্বন্ধে নানা দার্শনিক তত্ত্ব। যম সিদ্ধান্তে জানান যে , আত্মা জন্মমৃত্যু রহিত, অজর, অমর ও অবিনাশী।

বাজশ্রবস ঋষির আর এক নাম ঔদ্দালক। ইনি প্রাচীন ঋষি এবং দানবীর বাজশ্রবার বংশে জন্মগ্রহণ করেন।স্বর্গে প্রভূত পুরুস্কারের আশায় এই বাজশ্রবস বিশ্বজিৎ নামে এক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। এই যজ্ঞের নিয়ম হলো যজ্ঞকারীকে সর্বস্ব দান করতে হবে। বাজশ্রবসের একটি বালক পুত্র ছিল। তাঁর নাম নচিকেতা। তিনি বয়সে তরুণ হলেও শাস্ত্রে তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ও জ্ঞান ছিল। তিনি দেখলেন পিতা ‌দানস্বরূপ ক্ষীণ,দুর্বল ও বৃদ্ধ গাভীদের দান করছেন । পিতার এই আচরণে গভীর আঘাত পান বালক নচিকেতা, তিনি বুঝতে পারেন পিতা যা দান করছেন তাতে বিশ্বজিৎ যজ্ঞের পুণ্যফল লাভ তো দূরের কথা তিনি মৃত্যুর পর আনন্দহীন, দুঃখবহুল লোকে গমন করবেন। কারণ শাস্ত্র বিরুদ্ধ শাস্ত্রহীন দানে পুণ্য হওয়া তো দূরের কথা বরং প্রত্যবায় হয়।

নচিকেতা তাঁর পিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আমাকে কাকে দান করবেন? পিতার কাছে উত্তর না পেয়ে একই প্রশ্ন তিনবার করলেন। অবশেষে পিতা উত্তর দিলেন, তোমাকে আমি মৃত্যুর দেব যমকে দেব।

পিতৃসত্য পালনের বদ্ধ পরিকর হয়ে নচিকেতা যমালয়ে গেলেন। যমপুরীতে যমরাজ অনুপস্থিত। ক্ষুধায় তৃষ্ণা য় কাতর হয়ে নচিকেতা তিনদিন তিনরাত্রি অপেক্ষা করেন। যমরাজ ফিরে এসে বালক হলেও ব্রাহ্মণ জ্ঞানে নচিকেতা কে প্রণাম করেন। জানতে পারেন যমরাজ নচিকেতার উপহাসের কথা, তিনি ক্ষমা চেয়ে তিন রাতের উপাসের পায়শ্চিত্ত স্বরূপ তিনটি বর দিতে চাইলেন।

 নচিকেতা বললেন হে মৃত্যু দেব অনুগ্রহ করে আপনি এই বর দিন, আমার পিতা গৌতম যেন দুশ্চিন্তা মুক্ত ও প্রসন্নচিত্ত হন, আমার উপর তাঁর যেন কোনো প্রকার রাগ না থাকে, আপনার কাছ থেকে স্বগৃহে ফিরে গেলে তিনি যেন তৎক্ষণাৎ আমাকে চিনতে পারেন ।পূর্বের মতোই যেন আমাকে সানন্দে গ্রহণ করে নেন। তিনটি বরের মধ্যে  একটি।যমরাজ জানান কোনটির জন্য ই নচিকেতার দুশ্চিন্তার কারণ নেই —– একথা বলে যম নচিকেতা কে আশ্বস্ত করলেন।

