

প্রিয়াঙ্কা দত্তঃ তাকে নিয়ে না জানি কত গান,কত কবিতা লেখা হয়েছে। না জানি কত রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ঘটে গেছে তার চাহিদায়। না জানি কত ইতিহাস লুকিয়ে তার বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদে। নামও তার গুণের মতোই অনেক। সে হলো আজ পর্যন্ত ব্যবহার হয়ে আসা প্রাচীনতম মশলা গুলির মধ্যে অন্যতম মহার্ঘ্য মশলা .. জাফরান (Saffron)বা কেশর। যে কেশর শ্রীকৃষ্ণের শ্রী বৃদ্ধি করত তাঁর কপালের তিলক হয়ে সেই আবার হয়ে উঠেছিল মিশরের রাণী ক্লিওপেট্রার অবগাহন আর অঙ্গরাগের প্রিয়তম উপাদান । বাদ যাননি সাইরাস বা আলেকজান্ডার দি গ্রেট বা নিরো। শরীর ও মন চাঙ্গা রাখতে তাঁরাও ভরসা রাখতেন কেশরের ওপরেই। আলেকজান্ডারের বাহিনী এশিয়া মহাদেশে যুদ্ধে এসে বিপুল পরিমানে জাফরান সংগ্রহ ও ব্যবহার করেছিল। মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা হয়ে আজ একবিংশ শতাব্দীতেও জাফরান বিরাজ করেছে স্বমহিমায়। একেই বোধহয় বলে আদি অকৃত্রিম রূপে বিরাজ করা।
আনুমানিক সাড়ে তিন হাজার বছর আগে যার পথ চলা শুরু সেই জাফরানের নামের উৎপত্তি নিয়েও বেশ ধন্ধ আছে। কেউ বলেন ইংরিজি সাফ্রন কথাটি এসেছে লাতিন শব্দ স্যাফরানাম থেকে আবার কেউ বলেন ফরাসি সাফরান থেকে জাফরান নামের আগমন। আরবীতে ‘কুরকুম’ আর সংস্কৃতে একে ‘কুমকুমম্’ নামে ডাকা হয়। কেশর আসলে জাফরান নামে সুন্দর হালকা বেগুনী রঙের ফুলের শুকিয়ে নেওয়া গর্ভমুন্ড।
এবার আসি জাফরানের সফরনামায়। জাফরান চাষের আঁতুড়ঘর সম্ভবত ইরান। তবে সাক্ষ্য প্রমাণের দিক দিয়ে দেখলে জাফরানের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক নিদর্শন মেলে প্রাক গ্রীক সভ্যতার ব্রোঞ্জ যুগের চিত্রকলায় আর ষোড়শ সপ্তদশ শতকের গ্রীক সভ্যতার কিছু ফ্রেস্কোতে । যেখানে দেখা যায় সম্ভ্রান্ত মহিলারা তাকে ওষধি হিসাবে প্রয়োগ করছেন বা দেবদেবীর উদ্দেশ্যে তা অর্পিত হচ্ছে। আদি গ্রীকদের মধ্যে বহু দুঃসাহসিক নাবিক পাড়ি জমান সুদূর সিসিলিয়া দ্বীপে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান এই মশলা আমদানির উদ্দেশ্যে। ইরাকেও এক প্রাগৈতিহাসিক যুগের গুহাচিত্রে জাফরান থেকে তৈরি প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহারের হদিশ মিলেছে। খ্রিস্টপূর্ব দশম শতকে পারস্যে জাফরান চাষ হতো। পার্সি কার্পেট আর তাদের শেষকৃত্যের কাপড় বুনতে জাফরানি সুতো ব্যবহার করা হতো। বাদ নেই সুমেরীয় সভ্যতাও। সেখানে ওষুধ ও জাদুবিদ্যার জাফরানের বহুল ব্যবহার ছিল। তবে তা চাষের দ্বারা উৎপাদিত হতো না। কারণ সুমেরীয়রা বিশ্বাস করত যে, এই ফুল দৈব মহিমা সম্পন্ন তাই একে বন থেকেই সংগ্রহ করা হতো।পরবর্তীকালে যদিও বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রজাতির জাফরান চাষ করা শুরু হয় কিন্তু ভারতের কাশ্মীরের কেশর এখনও তার বিশেষ লাল রং , সুগন্ধ আর স্বাদের জন্য জগৎ বিখ্যাত ।
