গাজা সিটি ঘিরে নতুন সংঘাত: ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের মোড় কোথায়?

উত্তরাপথঃ প্রায় দুই বছর ধরে চলতে থাকা ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ আবারও নতুন মাত্রা পেল। বুধবার ইসরায়েল ঘোষণা করেছে, তারা গাজা সিটি দখলের লক্ষ্যে অভিযানের প্রথম ধাপ শুরু করেছে। এরই মধ্যে কয়েক হাজার রিজার্ভ সৈন্যকে ডাকা হয়েছে। তবে এদিকে যুদ্ধবিরতির নতুন প্রস্তাব নিয়ে চলছে আলোচনাও। এই দুই বিপরীতমুখী পদক্ষেপ এখন গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে।

গাজা সিটি বহুদিন ধরেই হামাসের রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। ইসরায়েলি সেনাদের দাবি, শহরের ভেতর অসংখ্য সুড়ঙ্গ, অস্ত্র মজুতঘর ও কমান্ড সেন্টার রয়েছে। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফ্রিন সরাসরি বলেন:
হামাস এখন একটি বিধ্বস্ত গেরিলা বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। আমরা গাজা সিটির গভীরে ঢুকে তাদের শক্ত ঘাঁটি ভেঙে দেব।”

তবে বাস্তবে শহরটি এখন এক মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। হাসপাতাল, স্কুল, এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও আর নিরাপদ নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আশঙ্কা করছে, নতুন হামলা হলে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ গৃহহীন ও হতাহত হবে।

হামাস সম্প্রতি একটি ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। এতে কিছু অপহৃতকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে ইসরায়েলে আটক ফিলিস্তিনি বন্দিদের ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নেতানিয়াহুর সরকার বলছে— সব অপহৃতকে একসঙ্গে মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ থামবে না।এই দ্বন্দ্বই এখন আলোচনার মূল বাধা। মধ্যস্থতাকারী আরব দেশগুলো সময় চাইছে, কিন্তু ইসরায়েলি সরকার যুদ্ধবিরতির চেয়ে সামরিক অভিযানে বেশি জোর দিচ্ছে।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজায় এখন পর্যন্ত ৬২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। কয়েক লক্ষ্য মানুষ গৃহহীন হয়ে শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই নিয়েছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলায় ১,২০০ মানুষ নিহত হয়েছিল এবং ২৫১ জনকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে তাদের মধ্যে প্রায় ২০ জন জীবিত বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে— যুদ্ধ শুধু হামাসকে দুর্বল করছে না, বরং গোটা ফিলিস্তিনি জনগণকেই ধ্বংস করছে।

ইসরায়েলের অনেক ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, গাজা সিটি দখলের পরিকল্পনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা নেতানিয়াহুকে অন্তত অস্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে বলছে।

কিন্তু নেতানিয়াহু ভেতরে ভেতরে প্রবল রাজনৈতিক চাপে আছেন। তার জোটের ডানপন্থী অংশ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, এমনকি গাজা দখল করে সংযুক্ত করার পক্ষপাতী। অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ ইতিমধ্যেই পশ্চিম তীরে নতুন বসতি নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছেন— যা ভবিষ্যতের স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে কার্যত মুছে দিচ্ছে।

সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ৫৮% মানুষ চান জাতিসংঘের সব দেশ ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিক।
অন্যদিকে, ইসরায়েলি জনমতও বিভক্ত। অনেকেই মনে করেন, যদি অপহৃতদের মুক্তি নিশ্চিত হয় তবে যুদ্ধ থামানো উচিত। তেলআবিবে এ নিয়ে বিশাল সমাবেশও হয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়—

  • ইসরায়েল সামরিক পথে হামাসকে পুরোপুরি ভেঙে দিতে চাইছে।
  • হামাস যুদ্ধবিরতি চাইছে কিন্তু পুরো যুদ্ধ শেষ করতে নয়, বরং পুনর্গঠনের সময় পেতে।
  • আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শান্তি চাইলেও কার্যকর চাপ প্রয়োগে ব্যর্থ।

ফলে গাজা সিটি ঘিরে যে সংঘাত শুরু হয়েছে, তা মধ্যপ্রাচ্যে আরও দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। আর এর সবচেয়ে বড় খেসারত দেবে সাধারণ ফিলিস্তিনি জনগণ, যাদের জীবনের প্রতিটি দিন এখন যুদ্ধ আর অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটছে।