যমরাজ নচিকেতা কে দ্বিতীয় বর প্রার্থনা করতে বলেন। নচিকেতা এবার স্বর্গলোক তথা ব্রহ্মলোক সম্পর্কে জানতে চান। যদিও তিনি ক্ষনিকের লোক জগতের জন্য আগ্রহী নন।কারণ নচিকেতা লক্ষ্য করেছিলেন, এই দৃশ্যমান জগৎ সংসার চিরস্থায়ী নয়, অনিত্য। নচিকেতা লক্ষ্য করছিলেন মানুষ দুঃখ, কষ্ট,রোগ ব্যাধির মুখোমুখি নিজেকে বড় অসহায় বোধ করে।
এই জগতে মানুষ অল্প সময়ের জন্য সুখভোগ করে বটে কিন্তু অচিরেই তাকে দুঃখের সম্মুখীন হতে হয়। জগতের সবকিছু ই ক্ষণস্থায়ী। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে , মানুষ কি এই শোক- দুঃখ, রোগ ব্যাধিকে অতিক্রম করতে পারে? উপনিষদ বলেন হ্যাঁ পারে। যখন আমরা নিজেদের পরিচয় জানি অর্থাৎ আত্মার প্রকৃত স্বরূপকে উপলব্ধি করি তখন আমরা সকল দুঃখ কষ্টের পারে চলে তাই। উপনিষদ আমাদের আত্মজ্ঞান লাভের শিক্ষাই দিয়ে থাকেন। উপনিষদ ই সেই আত্মার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। নচিকেতার অনুরোধে মম সেই আত্মারই বর্ণনা দেবেন। নচিকেতা ইতিমধ্যেই প্রশ্ন করেছেন, কেমন করে ব্রহ্মলোক লাভ করা যায়?
ব্রহ্মলোক তথা স্বর্গ লাভের উপায় স্বরূপ যে অগ্নিবিদ্যা আছে, আপনি তা জানেন। অনুগ্রহ করে হে মৃত্যু দেব সেই বিদ্যা আমার কাছে সবিস্তারে বলুন। মৃত্যুর পর যাঁরা স্বর্গলোকে যান, তাঁরা অমৃতত্ব লাভ করেন। আমি স্বর্গলাভের উপায় স্বরূপ এই অগ্নিবিদ্যা ই দ্বিতীয় বর হিসাবে আপনার কাছে প্রার্থনা করছি।
(আগামী সংখ্যায় পরবর্তী অংশ)

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


World Children's Day: সত্যিই কি ‘বিশ্ব শিশু দিবস´পালনের কোনও যৌক্তিকতা আছে ?

প্রীতি গুপ্তাঃ হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকটি দিন তারপর ১৪ নভেম্বর আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বজুড়ে  পালন করা হবে ‘বিশ্ব শিশু দিবস´(World Children's Day)।এই দিনটি শিশুদের মঙ্গলের জন্য, তাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি অনুকূল বিশ্ব তৈরি করার প্রচেষ্টার একটি দিন।কিন্তু প্রশ্ন,সত্যি কি হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সারা বিশ্ব জুড়ে শিশু দিবস পালন করার কোনও যৌক্তিকতা আছে? আদৌ কি এর কোনও লাভ আমরা আমাদের প্রান্তিক স্তরের শিশুদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি ? সম্প্রতি কাজের প্রয়োজনে রাজস্থানের উদয়পুর শহরে আসা। আমরা সবাই জানি উদয়পুর বিখ্যাত তার হ্রদের কারণে । এখানকার স্থানীয় থেকে পর্যটক সকলেই এই সুন্দর হ্রদগুলির আকর্ষণে বারবার ছুঁটে যায়। ‘ফতে সাহেব লেক’ রাজস্থানের উদয়পুরের এক বিখ্যাত পর্যটক স্থল।এখানে বহু মানুষ সকাল- বিকেল এই লেকের চার ধারে হাঁটাহাঁটি করতে বেরিয়ে পড়ে। সেভাবেই দুই দিন আগে বিকেলে হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়লাম ‘ফতে সাহেব লেকের ধারে হাঁটার উদ্দেশ্য নিয়ে। হাঁটার মাঝখানে হঠাৎ করে একটি বাচ্চাছেলে আওয়াজ করে ডাকছে ,বললাম কিছু বলবি? সে বলল একটু দাঁড়াতে। ও ছুটে গিয়ে হাতে করে কয়েকটি বেলুন নিয়ে এসে হাজির । সে বারবার বেলুন কেনার অনুরোধ জানাতে লাগল। হাতে অন্য কাজের চাপ নেই অনেকটা অবসর সময় তাই আমি অনেকটা সাংবাদিক সুলভ মন নিয়ে বললাম ঠিক আছে আমি তোর বেলুন নেব ,কিন্তু তার আগে আমি  তোকে যা বলব তার তার ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে। সে খুশী খুশী রাজি হয়ে গেল । .....বিস্তারিত পড়ুন

