Green Washing থেকে সাবধান

প্রিয়াঙ্কা দত্ত, রঘনাথপুর

আপনি নিশ্চয়ই একজন পরিবেশ সচেতন নাগরিক? যদি নাও হন তবুও বাজার চলতি ভোগ্যপণ্য খরিদ করার সময় আপনি কি এখন একশ শতাংশ প্রাকৃতিক দ্রব্য কিনতেই পছন্দ করেন? এবং কেনেন? প্রসাধন দ্রব্য কেনার সময় কি আপনি নিম ,তুলসী, চন্দন বা গোলাপের নির্যাস যুক্ত জিনিসই কেনেন ? আর জামাকাপড়? একশ শতাংশ পচনশীল পদার্থ দিয়ে তৈরী? টুথ পেস্ট থেকে আরম্ভ করে তেল, সাবান, শাম্পু কিংবা ভোজ্য তেল , ফ্রুট জুস বা খাবার জিনিস! সব কিছুতেই আপনি পরিবেশে বান্ধব প্যাকেজিং এবং সম্পূর্ন প্রাকৃতিক এই লেবেল দেখেই কিনছেন। তাই না? বর্তমান যুগের ট্রেন্ড কিন্তু তাই বলছে। আপনি প্রাকৃতিক বা ভেষজ উপাদান থেকে তৈরি জিনিসপত্র বা কীটনাশক বর্জিত ১০০% প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে উৎপন্ন খাদ্যদ্রব্য কিনতে নিশ্চয়ই দিনকে দিন বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছেন। আর সেটাই তো স্বাভাবিক। কারণ আমরা আদার ব্যাপারি হলেও এই পৃথিবীর ভালো মন্দে আমাদেরও ভালো মন্দ এসে যায়। কিন্তু আপনি কি একেবারে নিশ্চিত যে ওই প্যাকেট দ্রব্যের গায়ে যেসব দাবি করা থাকে, তা সম্পূর্ণ সত্য! আপনার কি জিনিস গুলো ব্যবহার করে একবারও মনে হয়নি যে যতটা দাবি করা হয় ততটা ঠিক সত্যি নয়। আর যদি তা হয়ে থাকে, তবে আপনি নিশ্চিত ভাবে ‘গ্রীন ওয়াশিং’ এর শিকার। 

ঘটনার সূচনা ১৯৮৬ সাল নাগাদ হলেও গ্রীন ওয়াশিং কথাটির অক্সফোর্ডের ডিকশনারি তে ঠাঁই হয়েছে মাত্র দুই দশক আগে (১৯৯৯ সালে)। আর বাংলায় এর সঠিক পরিভাষা, এখনো আমাদের করায়ত্ত হয়নি । 

তাহলে কী এই গ্রীন ওয়াশিং যা থেকে আমাদের অবিলম্বে সাবধান হওয়া দরকার ? আসুন জেনে নিই।
এখন হয়তো সকলে লক্ষ্য করেছেন যে পৃথিবীর বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্যই পরিবেশ বান্ধব হিসেবে নিজেদের প্রতিপন্ন করছে। তাদের প্রতিটা দ্রব্যের মোড়কে পরিবেশে সচেতনতার কথা ফুটে উঠেছে।  বিজ্ঞাপনে প্রচার করা হচ্ছে কীভাবে সেই সব দ্রব্য কীভাবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এগিয়ে আছে। এতো সুন্দর ও বিশ্বাসযোগ্য ভাবে সেসব কথা বলা হচ্ছে যে আমরা সহজেই প্রলোভিত হয়ে পড়ছি। বিভিন্ন কোম্পানি বর্তমান সমাজের মনোভাব খুব ভালো করে পর্যেক্ষণ করে এইভাবেই ক্রেতাদের কাছে টানছে। কিন্তু আদপেও কী সেসব দাবীর কোনও প্রামাণ্য নথি তাদের আছে? বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর উত্তর ‘ না ‘।
আপনি যদি এমন কোন জিনিস নির্বাচন করেন যার আবরণে  ‘সম্পূর্ন প্রাকৃতিক’ বা তার মোড়কে ‘পুনর্বব্যবহারযোগ্য ‘ লেখা আছে তাহলে আপনি হয়তো সম্পূর্ণ সত্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কিছু কিছু কোম্পানি অতিরিক্ত  মুনাফা লাভের জন্য বিভিন্ন দ্রব্য, তা যতটা স্থিতিশীল নয় ততটা দাবি করছে। কিংবা আগের একই দ্রব্য শুধুমাত্র প্যাকেটের লেভেল বদলে মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে তো সেসব দাবী সম্পূর্ন মিথ্যে প্রতিপন্ন হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানি সম্পূর্ন জেনেশুনে এই কাজটি করছে। কারণ তারা জানে যে বর্তমানের পরিবেশ সচেতন নাগরিক বেশি দাম দিয়েও এই ধরনের জিনিস কিনতে প্রস্তুত কারণ তারা তাদের স্বাস্থ্য এবং পৃথিবীর মঙ্গল দুটোই কামনা করেন। 

