” Rehab “: মাদক নিরাময় কেন্দ্রের অন্ধকার দিক উন্মোচন

উত্তরাপথঃ একজন চিকিৎসক, একজন মা, এক কিশোরী গর্ভবতী মেয়ে, এবং এক কিশোর ছেলে যার পা ভেঙে গেছে — মাদক এবং তার পরিণতি তাদের সবার জীবনই চিরতরে বদলে দিয়েছে।এই বাস্তব গল্পগুলোর ভিত্তিতে মার্কিন অনুসন্ধানী সাংবাদিক শোশানা ওয়াল্টার তার নতুন বই “Rehab: An American Scandal”-এ তুলে ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোর বাস্তবতা—যা প্রায়শই নিষ্ঠুরতা, শোষণ ও অব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরে।

যদিও বইটি আমেরিকান প্রেক্ষাপটে লেখা, কিন্তু এর প্রতিটি শব্দ ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্যও একটি সতর্ক বার্তা। মাদকাসক্তি আজ আর কেবল পশ্চিমা দেশের সমস্যা নয়—ভারতের গ্রাম, শহর, শিক্ষিত এবং বঞ্চিত সমাজ সবখানেই এটি ক্রমবর্ধমান হারে ছড়িয়ে পড়ছে। আমেরিকার মতো, ভারতেও সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতির অভাব, ব্যয়বহুল পরিষেবা এবং সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি একজন আসক্তকে পুনর্বাসনের পথে এগোতে বাধা দেয়।

ওয়াল্টার তার বইতে উল্লেখ করেছেন ‘সেনিকর’ নামের একটি মার্কিন নিরাময় কেন্দ্রের কথা, যেখানে রোগীদের মূলত শ্রমিকের মতো কাজে লাগানো হতো – সপ্তাহে ১০০ ঘণ্টা কাজ, কোন বেতন নেই, তীব্র গরমেও রেহাই নেই। এক তরুণ, ক্রিস কুন, যিনি ১৫ বছর বয়সে মাদকাসক্ত হন, এই নিরাময় কেন্দ্রের অভিজ্ঞতা থেকে সুস্থ হয়ে উঠে ওয়েল্ডিং স্কুলে গ্র্যাজুয়েট হন।

এই ‘সেনিকর’-এর মতো নিষ্ঠুরতা ভারতেও অচেনা নয়। বহু স্বঘোষিত ‘ডি-অ্যাডিকশন সেন্টার’-এ রোগীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ, জোরপূর্বক কাজ করানো, বা চিকিৎসার নামে অর্থ লুটপাটের অভিযোগ অনেক আছে — অথচ তদারকি প্রায় নেই।

ওয়াল্টার দেখিয়েছেন কিভাবে কিছু নিরাময় কেন্দ্র বিশাল অঙ্কের টাকা দাবি করে অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করিয়ে, সংবেদনশীল মানুষদের একটি চক্রের মধ্যে ফেলে দেয়—প্রথমে রিহ্যাব, তারপরে রিল্যাপস, আবার রিহ্যাব। ক্যালিফোর্নিয়ার এক ‘সোবার লিভিং’ হোম এত মানুষ রাখতো যে তাদের আঙিনাতেও খাট বিছানো হতো—শুধু মুনাফার জন্য।এটি যে কেবল আমেরিকার চিত্র তা নয়, এই অভিজ্ঞতা ভারতের অনেক তথাকথিত বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রের সাথেও মিলে যায়—যেখানে রোগী নিরাময়ের চেয়ে টাকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

পুনর্বাসন কেবল ওষুধ বা চিকিৎসা দিয়ে সম্ভব নয়—প্রয়োজন আশ্রয়, খাদ্য, চাকরি ও সম্মানজনক সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা। উদাহরণস্বরূপ, সাবক্সোন নামক ওষুধটি অনেক দেশে এটি নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ ।ভারতে মাদকাসক্তির চিকিৎসায় কার্যকর ওষুধ বহু ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থেকে যায়।