 গাজা সিটি শুধু এক যুদ্ধক্ষেত্র নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ রাজনীতির লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এখানেই ঠিক হবে— শান্তির আলো ফুটবে নাকি যুদ্ধের অন্ধকার আরও দীর্ঘ হবে।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে

উত্তরাপথঃ হঠাৎ করেই একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে।২০২৩ এর ৩০ অক্টোবর  প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি মৃত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত একটি নতুন দ্বীপের জন্ম দিয়েছে। বিস্ফোরণের পর জাপানের ওগাসাওয়ারা দ্বীপ চেইনের কাছে বিশাল বিশাল পাথরের টুকরো দেখা গেছে। এ বিষয়ে জাপানি গবেষক বলেন, গত মাসে প্রশান্ত মহাসাগর জলের নিচে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের পর টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে ইওটো দ্বীপের কাছে একটি ছোট নতুন দ্বীপের উদ্ভব হয়েছে।টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ফুকাশি মায়েনো জানিয়েছেন যে নতুন দ্বীপ, এখনও যার নাম নেই প্রশান্ত মহাসাগরের ইওটো দ্বীপ থেকে ১ কিলোমিটার দূরে ১০০ মিটার ব্যাসের একটি পাথুরে দ্বীপে একটি phreatomagmatic বিস্ফোরণ ঘটেছে। টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে বিস্ফোরণটি দেখা গেছে। ভূপৃষ্ঠের নীচে জলের সাথে লাল গরম ম্যাগমা সংঘর্ষের কারণে প্রতি কয়েক মিনিটে বিস্ফোরণ ঘটে।গত ২১ অক্টোবর, ২০২৩-এ অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছিল, যা আগে ইও জিমা নামে পরিচিত ছিল এবং এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্থান ছিল। প্রায় ১০ দিন ধরে অগ্ন্যুৎপাত চলার পর, আগ্নেয়গিরির উপাদান অগভীর সমুদ্রতলের উপর জমা হয় এবং প্রায় ১৬০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় বড় বড় পাথরের আকারে সমুদ্র পৃষ্ঠের উপরে উঠে আসে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Roop Kishor Soni: একটি আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য তুলে ধরেছেন

উত্তরাপথঃ রাজস্থান মানেই ওজনদার রূপার গহনা ,আর তার উপর কারুকাজ। প্রচলিত এই ধারনা ভেঙ্গে আজ রূপোর গহনাকে আধুনিকতার সাথে শিল্পের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন যে ব্যক্তি তিনি হলেন রূপ কিশোরী সোনী(Roop Kishor Soni)।তিনি ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে তার অসাধারণ শিল্প কর্মের জন্য জাতীয় পুরুস্কার পান। রাজস্থানের জয়সলমেরের শহরের এই শিল্পী ৩.৮ গ্রাম ওজনের ০.৯ সেমি চওড়া রৌপ্য আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য খোদাই করেছেন।এই ছোট রূপার আংটিতে শিল্পী তাজমহল, সিডনি অপেরা হাউস, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, চীনের গ্রেট ওয়াল, আইফেল টাওয়ার, বিগ বেন, পিসার হেলানো টাওয়ার এবং মিশরীয় পিরামিডের চিত্র এক সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন।এছাড়াও তিনি আরও দুটি পৃথক ডিজাইনের অত্যাশ্চর্য আংটি  তৈরি করেছেন।৮.৬ গ্রাম ওজনের একটি রিংয়ে তিনি সূর্যাস্তের সময় ভারতীয় উট সাফারি সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভারতীয় বিশেষত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন,এবং অন্যটিতে বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবী ছবি এবং মন্দির খোদাই করেছিলেন। শিল্পী বলেছেন যে তিনি তার বাবার কাছ থেকে তার শৈল্পিক দক্ষতা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সেই সাথে তিনি বলেন "আমার বাবাও একজন জাতীয় পুরুস্কার প্রাপ্ত শিল্পী ছিলেন। তিনি আমাকে শিল্পের এই দক্ষতা শিখিয়েছিলেন কারণ তিনি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে শিল্পের ফর্মটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।" .....বিস্তারিত পড়ুন

