

প্রিয়াঙ্কা দত্তঃ
“আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।
ওগো মা তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।”
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ,এই একটি নামই বাঙালি তথা দেশবাসীর শিরায় শিরায় দেশপপ্রেমের আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট । আর তার সঙ্গে যদি যুক্ত হয় বাঙালির সেরা উৎসব দুর্গা পূজার কাহিনী তাহলেতো বাঙালি নস্টালজিক হবেই। এই সংযোগ কিন্তু কোনও কল্প কাহিনী নয়। বরং সুভাষ চন্দ্র বসুর চারিত্রিক দৃঢ়তার যে এক অনুন্মচিত দিক।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আর সাহসিকতার প্রায় সমস্ত ইতিহাসই আমাদের জানা । কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের এই ভাবশিষ্যটির মাতৃভক্তির অনেক কথাই হয়তো আমরা জানিনা । হ্যাঁ , গর্ভধারিনী মায়ের মতই তিনি শক্তিরূপী মা দুর্গারও একজন বড় ভক্ত ছিলেন। দয়া করে এর সঙ্গে কোন ধর্মীয় আদর্শ অথবা পৌত্তলিকতার তুলনা করতে যাবেন না । তাহলে সেই একনিষ্ঠ দেশভক্তের অখণ্ড দেশপ্রেমের প্রতি চরম অবমাননা করা হবে ।
নেতাজির কাছে দেশ মাতৃকা ছিলেন –
“শারদ জ্যোৎস্নামৌলি মালিনী, শরদিন্দু নিভাননা , অসুরদর্পখর্বকারিনী, চৈতন্যরুপিনী,জ্যোতির্ময়ী”। তাই মা দূর্গার অসুরনাশিনী রূপটিও তাঁর অন্তরে চিরজগরুক ।
কোদালিয়ায় সুভাষচন্দ্র বসুর পৈতৃক ভিটেতে প্রতিবছরই মহা সমারোহে দূর্গা পূজার আয়োজন করা হতো। সেই মাতৃ মূর্তি ও মাতৃ পূজা গভীরভাবে বাল্যকাল থেকেই তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলে। সেকথা মাত্র ১২ বছর বয়সেই তাঁর মা কে লেখা একটি চিঠিতে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন। তবে এই মাতৃ আরাধনা তাঁর কাছে শুধুমাত্র ফুল বেলপাতা বা মন্ত্র উচ্চারণে সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং তার সাথে যুক্ত হয়েছিল বীরোচিত নানান গাথা।
দুর্গাপূজাকে তিনি শক্তি আর ভক্তির অপূর্ব সমন্বয় বলেই মনে করতেন । পরবর্তীকালে সদ্য প্রচলিত বারোয়ারি দুর্গা পূজার আড়ালে তিনি বিভিন্ন বিপ্লবী কার্যকলাপ সংগঠিত করতে থাকেন এবং এই পূজোর মাধ্যমে যুবসমাজকে দেশাত্মবোধে উদ্দীপিত করার এক কৌশল অবলম্বন করেন। জনসাধারণকে সার্বজনীন দূর্গা পূজা উপহার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতাজী দেশসেবার কাজটিও সমান তালে করে গিয়েছিলেন।


শিল্পীঃ অভিপ্সা চ্যাটার্জি