বিশ্বকাপ ২০২৩: পাকিস্তানকে হারিয়ে Afghanistan এ ঈদের মতো পরিস্থিতি

আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০২৩-এর ২২ তম ম্যাচে আফগানিস্তান পাকিস্তানকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছে। সেই ম্যাচে পাকিস্তানকে ৮ উইকেটে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে আফগানিস্তান। এই প্রথম ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে হারাল আফগানিস্তান আর এই পাকিস্তানকে হারিয়ে আফগানিস্থানে(Afghanistan)এখন ঈদের মতো পরিস্থিতি।এক আফগানিস্থানি সমর্থকের মতে এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এবং নিজেদের মত করে তারা তাদের এই খুশী উদযাপন করেছেন। এক্স হ্যান্ডেলে এক সমর্থকের মতে, সেদিন উদযাপন ছিল, পার্টি ছিল। এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এছাড়াও, এটি ছিল ২০২৩ বিশ্বকাপের তৃতীয় বড় আপসেট । টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় বাবর আজমের দল। প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান দল ২৮২ রান করে। জবাবে আফগানিস্তান দল ২৮৩ রান তাড়া করে ৪৯ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্য অর্জন করে। এই ম্যাচে হারের পর বেশ ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল অধিনায়ক বাবর আজমকে। ম্যাচ-পরবর্তী উপস্থাপনার সময়, তিনি দলের ত্রুটিগুলি তালিকাভুক্ত করেছিলেন এবং পরাজয়ের জন্য নিজেদের দায়ী করেছিলেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Roop Kishor Soni: একটি আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য তুলে ধরেছেন

উত্তরাপথঃ রাজস্থান মানেই ওজনদার রূপার গহনা ,আর তার উপর কারুকাজ। প্রচলিত এই ধারনা ভেঙ্গে আজ রূপোর গহনাকে আধুনিকতার সাথে শিল্পের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন যে ব্যক্তি তিনি হলেন রূপ কিশোরী সোনী(Roop Kishor Soni)।তিনি ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে তার অসাধারণ শিল্প কর্মের জন্য জাতীয় পুরুস্কার পান। রাজস্থানের জয়সলমেরের শহরের এই শিল্পী ৩.৮ গ্রাম ওজনের ০.৯ সেমি চওড়া রৌপ্য আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য খোদাই করেছেন।এই ছোট রূপার আংটিতে শিল্পী তাজমহল, সিডনি অপেরা হাউস, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, চীনের গ্রেট ওয়াল, আইফেল টাওয়ার, বিগ বেন, পিসার হেলানো টাওয়ার এবং মিশরীয় পিরামিডের চিত্র এক সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন।এছাড়াও তিনি আরও দুটি পৃথক ডিজাইনের অত্যাশ্চর্য আংটি  তৈরি করেছেন।৮.৬ গ্রাম ওজনের একটি রিংয়ে তিনি সূর্যাস্তের সময় ভারতীয় উট সাফারি সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভারতীয় বিশেষত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন,এবং অন্যটিতে বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবী ছবি এবং মন্দির খোদাই করেছিলেন। শিল্পী বলেছেন যে তিনি তার বাবার কাছ থেকে তার শৈল্পিক দক্ষতা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সেই সাথে তিনি বলেন "আমার বাবাও একজন জাতীয় পুরুস্কার প্রাপ্ত শিল্পী ছিলেন। তিনি আমাকে শিল্পের এই দক্ষতা শিখিয়েছিলেন কারণ তিনি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে শিল্পের ফর্মটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।" .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক

উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই  সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top