বইটিতে ক্রিস কুন এবং এপ্রিল লি-র কাহিনি দারুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কুন ভাগ্যবান ছিলেন—পরিবার পাশে ছিল, আর্থিক সাহায্য ছিল, শেষ পর্যন্ত ভালো জীবনে ফিরে যেতে পেরেছেন। কিন্তু এপ্রিল লি, যিনি ১৫ বছর বয়সে গর্ভবতী হন, পরিবারহীন, নিরক্ষর এবং নিজের সন্তানদের লালনপালনের সঙ্গে সঙ্গে মাদকাসক্তির সঙ্গে লড়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত নিজে GED (মাধ্যমিকের সমতুল্য) পাশ করে আবার নিজেকে গড়ে তুলেছেন।

ওয়াল্টার তার বইতে দেখিয়েছেন, মাদকাসক্তরা অপরাধী নন—তারা অনেক বেশি অসহায়, ভীত এবং চরমভাবে সাহায্যের প্রয়োজনে থাকা মানুষ। সমাজ যদি তাদের দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে না তাকায়, তবে চিকিৎসা বা আইন কিছুই তাদের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারবে না।

ভারতে মাদক সমস্যার জন্য যে কেবল পুলিশ দায়ী তা নয়—স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ দপ্তর, এবং পরিবারের সচেতনতা ও সহানুভূতিশীল ভূমিকা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসার ব্যবস্থা সহজ, সাশ্রয়ী এবং মানসিকভাবে সম্মানজনক না হলে, আসক্তরা চিকিৎসা চাইবেনই না।

শোশানা ওয়াল্টারের বই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—আসক্তদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে না পারলে আমরা আরও অনেক জীবন হারাতে থাকব। ‘Rehab: An American Scandal’ বইটি শুধুমাত্র একটি দেশের সংকট নয়, এটি একটি বৈশ্বিক বাস্তবতার দলিল। ভারতেও আজ প্রয়োজন এমন অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গির, যেটা আমাদের আসক্তি সমস্যা ও এর অনুপযুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার আসল রূপ উন্মোচন করবে। বইটি আমাদের শেখায়—আসক্তি একটি অসুখ, এবং অসুস্থ মানুষকে শাস্তি নয়, সাহায্যই পারে মুক্তির পথ দেখাতে।

সহানুভূতি যখন নীতির উপরে স্থান পায়, তখনই সত্যিকারের পরিবর্তন সম্ভব।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


সম্পাদকীয়-  রাজনৈতিক সহিংসতা ও আমাদের গণতন্ত্র

সেই দিনগুলো চলে গেছে যখন নেতারা তাদের প্রতিপক্ষকেও সম্মান করতেন। শাসক দলের নেতারা তাদের বিরোধী দলের নেতাদের কথা ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন।  আজ রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে।  কেউ কারো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়।  আগ্রাসন যেন রাজনীতির অঙ্গ হয়ে গেছে।  রাজনৈতিক কর্মীরা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খুন বা মানুষ মারার মত অবস্থার দিকে ঝুঁকছে। আমাদের দেশে যেন রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না।আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে বেশি মানুষ নিহত হচ্ছেন।  ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) অনুসারে, ২০১৪ সালে, রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৪০০ জন প্রাণ হারিয়েছিল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২০০০ জন মারা গিয়েছিল।  আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য গর্বিত হতে পারি, কিন্তু এটা সত্য যে আমাদের সিস্টেমে অনেক মৌলিক সমস্যা রয়েছে যা আমাদের গণতন্ত্রের শিকড়কে গ্রাস করছে, যার জন্য সময়মতো সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। .....বিস্তারিত পড়ুন

NASA Carbon Emission: পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে

উত্তরাপথঃ কার্বন নির্গমন (NASA Carbon Emission) সম্পর্কে নাসার সর্বশেষ আবিষ্কার পৃথিবীর জন্য এক সতর্কতা সংকেত। মহাকাশ সংস্থার মতে, পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে, যার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। NASA এর এই আবিষ্কারটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, সেইসাথে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেছে।নাসার সর্বশেষ গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে পৃথিবীর মহাসাগর এবং ভূমি-ভিত্তিক বাস্তুতন্ত্র আগের চেয়ে কম কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে গত এক দশকে ভূমি এবং মহাসাগর দ্বারা শোষিত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৫% হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