শুধু তাই নয় , তিনি যে কতো বড় মাতৃ সাধক ছিলেন তার সবথেকে বড় উদাহরণ , জেলে বন্দি থাকাকালীনও তিনি দুর্গা পূজা সম্পন্ন করেছিলেন। তীব্র বাধার সত্বেও ১৯২৫ সালে বার্মায় মান্দালয়ের জেলে এবং ১৯৪০ সালে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি জেলে দোর্দন্ডপ্রতাপ ইংরেজ সরকারের সব রকম অসহযোগিতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মহাসমারোহে সুভাষচন্দ্র দুর্গাপূজার ব্যবস্থা করেন। জেলে উপস্থিত সকলে তাতে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর অকাট্য যুক্তির কাছে হার স্বীকার করে জেল কতৃপক্ষ। তিনি চিঠিতে লিখলেন , জেলে মুসলিম কয়েদিদের জন্য ঈদের সময় এবং বড়দিনে খ্রিস্টানদের জন্য যেমন সুযোগ সুবিধা এবং ভাতা দেওয়া হয়, তেমনি হিন্দুদেরও, বিশেষত বাঙালিদের এই সর্ববৃহৎ উৎসবে যোগদান করতে বাধা দেওয়ার কোনো কারণ থাকা উচিত নয় । ইংরেজদের ডিভাইড এন্ড রুল নীতির বিরুদ্ধে এই সিংহ গর্জন থামানোর ক্ষমতা আর কারো ছিলোনা। প্রথা অনুযায়ী রীতিমত পুরোহিত দিয়ে চার দিন ধরে ধূমধাম করে জেলেই দূর্গা পূজা হয় নেতাজীর নেতৃত্বে। খরচা পাতি নিয়ে নানান অসুবিধা সত্বেও এই কাজ তিনি সম্পন্ন করেছিলেন। কারণ এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সব বন্দীদের সাথে গোপন পরামর্শ করার সুবর্ণ সুযোগ। আর এতসব আয়োজন বা সমাহারের মধ্যে থেকেও দেশব্রতের আদর্শ থেকে তিনি যে ন্যূনতম বিচ্যুত হননি তার প্রমাণ প্রেসিডেন্সী জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দু মাসের মধ্যেই তিনি দেশের পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য মহা নিষ্ক্রমণের পথে পাড়ি দিয়েছিলেন।
যাবার সময় তিনি বলে গেছিলেন ,
“দেশ মাতৃকা জননী জন্মভূমির সেবা করতে হলে দিতে হবে— মান, সম্মান, খ্যাতি ,প্রতিষ্ঠা, গৌরব, ইন্দ্রিয়ের সব বৃত্তি, ভাবনা এবং সবশেষে আত্মাকে। এ না হলে মাতৃ সাধনা হবে না।”
মান্দালয় থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সুভাষচন্দ্র স্বাস্থ্য উদ্ধার করতে যান শিলং এ। সেখান থেকে ১৯২৭ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এর স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে একটি চিঠিতে তিনি লেখেন ,
“মানুষের জীবনে এমন একটি স্থান চাই যেখানে বিতর্ক থাকবেনা, বিচার থাকবে না, বুদ্ধি বিবেচনা থাকবে না ,থাকবে শুধু ব্লাইন্ড ওয়ারশীপ ।তাই বুঝি মায়ের সৃষ্টি । ভগবান করুন যেন আমি চিরকাল এইভাবে নিয়ে মাতৃ পূজা করে যেতে পারি।”
দেশের প্রতি, মাতৃ জাতির প্রতি কী প্রচণ্ড আবেগ নেতাজীর হৃদয়ে ছিলো তার প্রমাণ এই লেখা। আসলে দেশের মুক্তি সংগ্রামে বাংলার যুব শক্তিকে উদ্দীপিত করার জন্য নেতাজি দেবী দুর্গার আরাধনাকেই বেছে নিয়েছিলেন। দেশ ও জগৎজননীর আরাধনাকে পরিণত করতে চেয়েছিলেন প্রবল প্রতাপান্বিত ব্রিটিশ শক্তির বিরোধিতার অস্ত্র হিসেবে। লোকমান্য তিলক এর শিবাজী উৎসবের মতো তিনিও বাঙালির সর্ববৃহৎ উৎসবকে এক সার্বজনীন রূপ দিতে চেয়েছিলেন ।
