

উত্তরাপথঃ আমরা প্রায় সকলেই ছোটথেকে শুনে আসছি যে আমাদের প্রতিদিন আট গ্লাস জল পান করা উচিত – অর্থাৎ প্রায় আধা গ্যালন (২ লিটার) তরল। এই দাবিটি ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে, কিন্তু আসলে কি এটি কেবল একটি মিথ? এই প্রবন্ধে এই সুপারিশের উৎপত্তি কোথা থেকে এবং আমাদের প্রতিদিন আসলে কতটা জল পান করা উচিত তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
একটি মিথের সৃষ্টি
আমাদের প্রচুর পরিমাণে জল পান করা উচিত এই ধারণাটি ভিনসেন্ট প্রিসনিটজের কাছ থেকে এসেছে বলে জানা যায়। ভিনসেন্ট প্রিসনিটজ হলেন একজন অস্ট্রিয়ান কৃষক যিনি একটি দুর্ঘটনার পড়েন এবং সেই সময় তিনি নিজেকে ভেজা ব্যান্ডেজ ব্যবহার করে এবং প্রচুর পরিমাণে জল পান করে নিজেকে সুস্থ করেছিলেন। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে হাইড্রোথেরাপি “প্রকৃতি-নিরাময়” আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলেন ।সেই সময় ঠান্ডা জল পান করা, এতে স্নান করা, এতে ভিজানো কাপড় কম্প্রেস করা – বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। ভিনসেন্ট প্রিসনিটজ তার রোগীদের দিনে ১২ থেকে ৩০ গ্লাস পান করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
আট গ্লাস জল পানের ধারণা
কিন্তু আমাদের প্রতিদিন আট গ্লাস জল পান করা উচিত এই সাম্প্রতিক ধারণাটি প্রায়শই ডঃ আরউইন স্টিলম্যানের ১৯৬০-এর দশকের জনপ্রিয় ডায়েটের সাথে সম্পর্কিত, যদিও মার্কিন খাদ্য ও পুষ্টি বোর্ড প্রথম এটি নিয়ে আসে ১৯৪৫ সালে, বোর্ড সুপারিশ প্রকাশ করে যে মার্কিন নাগরিকদের প্রতি ক্যালোরি খাবারের জন্য ১ মিলি জল পান করা উচিত। যে ব্যক্তি প্রতিদিন প্রায় ২০০০ ক্যালোরি গ্রহণ করেন, তার জন্য প্রতিদিন ৮ গ্লাস জল পান জরুরী। কিন্তু, বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এই দাবিকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে না। *আমেরিকান জার্নাল অফ ফিজিওলজি* তে প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে, ব্যক্তিভেদে জলের চাহিদা ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে । একজন ব্যক্তির কতটা জল গ্রহণ করা প্রয়োজন তা নির্ণয় করার ক্ষেত্রে বয়স, কাজকর্মের ধরন এবং জলবায়ুর মতো বিষয়গুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আপনার আসলে কতটা জল প্রয়োজন?
ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেস, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেডিসিন হাইড্রেশনের জন্য আরও ব্যক্তিগতকৃত পদ্ধতির পরামর্শ দেয়। তারা পুরুষদের জন্য প্রায় ৩.৭ লিটার (অথবা প্রায় ১৩ কাপ) এবং মহিলাদের জন্য ২.৭ লিটার (অথবা প্রায় ৯ কাপ) সকল পানীয় এবং খাবারের মিশ্রণ থেকে জল পান করার পরামর্শ দেয়। এর অর্থ হল আপনার সমস্ত হাইড্রেশনের চাহিদা পূরণের জন্য সাধারণ জল পান করার প্রয়োজন নেই। অনেক খাবার, বিশেষ করে ফল এবং শাকসবজিতে উচ্চ পরিমাণে জল থাকে এবং এটি আপনার দৈনন্দিন জলের চাহিদা পূরনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জলের চাহিদাকে প্রভাবিত করে এমন কারণগুলি
১. কাজকর্মের ধরণ- আপনি যদি ব্যায়াম করেন বা শারীরিক ক্রিয়াকলাপে নিযুক্ত হন, তাহলে ঘামের মাধ্যমে শরীর থেকে বেড়িয়ে যাওয়া তরল পদার্থের প্রতিস্থাপনের জন্য আপনার অতিরিক্ত জলের প্রয়োজন হতে পারে ।
২.জলবায়ু: গরম বা আর্দ্র আবহাওয়া আপনার জলের চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। ঠান্ডা আবহাওয়ায় জল গ্রহণের পরিমাণ কমে যায় যা শূন্যতার ঝুঁকি বাড়তে পারে।
৩. স্বাস্থ্যের অবস্থা: জ্বর বা সংক্রমণের মতো কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা আপনার জলের চাহিদা বাড়িয়ে দিতে পারে ।
৪. খাদ্য: লবণ বা চিনিযুক্ত খাবার বেশি খেলে পানির চাহিদা বেড়ে যেতে পারে। বিপরীতে, ফল এবং শাকসবজি সমৃদ্ধ খাবার অতিরিক্ত জল সরবরাহ করতে পারে।
আপনার শরীরের কথা শুনুন