জাফরান কে নিয়ে গল্পের শেষ নেই। হেলেনীয় রূপকথায় জাফরান হয়ে উঠেছে অনন্ত ও অস্বীকৃত বিফল প্রেমের প্রতীক। সলমনের গীতমালা বা Songs of Solomon এও জাফরানের উজ্জ্বল উপস্থিতি নজর কাড়ে। হিন্দি চলচ্চিত্রের গানে আজও শোনা যায় সেই ধ্বনি…”কেশরিয়া তেরা ইশক হ্যায় পিয়া”.. কিংবা বহু পুরোনো ক্লাসিক ” কেশরিয়া বালমা পধারো মারো দেশ। ” এই আবেদন যেন চিরন্তন।
ভারতবর্ষে জাফরানের আমদানি বা চাষ সম্পর্কেও বহু লোকগাথা প্রচলিত আছে। কাশ্মীরিদের মতে , দুই সুফি সন্ত , খাজা মাসুদ ওয়ালি ও হযরত শেখ সারিফুদ্দিন একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীতে কাশ্মীর এসে জাফরান চাষ ও ব্যবহার প্রচলন করেছিলেন। শোনা যায়, এই দুজন সন্ত ভারতে এসে একসময় অসুস্থ হয়ে পড়েন ও তাঁদের সঙ্গে থাকা জাফরানের বদলে সেখানকার এক উপজাতি নেতার কাছ থেকে ওষুধ সংগ্রহ করেন। এভাবেই কাশ্মীরে জাফরানের চাষ শুরু হয়। এখনো শরৎকালে জাফরান চাষের মরশুমে এই দুই সন্তের উদ্দেশ্যে পূজা অর্চনা করা হয়। কাশ্মীরের ‘জাফরান রাজধানী’ পাম্পোর গ্রামে তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি সোনালি স্তম্ভ নির্মিত হয়েছে । তবে কাশ্মীরি কবি ও শিক্ষাবিদ মোঃ ইউসুফ এর মতে প্রায় ২ হাজার বছর আগে কাশ্মীরে জাফরানের চাষ শুরু হয়।এখানেই শেষ নয়। আদি চাইনিজ বৌদ্ধ ধর্মে ভারতে জাফরান আমদানির অন্য এক কাহিনী বর্ণিত আছে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে এক ভারতীয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী মধ্যন্তিকা কাশ্মীর যাত্রা করেন। তিনিই নাকি সেখানে প্রথম জাফরানের বীজ বপন করেন । আর তার থেকেই উপমহাদেশে জাফরান চাষের বিস্তার। কয়েকজন ঐতিহাসিক এর মতে মঙ্গোলীয় অভিযাত্রীরা পারস্য হয়ে চীনের যাত্রা করার সময় জাফরান সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। গল্প যাই হোক না কেনো মোট কথা জাফরান তার রূপ রস গন্ধ নিয়ে বিচরণ করেছে সারা বিশ্বে।
জাফরানের গুণাগুণ বর্ণনা করতে গেলে তা শেষ করা মুশকিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জাফরান বিভিন্ন দেশে বা সভ্যতায় রোগের মহৌষধি রূপে বিরাজ করেছে। মিশরীয় চিকিৎসকরা অন্ত্রের অসুখ ও রক্তস্রাব এর চিকিৎসা করতেন জাফরান দিয়ে।