আপনি শুনলে অবাক হবেন যে, বড় বড় কোম্পানিগুলো আপনাকে কিভাবে বোকা বানাচ্ছে। ভারতবর্ষের মত উন্নয়নশীল দেশে তো বটেই এমনকি আমেরিকার মত উন্নত দেশের নাগরিকরাও এর শিকার।
খুব নাম করা কোম্পানি যারা দাবী করে যে, তাদের ঠান্ডা পানীয় সম্পূর্ন সুগার ফ্রী বা সেসব বোতল পুনর্ব্যবহার যোগ্য, সেটা কিন্তু আদৌ নয়। বিজ্ঞাপনের চটকে বা সুন্দর প্যাকেটিং এর চক্করে পড়ে আমরা কিন্তু সম্পূর্ন বিভ্রান্ত হচ্ছি। সম্প্রতি ইনোসেন্ট, কেউরিং, আইকে, উইন্ডেক্স, H&M, ইউনিলিভার, নেস্টলে, কোকাকোলা প্রভৃতি অগণিত নামজাদা কোম্পানি হাতে নাতে এই অপরাধে ধরা পড়েছে। অথচ ব্র্যান্ডেড বলে এদের জিনিসপত্র আমরা চোখ বন্ধ করে কিনি। P&G কোম্পানি পরিবেশে বান্ধব টয়লেট টিস্যু বানাতে গিয়ে অন্যায় ভাবে অরণ্য ধ্বংস করে চলেছে। Mac Donald যে পুনর্ব্যবহার যোগ্য পেপার স্ট্র বাজারে এনেছিল তা কিন্তু আদৌ সম্পূর্ন রূপে মাটিতে মেশে না। Volkswagen তো তার গাড়ির দুষণমাত্রা নির্বিচারে কম দেখিয়ে লোক ঠকিয়েছে। বিভিন্ন নামি জামাকাপড়ের ব্র্যান্ড তাদের দ্রব্য সম্পূর্ন জৈব পচনশীল বলে বেমালুম মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে।
Rya air নামের বিমান সংস্থার বায়ু দূষণ কম ছড়ানোর দাবী করে সম্পূর্ন মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। আমরাও নিশ্চিন্তে BPA free বলে জলের বোতলে দেদার জল খাচ্ছি। সার্ফ, সাবান সম্পূর্ন প্রাকৃতিক ও ক্ষতিকর নয় ভেবে নিশ্চিন্তে ব্যবহার করছি। জৈব প্রযুক্তি দ্বারা উৎপাদিত বলে নিশ্চিন্তে খাদ্য দ্রব্য মুখে তুলছি। কিন্তু সেখানেও বিরাট ফাঁকি। তাহলে আমরা কাকে বিশ্বাস করবো? শুধুমাত্র ব্যবসায়ীক লাভের জন্য জন সাধারণের এতো বড় ক্ষতি করার মানসিকতাকে কী নামে অভিহিত করা যায়? শুধুমাত্র লোক ঠকিয়ে কী ভাবে আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে দিনের পর দিন এই করবার চলছে তার হিসাব কে রাখে?