উত্তর কলকাতার তিন তিনটি বারোয়ারি পূজোর প্রচলন এর সঙ্গে নাম জড়িয়ে গেছে নেতাজির। সিমলা , বাগবাজার আর কুমোরটুলি । আজও এই পূজো গুলির জনপ্রিয়তা সর্বজনবিদিত।
১৯১৯ সালে নেবু বাগান বারোয়ারী উৎসব ছিল কলকাতার প্রথম সার্বজনীন দুর্গাপূজা। কারণ এর আগে দূর্গা পূজা ছিলো শুধুমাত্র বাবু ও জমিদার শ্রেণীর অধিকার। এর বিরোধিতায় চালু হয় ওই পূজো যা পরবর্তীতে পরিচিত হয় বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গোৎসব রূপে ।১৯৩৮-৩৯ সালে এই পুজোর সভাপতিত্ব করেন নেতাজী। অতসী বর্ণ দূর্গা ও সবুজ বর্ণ অসুরের মূর্তি এই পূজার মূল আকর্ষণ। এর ফলে জনসাধারণ এর জন্য খুলে যায় মাতৃ আরাধনার দ্বার।
কুমোরটুলির দূর্গা পূজার ও একটি অসাধারণ ঐতিহাসিক কাহিনী আছে। সুভাষচন্দ্র বসুর নাম যার সঙ্গে ওত্রোতভাবে জড়িত। ১৯৩১ সালে হরিশংকর পালের সভাপতিত্বে এই পূজা শুরু হলেও ১৯৩৭-৩৮ সালে কুমোরটুলি দূর্গা পূজা কমিটির সভাপতি হন সুভাষচন্দ্র। কিন্তু সেবার পঞ্চমীর দিন আগুন লেগে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পূজোর উদ্যোগ। পুড়ে যায় মায়ের মূর্তি। এই ঘোর বিপত্তিতেও নেতাজী কিন্তু দমে যাননি। তাঁর একান্ত অনুরোধে বিখ্যাত শিল্পী গোপেশ্বর পাল মাতৃ মূর্তি তৈরি করতে রাজি হলেন। কিন্তু রাতারাতি সেই মূর্তি স্থাপনের জন্য তিনি এক অভিনব পন্থা উদ্ভাবন করলেন। একচালার পরিবর্তে আলাদা আলাদা করে নির্মিত হল লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ আর মায়ের মূর্তি অর্থাৎ একচালার বদলে পাঁচ চালা দূর্গা প্রতিমা নির্মাণ করে ইতিহাস রচনা করলো কুমোরটুলি সার্বজনীন । পুরোহিতরা অবশ্য শুরুতেই এর বিরোধিতা করেছিলেন । কিন্তু ওই একজনের নামই তাদের সব বিরোধিতা মিটিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
১৯২৬ সালের শুরু হয় সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজো। হোগলা পাতা দিয়ে তৈরি হয় পূজোর প্যান্ডেল। কিন্তু পুজো ছিল নিমিত্ত মাত্র। তার আড়ালে একত্রিত হতেন বিপ্লবীরা। স্থির হত তাদের ভবিষ্যৎ কার্যকলাপ। লাঠি – ছুড়ি – বল্লম-এর নানান খেলা ও কসরত দেখানোর ব্যবস্থা করা হতো। পালিত হতো বীরাষ্টমী ব্রত । দূর দূরান্ত থেকে বহু লোক আসতো সেসব দেখতে। আক্ষরিক অর্থে এই ছিল সার্বজনীনতা । ১৯৩২ সালে বিপদের গন্ধ পেয়ে এই পুজো বন্ধ করে দেয় ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু ১৯৩৪শে নেতাজীর সভাপতিত্বে আবার শুরু হয় সিমলা ব্যায়াম সমিতির দুর্গোৎসব।
তাই এই সার্বজনীন দূর্গা পূজা যা এখন বাঙালিকে হেরিটেজ তকমা এনে দিয়েছে তার পিছনে আমাদের দেশনায়ক এর ভূমিকা বিস্মৃত হলে চলবে না। এই বার্তা ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র।
আরও পড়ুন
OMG 2: ওএমজি 2-এর মুক্তি আপতত বন্ধ করে দিয়েছে সেন্সর বোর্ড