প্রাচীণ চৈনিক গ্রন্থে জাফরানের ঔষধি গুণের বর্ণনা মেলে। গ্রীক ও রোমানরা মূলত একে সুগন্ধী রূপে ব্যবহার করতেন। ভারতীয় উপমহাদেশে জাফরান রঞ্জক পদার্থ হিসাবে আর খাদ্যে সুগন্ধী মশলা হিসাবে প্রয়োগ করা হয়। চতুর্দশ শতকে ফ্রান্সের একটি রান্না সম্পর্কিত গ্রন্থে খাদ্যে জাফরানের ব্যবহার বর্ণিত হয়েছে। প্রচুর এন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ জাফরান আজকের দিনের হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন ও কোলেস্টেরল এর চিকিৎসায় খুবই কার্যকরী। বার্ধক্য রোধে এর জুড়ি মেলা ভার। তবে সব ক্ষেত্রেই ভাগ মাপের একটা ব্যাপার থেকেই যায়। ১৩৪৭-৫০ সালে সারা ইউরোপ যখন ব্ল্যাক ডেথ বা প্লেগ মহামারীতে আক্রান্ত, ইউরোপের অভিজাতরা তখন নিজেদের মধ্যে জাফরান যুদ্ধে ব্যস্ত। কারণ তার যোগান তখন কমে গেছিল। এই যুদ্ধ নাকি দুসপ্তাহ ধরে চলেছিল। এমন চাহিদা আর কার থাকে?
নয়া বিশ্বে জাফরান চাষের মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠে আমেরিকার পেনসিলভেনিয়া অঞ্চল। তার আগে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সেও এর চাষ জনপ্রিয় ছিলো। ভারত জাফরান উৎপাদনে বর্তমানে চতুর্থ স্থানে আছে। ২০১০-১১ সালে জাফরানের ফলন বেড়ানোর উদ্দেশ্যে ন্যাশনাল স্যাফরন মিশন(NSM) শুরু হয় ও দেশের উত্তর -পূর্বাঞ্চলে জাফরান চাষের সিধান্ত নেওয়া হয়। ২০২০ সালে এই প্রকল্প আবার পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এখন তো জম্মু কাশ্মীর ইউনিভার্সিটির উদ্যোগে বাড়িতে বসে জাফরান চাষে সফলতা মিলেছে। বর্তমানে কর্ণাটক, মহারাষ্ট্রে ও জাফরান চাষে সফলতা মিলেছে।
জাফরান(Saffron) চাষ ও সংগ্রহ একটি নিবিড় শ্রমসাধ্য প্রক্রিয়া। মাত্র তিন মাসের মাথায় জাফরান চাষ ও সংগ্রহ করা হয। এক কেজি জাফরানের মূল্য তিন থেকে চার লক্ষ টাকা। আর এক কেজি কেশর উৎপাদন করতে প্রায় ১৬০০০০ কেজি জাফরান সংগ্রহ করতে হয়। বর্তমানে ইরানেই এর নব্বই শতাংশ উৎপন্ন হয়। তবে কাশ্মীরি জাফরানের চাহিদা সারা বিশ্বব্যাপী। রাসায়নিক মুক্ত প্রক্রিয়াকরণ ও এর বিশেষ স্বাদ,বর্ণ আর গন্ধ একে এনে দিয়েছে জিওগ্রাফিকাল ইনডেক্স (G I Tag)এর সম্মান। আধুনিক কৃষি বিদ্যায় ক্রমেই জাফরানের লাভজনক চাষ নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে।জাফরানের এই দীর্ঘ পথ চলা বোধহয় আমাদেরকে এটাই শেখায় যে, বিশুদ্ধতার কোনও বিকল্প নেই আর তার কোনও ক্ষয় ও নেই।
আরও পড়ুন
হিউম্যানয়েড রোবট ARTEMIS রেডি পরবর্তী RoboCup-এর জন্য