আপনার জলের চাহিদা নির্ধারণের অন্যতম সেরা উপায় হল আপনার শরীরের কথা শোনা। তৃষ্ণা একটি প্রাকৃতিক সূচক যা নিশ্চিত করে আপনার আরও জল প্রয়োজন। অতিরিক্তভাবে, প্রস্রাবের রঙ আপনাকে পথ দেখাতে পারে; হালকা হলুদ সাধারণত সঠিক জল পানের ইঙ্গিত দেয়, অন্যদিকে গাঢ় হলুদ জল পানের ইঙ্গিত দেয় যে আপনার আরও বেশি জল পান করার প্রয়োজন ।
কিন্তু সাধারণত যখন আপনার ইচ্ছা না থাকে তখন জল পান করার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ তৃষ্ণার্ত না থাকলে পান করার জন্য বেশি শারীরিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে করা মস্তিষ্কের ইমেজিং গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি জল পান করা অপ্রীতিকর মনে হয়।তবে অন্যকোনও শারীরিক সমস্যা না থাকলে অতিরিক্ত জল পান করা সাধারণত বিপজ্জনক নয়। বেশিরভাগ সময়, আপনি কেবল আপনার প্রস্রাবের মাধ্যমে এটি থেকে মুক্তি পাবেন।
যদিও আট গ্লাসের নিয়মটি একটি জনপ্রিয় নির্দেশিকা ,তবে যদি আপনি তৃষ্ণার্ত বোধ করেন, তাহলে জল পান করুন অথবা তরমুজ জাতীয় জলজ ফল খান। যদি তা না পান করেন, তাহলেও চিন্তার কিছু নেই আরাম করুন। আপনার জন্য জল পানের কোনও কঠিন লক্ষ্য নেই যা পূরণ করা উচিত।
সূত্রঃ
- en.wikipedia.org/wiki/Vincenz_Priessnitz
- naturecure.org.in/hydrotherapy/
- livestrong.com/article/83808-stillmans-diet/
- usgs.gov/special-topics/water-science-school/science/water-you-water-and-human-body
- doi.org/10.1056/NEJM199905063401803
- doi.org/10.1002/(sici)1097-0215(19990812)82:4<484::aid-ijc3>3.0.co;2-a
- doi.org/10.1093/aje/155.9.827
- doi.org/10.1017/S0007114513004455
- doi.org/10.1016/j.appet.2016.11.011
- doi.org/10.1007/s00421-012-2506-6
- doi.org/10.1016/j.jocn.2020.05.034
- pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/33459627/
- jamanetwork.com/journals/jamainternalmedicine/fullarticle/2705079
- doi.org/10.1016/j.jped.2017.01.005
- doi.org/10.1111/srt.12454
- doi.org/10.1016/j.jshs.2014.09.004
- doi.org/10.20960/nh.02746
- doi.org/10.3390/nu11010070
- doi.org/10.1370/afm.1951
- newsnetwork.mayoclinic.org/discussion/womens-wellness-drink-water-to-fight-those-utis/
- au.thorzt.com/Article/153/dehydration-risks-may-increase-with-cold-weather
- journals.lww.com/acsm-essr/Fulltext/2007/07000/Caffeine,_Fluid_Electrolyte_Balance,_Temperature.8.aspx
- journals.physiology.org/doi/abs/10.1152/ajpregu.1982.242.5.R522
- healthline.com/nutrition/19-hydrating-foods#TOC_TITLE_HDR_20
- chegg.com/learn/biology/nutrition/metabolic%20water
- pnas.org/doi/full/10.1073/pnas.1613929113
- pnas.org/doi/full/10.1073/pnas.1403382111
- jmedicalcasereports.biomedcentral.com/articles/10.1186/1752-1947-6-376
- ajp.psychiatryonline.org/doi/abs/10.1176/ajp.140.7.915
- journals.physiology.org/doi/abs/10.1152/ajprenal.1992.262.6.F989
আরও পড়ুন
সেলফির উচ্চ রেটিং কি আপনাকে আরওপাতলা হতে উৎসাহিত করছে ?
উত্তরাপথঃ সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে সেলফি তোলা এবং নিজেকে পাতলা হিসাবে দেখানোর মধ্যে একটি সম্পর্ক থাকতে পারে। যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক সেন্ট জন ইউনিভার্সিটির রুথ নাইট এবং ইউনিভার্সিটি অফ ইয়র্কের ক্যাথরিন প্রেস্টন সম্প্রতি PLOS ONE জার্নালে তাদের ফলাফল প্রকাশ করেছেন।সেখানে সেলফির উচ্চ রেটিং এবং আমাদের শরীরের গঠনের মধ্যে যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ায় সেলফি হল এক জনপ্রিয় ছবি দেওয়ার ধরন। যিনি সেলফি তোলেন তিনি ক্যামেরাকে তাদের শরীর থেকে দূরে রেখে নিজেই নিজের ছবি তোলে। আগের গবেষণায় বলা হয়েছে সেলফিগুলি দেখার ফলে ছবির বিষয়গুলি সম্পর্কে দর্শকদের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন
দীপাবলির সময় কেন পটকা ফোটানো নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা যায় না ?