উত্তরাপথ: সেন্সর বোর্ড বর্তমানে OMG 2 ছবিটির মুক্তি নিষিদ্ধ করেছে। ছবিটি রিভিউ কমিটিতে পাঠিয়েছে সেন্সর বোর্ড। সেন্সর বোর্ড রিভিউ কমিটি বিবেচনা করে ছবির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। তবে এখনই চলচ্চিত্রের জন্য নিষিদ্ধ শব্দটি ব্যবহার করা ঠিক হবে না। আদিপুরুষের সঙ্গে যা ঘটেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ১১ জুলাই ছবিটির টিজার মুক্তি পায়। টিজারে অক্ষয় কুমারকে লম্বা চুল এবং কপালে ছাই দিয়ে ভগবান শিবের রূপে দেখা যাচ্ছে। .....বিস্তারিত পড়ুন
আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে ভারত নবম স্থান অর্জন করেছে
উত্তরাপথ: ৬৪ তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে ভারতীয় দল একটি ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়ে, সামগ্রিকভাবে নবম স্থানটি অধিকার করে নিয়েছে। দলটি সাথে দুটি স্বর্ণ, দুটি রৌপ্য এবং তিনটি ব্রোঞ্জ পদক জিতেছে ৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডটি ১৩ জুলাই জাপানের চিবাতে অনুষ্ঠত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অতুল শতবর্ত নাদিগ এবং অর্জুন গুপ্ত স্বর্ণপদক জিতেছেন, তারপরে আনন্দ ভাদুড়ি এবং সিদ্ধার্থ চোপরা .....বিস্তারিত পড়ুন
Mahendra Singh Dhoni: একজন ক্রিকেট কিংবদন্তি
উত্তরাপথ: গত ৭ জুলাই ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির(Mahendra Singh Dhoni) ৪২তম জন্মদিন । তিনি ২০০৭ সালে ভারতের ওয়ানডে দলের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন এবং ভারতকে টি -২০ বিশ্বকাপ এনে দেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে তিনি বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের অধিকারী, তার সংগ্রহ ৬,৬৩৩ রান ।উত্তরাপথের পক্ষ থেকে তার জন্মদিনে তাঁর প্রতি রইল বিনম্র অভিনন্দন । মহেন্দ্র সিং ধোনি (Mahendra Singh Dhoni) বা"এমএসডি" যিনি "ক্যাপ্টেন কুল" নামেও পরিচিত, খেলা .....বিস্তারিত পড়ুন
Camel Cloning: দুবাই ‘উট' ক্লোনিং‘এর জন্য খবরের শিরোনামে
উত্তরাপথ: দুবাই, তার ঐশ্বর্য এবং জাঁকজমকের জন্য পরিচিত হলেও এবার দুবাই তার ‘উট ক্লোনিং ‘এর জন্য খবরের শিরোনামে।এবার আশা যাক ক্লোনিং কি তা নিয়ে আলোচনায়। ক্লোনিং হল প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম উপায়ে অভিন্ন জিনোম সহ পৃথক জীব উৎপাদনের প্রক্রিয়া অর্থাৎ জীবের অভিন্ন অনুলিপি তৈরি করার প্রক্রিয়া।২০০৯সালে বিশ্বের প্রথম উটের ক্লোনিংয়ের নেতৃত্ব দেওয়া, নিসার ওয়ানি এখন দুবাইয়ের একটি ল্যাবে বছরে কয়েক ডজন উটের প্রতিলিপি তৈরি করছেন যা উপসাগরীয় অঞ্চলের এখন একটি বড় ব্যবসা যেখানে উট লালন-পালন করা হয় সৌন্দর্য ও রেসিং .....বিস্তারিত পড়ুন