অনয় কিরণ মাহাতো: কেমন যেন লাগে রোবট এর কথা শুনলে। তারপরে আবার হিউম্যানয়েড, ভাবা যায়। হিউম্যানয়েড রোবট এক জটিল anthropomorphic কৃত্রিম মেশিন যা রোবোটিক্স, লোকোমোশন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) এই হিউম্যানয়েড রোবর্ট এর বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছে। ১৮১০ সালে জার্মানির ফ্রেডলিচ কাউফম্যানন প্রথম তৈরি করেছিলেন এক ট্রাম্পেট সৈনিক রোবর্ট। এরপর হুমানোইড রোবর্ট তৈরি করেন আরবের একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আল-যাজরি। এরপর লিওনার্দো দা ভিঞ্ছির আদলে জাপানের ওসাকা ইউনিভার্সিটির প্রোফেসর ঈশিগুর .....বিস্তারিত পড়ুন
কতো অজানা রে
মৈত্রেয়ী চৌধুরী: ইতিহাস বিষয়ে আলোচনা করতে গেলেই আমাদের মনে যে সব সৌধের প্রসঙ্গ মনে আসে তারমধ্যে পার্লামেন্ট ভবন একটা অবশ্য দ্রষ্টব্য স্থান। বহু পর্যটক এই ভবন দেখতে যান. কিন্তু জানেন কি, এই পার্লামেন্ট ভবনের ডিজাইন কে বানিয়েছিলেন ? 10 জনকে জিজ্ঞেস করলে 9 জনই বলতে পারবেন না। যাঁরা খুব ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন অথবা গুগুল সার্চ করে থাকেন, তাঁরা হয়তো উত্তরটা দিতে পারবেন। পার্লামেন্ট ভবনের ডিজাইন বানিয়েছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ স্থপতি এডুইন লুটিয়েন। তাঁর সহকারী ছিলেন আরেক ব্রিটিশ স্থপতি হার্বার্ট বেকার। 1927 খ্রিস্টাব্দে এই ভবনটির নির্মাণ সম্পূর্ণ হয় এবং ব্রিটিশ .....বিস্তারিত পড়ুন
মণিপুরের সামগ্রিক উন্নয়ন বর্তমান সমস্যার সমাধান হতে পারে
উত্তরাপথ: মণিপুরের মেইতি সম্প্রদায় তফসিলি উপজাতির তালিকায় তাদের অন্তর্ভুক্তির দাবি অব্যাহত রাখবে এবংআন্দোলন তীব্রতর করবে বলে খবর। অন্যদিকে ট্রাইবাল সলিডারিটি মার্চ, কিছু পাহাড়ি উপজাতির একটি তড়িঘড়ি তৈরি করা ছাতা সংগঠন,তারা মেইতি সম্প্রদায়ের দাবির বিরোধিতা করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাই পরিস্থিতি আরও অস্থির হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।অন্যদিকে আরেকটি সূত্র বলছে মণিপুরের পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে। যদিও এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর সহায়তা নিচ্ছে রাজ্য সরকার। কিন্তু এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে দীর্ঘ .....বিস্তারিত পড়ুন
হয়ে গেল পরিণীতি ও রাঘবের এনগেজমেন্টে
উত্তরাপথ: আংটি বদলের মাধ্যমে হয়ে গেল পরিণীতি চোপড়া ও রাঘব চাড্ডার এনগেজমেন্টে । পরিবার ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের উপস্থিতিতে একে-অপরকে আংটি পরিয়ে দিলেন রাঘব-পরিণীতি। শনিবারের মায়াবী সন্ধ্যায় রাঘব ও পরিণীতির জুটি থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না। এনগেজমেন্টে পরিণীতি পরেছিলেন ক্রিম রঙের সালোয়ার স্যুট। অপরদিকে রাঘব পরেছিলেন সাদা রঙের কুর্তা-পায়জামা। পরিণীতি ও রাঘবের এনগেজমেন্টে তাদের গোটা পরিবারকে দেখা গেল আনন্দ করতে। .....বিস্তারিত পড়ুন