উন্নত দেশ গুলোতে না হয় এসব জালিয়াতি ধরা পড়ে শাস্তিও হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের কী শোচনীয় অবস্থা? Yale University Environmental Performance Index 2022 অনুসারে ১৮০ দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান সর্বশেষ। এমন কি এখনো পর্যন্ত ভারতবর্ষে এ বিষয়ে কোনও সুস্পষ্ট আইন নেই।
আশার কথা এই যে, ২৪ শে নভেম্বর ২০২২ সালে SEBI এই নিয়ে প্রথম সার্কুলার জারি করেছে। বিভিন্ন কোম্পানি কে ঋণ দানের ক্ষেত্রে বা পন্য দ্রব্যের সঠিক মানদণ্ড নির্ধারণ করার ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট নিয়ম নীতি অনুসরণ করার ক্ষেত্রে জোর দেওয়া হয়েছে।২০২৩ সালের ৩রা ও ৬ই ফেব্রুয়ারি আবার সে বিষয়ে নতুন নির্দেশিকা জারি হয়েছে। তাও আশার কথা। কিন্তু আমরা সাধারণ জনগণ এ বিষয়ে আরও সতর্কতা অবলম্বন করলে এই ধরণের জালিয়াতি থেকে  কিছুটা রেহাই পেতে পারি। এর মধ্যেও খুব সীমিত সংখ্যক কোম্পানি মানুষের কাছে সত্যিই ভালো জিনিস পৌঁছে দেবার চেষ্টা করছে। তাই সম্পূর্ন নিরাশ হওয়ার কোনও কারন নেই।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


রাতের ঘামের সমস্যা এবং এ সম্পর্কে আপনি কি করতে পারেন  

উত্তরাপথঃ রাতের ঘামের সমস্যা শরীরের কুলিং সিস্টেমের একটি স্বাভাবিক অংশ, তাপ মুক্তি এবং সর্বোত্তম শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে।তবে রাতের ঘাম একটি সাধারণ সমস্যা যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে।এর  অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্য ঘুম ব্যাহত হতে পারে, যার ফলে ক্লান্তি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। আপনি যদি রাতে অতিরিক্ত ঘাম অনুভব করেন, তাহলে তার অন্তর্নিহিত কারণটি চিহ্নিত করা এবং এটি মোকাবেলার জন্য কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রাতের ঘামের কিছু সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করা হল।মেনোপজ: যে কেউ, বয়স বা লিঙ্গ নির্বিশেষে, রাতের ঘাম অনুভব করতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক

উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই  সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন

Fried rice syndrome: আগের দিনের রান্না করা ভাত খেলে হতে পারে এই বিশেষ অসুখটি

উত্তরাপথঃ আপনার কি বাসী ভাত বা পান্তা খাওয়ার অভ্যেস আছে? সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম (Fried rice syndrome) নিয়ে আমরা প্রায়ই অবশিষ্ট খাবার গরম করে আবার খাই। কিন্তু জানেন কি এই অভ্যাস আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। অনেক সময় পর আগের রান্না করা  ভাত খাওয়ার ফলে পেট সংক্রান্ত সমস্যা হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে খাবার পুনরায় গরম করলে এতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, কিন্তু তা নয়। যে খাবারেই স্টার্চ থাকে না কেন, এতে উপস্থিত টক্সিন তাপ প্রতিরোধী। অর্থাৎ খাবার গরম করার পরও ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয় না। ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম নামে এই সমস্যা সম্পর্কিত একটি অবস্থা রয়েছে। আজ আমরা এই ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম অবস্থার লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। ভাত রান্না করার পর, যখন অবশিষ্ট ভাত কয়েক ঘন্টা বা সারারাত ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয় এবং তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে শুরু করে, তখন এই অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম। .....বিস্তারিত পড়ুন

NASA Carbon Emission: পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে

উত্তরাপথঃ কার্বন নির্গমন (NASA Carbon Emission) সম্পর্কে নাসার সর্বশেষ আবিষ্কার পৃথিবীর জন্য এক সতর্কতা সংকেত। মহাকাশ সংস্থার মতে, পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে, যার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। NASA এর এই আবিষ্কারটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, সেইসাথে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেছে।নাসার সর্বশেষ গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে পৃথিবীর মহাসাগর এবং ভূমি-ভিত্তিক বাস্তুতন্ত্র আগের চেয়ে কম কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে গত এক দশকে ভূমি এবং মহাসাগর দ্বারা শোষিত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৫% হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top