Vijay Stambh : চিতোরগড় দুর্গে বিজয় স্তম্ভ হিন্দু – মুসলিম সহাবস্থানের প্রতীক

উত্তরাপথঃ খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে মৌর্য রাজবংশ কর্তৃক স্থাপিত চিতোরগড় দুর্গ সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গ তার বিশাল কাঠামো, রাজপ্রাসাদ, একাধিক  সুদৃশ্য মন্দির সহ সুন্দর জলাশয়ের জন্য বিখ্যাত।৭০০-একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এই দুর্গটিতে প্রায় ৬৫টি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে যা রাজপুত এবং ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীর সূক্ষ্মতার প্রমান দেয়। বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh)) হল এই দুর্গে অবস্থিত,সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কাঠামো।এই আশ্চর্য-অনুপ্রেরণামূলক স্তম্ভটি কেবল তার উচ্চতার জন্য বিখ্যাত নয়,এটি রাজপুতদের অদম্য সাহস এবং অধ্যবসায়ের গল্পও বলে যা চিতোরগড় দুর্গেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে।বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh), নাম থেকে বোঝা যায়, বিজয়ের প্রতীক।  প্রাচীনকালে যে কোনো যুদ্ধ অভিযানের সাফল্যের পর সেই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে রাজারা মন্দির, স্তূপ, স্মৃতিস্তম্ভ ও স্তম্ভ নির্মাণ করতেন।  ৯ তলা এই বিজয় স্তম্ভটি ১৯৪০ থেকে ১৪৪৮ সালের মধ্যে মহারানা কুম্ভ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

সহযাত্রী

দীপা - আর তো এগারো বছর আটমাস বারোদিন চাকরি , তাই না ? অংশু - বাপরে বরাবরই তোমার স্মৃতিশক্তি প্রবল , এতোটা মনে আছে ? দীপা- ঘোরো টো টো করে আর কটা বছর , আফটার রিটায়ার্ড মেন্ট কি করবে ? অংশু - ফার্ম হাউস ,গাছপালা পশুপাখি নিয়ে থাকবো। দীপা- বাঃ উন্নতি হয়েছে। যে অংশুবাবু কখনও একটা ফুলের চারা লাগায়নি সে কিনা ফার্ম হাউস করবে … অংশু - সময়ের সাথে সব বদলায় ম্যাডাম , আচ্ছা তোমার কনুইয়ের নীচে সেই পোড়া দাগটা দেখি তো গেছে কিনা … দীপা- তুমি অনেক রোগা হয়ে গেছো , তা ওজন কত শুনি ? অংশু - সত্তর বাহাত্তর হবে বোধহয় মাপিনি, দীপা - তা কেনো মাপবে ? একটা অগোছালো মানুষ। অংশু - যাক বাবা তাও অপদার্থ শব্দ টা বলোনি। দীপা - ভাবোনা ডিভোর্স হয়েছে বলে সে অধিকার নেই। সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়েও আসলে সমাজটাই শেখোনি , আর কি শিখেছো বলো, ঐ ছেলে পড়ানো , সেমিনার আর লেখালেখি। তা ধন্যবাদ তোমার রূপালী ঠৌট উপন্যাস এবছর একাডেমি পেলো , দারুণ লেখো তুমি, আগের চেয়ে অনেক ধার। অংশু- বাঃ তুমি পড়েছো ? দীপা- সব পড়েছি , তোমার রিসেন্ট উপন্যাসের নায়িকা মেঘনা টি কে ? মানে কার আড়ালে কাকে লিখেছো ? অংশু - এও কি বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপিকাকে বলে দিতে হবে ? দীপা- বারোটা বছর সময়ের শাসনে অনেক বদলালেও আমি বোধহয় সেই বড্ড সেকেলেই রয়ে গেলাম। অংশু - একা একাই কাটিয়ে দিলে বারো বছর। দীপা- একই প্রশ্ন আমিও করতে পারি। অংশু - আচ্ছা দীপা আজ না হয় শেষবারের মতো বলি, আমার মধ্যে কি ছিলো না বলোতো ? কেনো পারোনি এই বাউন্ডুলে ভবঘুরে মানুষটার সাথে চিরকালের ঘর বাঁধতে ? আমি কি ভালোবাসতে জানি না ? .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top