World’s most polluted cities: নয়াদিল্লি, মুম্বাই এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়

উত্তরাপথঃ দিওয়ালি উদযাপনের একদিন পর জাতীয় রাজধানী নয়াদিল্লি, মুম্বাই এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের (World’s most polluted cities) তালিকায় উঠে এসেছে।সোমবার, অর্থাৎ দীপাবলির পরের দিন এই শহরগুলির বায়ুর গুণমান উল্লেখযোগ্য মাত্রায় খারাপ হয়েছে।বায়ুর গুনমান খারাপ হওয়ার পেছনে মাত্রাতিরিক্ত আতশবাজি জ্বালানোকে দায়ী করা হয়েছে। আমাদের বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের (World’s most polluted cities) তালিকায় যথারীতি প্রথম স্থান দখল করেছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। দীপাবলির পরের দিন এটির AQI (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) পরিসংখ্যান ছিল ৪০৭। নভেম্বরের শুরু থেকে, দিল্লিতে AQI পরিসংখ্যান খারাপ হয়েছে।  সুইস গ্রুপ আইকিউএয়ার শহরের বাতাসকে "বিপজ্জনক" বিভাগে রেখেছে।ভারতের আর্থিক রাজধানী মুম্বাই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়(World’s most polluted cities), ১৫৭ এর AQI সহ ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। কলকাতা ১৫৪ এর AQI সহ সপ্তম স্থানে রয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

World Children's Day: সত্যিই কি ‘বিশ্ব শিশু দিবস´পালনের কোনও যৌক্তিকতা আছে ?

প্রীতি গুপ্তাঃ হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকটি দিন তারপর ১৪ নভেম্বর আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বজুড়ে  পালন করা হবে ‘বিশ্ব শিশু দিবস´(World Children's Day)।এই দিনটি শিশুদের মঙ্গলের জন্য, তাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি অনুকূল বিশ্ব তৈরি করার প্রচেষ্টার একটি দিন।কিন্তু প্রশ্ন,সত্যি কি হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সারা বিশ্ব জুড়ে শিশু দিবস পালন করার কোনও যৌক্তিকতা আছে? আদৌ কি এর কোনও লাভ আমরা আমাদের প্রান্তিক স্তরের শিশুদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি ? সম্প্রতি কাজের প্রয়োজনে রাজস্থানের উদয়পুর শহরে আসা। আমরা সবাই জানি উদয়পুর বিখ্যাত তার হ্রদের কারণে । এখানকার স্থানীয় থেকে পর্যটক সকলেই এই সুন্দর হ্রদগুলির আকর্ষণে বারবার ছুঁটে যায়। ‘ফতে সাহেব লেক’ রাজস্থানের উদয়পুরের এক বিখ্যাত পর্যটক স্থল।এখানে বহু মানুষ সকাল- বিকেল এই লেকের চার ধারে হাঁটাহাঁটি করতে বেরিয়ে পড়ে। সেভাবেই দুই দিন আগে বিকেলে হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়লাম ‘ফতে সাহেব লেকের ধারে হাঁটার উদ্দেশ্য নিয়ে। হাঁটার মাঝখানে হঠাৎ করে একটি বাচ্চাছেলে আওয়াজ করে ডাকছে ,বললাম কিছু বলবি? সে বলল একটু দাঁড়াতে। ও ছুটে গিয়ে হাতে করে কয়েকটি বেলুন নিয়ে এসে হাজির । সে বারবার বেলুন কেনার অনুরোধ জানাতে লাগল। হাতে অন্য কাজের চাপ নেই অনেকটা অবসর সময় তাই আমি অনেকটা সাংবাদিক সুলভ মন নিয়ে বললাম ঠিক আছে আমি তোর বেলুন নেব ,কিন্তু তার আগে আমি  তোকে যা বলব তার তার ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে। সে খুশী খুশী রাজি হয়ে গেল । .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top