উত্তরাপথঃ দীপাবলির পরের দিন, যখন কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (CPCB) শহরের বায়ু মানের সূচকের তালিকা প্রকাশ করে,তখন দেখা যায় রাজধানী দিল্লি বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দূষিত শহরের প্রথমেই রয়েছে। CPCB-এর মতে, ১২ নভেম্বর বিকেল ৪ টায় দিল্লির বায়ু মানের সূচক ছিল ২১৮ যা ভোরের দিকে বেড়ে ৪০৭ এ পৌঁছায় । ৪০০ – ৫০০ AQI এর স্তর সুস্থ ব্যক্তিদের প্রভাবিত করে। দীপাবলির সারা রাত, লোকেরা পটকা ফাটিয়ে দীপাবলি উদযাপন করে। ১৩ নভেম্বর বিকেল ৪ টায় কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ আবার তথ্য প্রকাশ করে এই তালিকায়, দিল্লির গড় বায়ু মানের সূচক ছিল ৩৫৮ যা 'খুব খারাপ' বিভাগে পড়ে। বায়ু দূষণের এই পরিস্থিতি শুধু দিল্লিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। নয়ডার বায়ু মানের সূচক ১৮৯ থেকে ৩৬৩ এ এবং রোহতক, হরিয়ানার ১৩৭ থেকে বেড়ে ৩৮৩ হয়েছে। দীপাবলির দুই দিন দিল্লি ,নয়ডা ,কলকাতা, মুম্বাই সহ দেশের অন্যান্য শহরেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। এই দিনগুলিতে মানুষ বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে বাধ্য হয়েছে। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জাতীয় রাজধানী দিল্লি এবং নয়ডায় সবুজ পটকা ছাড়া যে কোনও ধরণের আতশবাজি ফাটান সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ। আদালত সবুজ পটকা পোড়ানোর সময়ও নির্ধারণ করে দিয়েছে রাত ৮টা থেকে ১০টা। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশের মানে কী? আদালতের এই আদেশ কি এখন প্রত্যাহার করা উচিত? পুলিশ কেন এই আদেশ কার্যকর করতে পারছে না? এর জন্য কি পুলিশ দায়ী নাকি সরকারের উদাসীনতা রয়েছে এর পেছনে? .....বিস্তারিত পড়ুন
Karar Oi Lauh Kapat: কাজী নজরুলের এই গানকে ঘিরে বিতর্কে এ আর রহমান
উত্তরাপথঃ বিতর্কে 'পিপ্পা' ছবির সঙ্গীত পরিচালক অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান।সম্প্রতি কবি কাজী নজরুল ইসলামের পরিবার একটি হিন্দি ছবিতে কবির জনপ্রিয় গান 'করার ঐ লৌহ কাপাত...' (Karar Oi Lauh Kapat )।কিন্তু এ আর রহমানের সঙ্গীত পরিচালনায় ওই গানটি যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে আপত্তি জানিয়েছে নজরুল পরিবার।বিতর্কের পর যে চুক্তির আওতায় ওই গানটি ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে তা প্রকাশ্যে আনার দাবি তুলেছে কবির পরিবার।'পিপ্পা' শিরোনামের হিন্দি চলচ্চিত্রটি যেখানে (Karar Oi Lauh Kapat )গানটি ব্যবহার করা হয়েছে তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া একজন ভারতীয় সেনা সৈনিককে কেন্দ্র করে একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। ছবির সঙ্গীত পরিচালক অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান। গানের কথা ঠিক রেখেও সুর পাল্টানোর অভিযোগে ভারত ও বাংলাদেশে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।কবির পরিবারের অভিযোগ, গানটি ব্যবহারের অনুমতি দিলেও সুর পরিবর্তনের অনুমতি দেওয়া হয়নি।পরিবারের সদস্যরাও ছবিটি থেকে গানটি বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। .....বিস্তারিত পড়ুন
রাতের ঘামের সমস্যা এবং এ সম্পর্কে আপনি কি করতে পারেন
উত্তরাপথঃ রাতের ঘামের সমস্যা শরীরের কুলিং সিস্টেমের একটি স্বাভাবিক অংশ, তাপ মুক্তি এবং সর্বোত্তম শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে।তবে রাতের ঘাম একটি সাধারণ সমস্যা যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে।এর অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্য ঘুম ব্যাহত হতে পারে, যার ফলে ক্লান্তি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। আপনি যদি রাতে অতিরিক্ত ঘাম অনুভব করেন, তাহলে তার অন্তর্নিহিত কারণটি চিহ্নিত করা এবং এটি মোকাবেলার জন্য কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রাতের ঘামের কিছু সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করা হল।মেনোপজ: যে কেউ, বয়স বা লিঙ্গ নির্বিশেষে, রাতের ঘাম অনুভব করতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন