

প্রীতি গুপ্তাঃ টুভালু( Tuvalu), প্যাসিফিক মহাসাগরের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র, যা নয়টি প্রবালদ্বীপ ও অ্যাটল নিয়ে তৈরি। এর মোট ভূমি এলাকা মাত্র ২৬ বর্গকিলোমিটার, এবং জনসংখ্যা প্রায় ১১,০০০। এই দেশটি হাওয়াই এবং অস্ট্রেলিয়ার মাঝামাঝি অবস্থিত।দেশটির গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ২ মিটার এবং এর সর্বোচ্চ স্থান মাত্র ৪.৬ মিটার উচ্চতায়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের জলস্তর বাড়তেই দেশটির অস্তিত্ব এখন গভীর সংকটে। নাসার পর্যবেক্ষণ বলছে, গত ৩০ বছরে টুভালুর সমুদ্রস্তর প্রায় ১৫ সেমি বেড়েছে, যা বৈশ্বিক গড়ের চেয়েও দ্রুত। ফল: ঘন ঘন জলোচ্ছ্বাস, উপকূল ভাঙন, নোনা জল ভূগর্ভে ঢুকে পড়া। টুভালুর রাজধানী ফুনাফুটি—একটি সরু অ্যাটল, দু’দিকে নীল সমুদ্র আর মাঝে ছোট্ট বসতি, এয়ারস্ট্রিপ, নারকেল-গাছের সারি। এই ভৌগোলিক বাস্তবতাই টুভালুকে জলবায়ু সংকটের প্রথম সারির শিকার বানিয়েছে।


টুভালুতে ইতিমধ্যে লবণাক্ত জলের অনুপ্রবেশের কারণে ভূগর্ভস্থ জল অযোগ্য হয়ে পড়েছে, যা কৃষি এবং পানীয় জলের সরবরাহকে প্রভাবিত করছে। নারকেল এবং পুলাকার মতো ফসল উৎপাদন কমছে। ঝড় এবং কিং টাইডস (অস্বাভাবিক উচ্চ জোয়ার) প্রায়ই সমুদ্র উপকূলের ভূ-ভাগকে প্লাবিত করে, ২০১৫ সালের সাইক্লোন প্যাম ৪৫% জনগণকে বাস্তুচ্যুত করেছিল। এখানকার অর্থনীতি মূলত মৎস্য শিকার।আয়ের অন্য কোনও উপায় না থাকায় এরা প্রতিবেশী দেশগুলির অর্থ সাহায্যের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।জলবায়ু পরিবর্তন এই সবকিছুকে হুমকির মুখে ফেলেছে।বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রের জলস্তর প্রতি বছর বাড়ছে।মূলত হিমবাহ ও বরফচাঁই গললে সেই জল সাগরে মিশছে এবং সমুদ্রের জলস্তর বাড়িয়ে দিচ্ছে। টুভালুতে সাগরপৃষ্ঠ প্রতি বছর গড়ে ~৫ মিমি হারে বাড়ছে—এটা বিশ্বের গড় বৃদ্ধির চেয়ে বেশী।
টুভালুবাসীর উদ্যোগ-
- সমুদ্রভাঙন ঠেকাতে অবকাঠামো: ‘Tuvalu Coastal Adaptation Project (TCAP)’ ফুনাফুটির উপকূলে বালু ফেলে নতুন ভূমি-প্ল্যাটফর্ম তুলছে, যাতে ২১০০ সালের পরের সাগরস্তর ও ঝড়ের ঢেউও টপকাতে না পারে। (Wikipedia)
- আইন ও কূটনীতি: দেশটি চায়—সমুদ্র এগোলেও যেন তাদের সমুদ্রসীমা ও মৎস্যসম্পদ আইনি ভাবে অটুট থাকে। এই লক্ষ্যেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোর তৎপরতা শুরু করেছে । (Reuters)
- ডিজিটাল জাতির ধারণা: যদি কোনোদিন ভূমি বাসযোগ্য না-ও থাকে, টুভালু রাষ্ট্র হিসেবে ডিজিটালভাবে টিকে থাকতে চায়—ভূমি, সংস্কৃতি, নথি, এমনকি শাসনব্যবস্থার ডিজিটাল টুইন গড়ে তোলা হচ্ছে। (Oxford Academic, The Diplomat)
- মানবিক সুরক্ষা ও স্থানান্তর: ২০২৩ সালে স্বাক্ষরিত এবং ২০২৪-এ কার্যকর হওয়া অস্ট্রেলিয়া–টুভালু ‘Falepili Union’ চুক্তির আওতায়, প্রতিবছর সর্বোচ্চ ২৮০ জন টুভালুবাসী অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস–কর্ম–শিক্ষার সুযোগ পাবেন—এটি জলবায়ুজনিত প্রথম পরিকল্পিত জাতীয় স্থানান্তরের নজির গড়ছে। (DFAT, DFAT, Live Science)
তবে টুভালুর এই সংকট আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে জলবায়ু পরিবর্তন কোনো দূরবর্তী হুমকি নয়—এটি একটি বাস্তবতা। এই সঙ্কট আজ টুভালু, কাল অন্য নিম্নভূমি উপকূল দেশের হতে পারে। সমুদ্রস্তর বাড়া অব্যাহত থাকলে, ২০৫০–এর মধ্যে টুভালুর বহু অবকাঠামো গড় উচ্চ জোয়ারের নিচে চলে যেতে পারে—নাসার মূল্যায়ন তাই বলছে।তারপরও টুভালুবাসী লড়ছে—সমুদ্রদেয়াল, লবণ-সহিষ্ণু চাষ, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ, পুনর্নবীকরণ জ্বালানি, নতুন জমি তৈরির মাধ্যমে । কিন্তু তাদের প্রকৃত বাঁচনমন্ত্র আমাদের হাতেই— এক্ষেত্রে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে এবং কার্বন নির্গমন কমাতে হবে, যাতে টুভালুর মতো দেশগুলো বেঁচে থাকতে পারে।
টুভালুর গল্প আমাদের শেখায়: একটি দেশের অস্তিত্ব শুধু মাটিতে নয়, মানুষের স্মৃতি, ভাষা, সঙ্গীত, আচার—সব মিলেই গড়া। আর এই কারনেই টুভালুবাসী তাদের দেশের মানচিত্রটিকে তারা প্রযুক্তি, আইন ও সহমর্মিতায় বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে। (Wikipedia, Oxford Academic)
সূত্র – নাসা আর্থ অবজারভেটরি ও সি লেভেল চেঞ্জ টিমের মূল্যায়ন; অস্ট্রেলিয়া–টুভালুর ‘Falepili Union’ চুক্তিপত্র; ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের জনসংখ্যা/অর্থনীতির সর্বশেষ সূচক; রইটার্স ও Wired/Livescience–এ প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদন; টুভালু কোস্টাল অ্যাডাপ্টেশন প্রজেক্ট (TCAP) সম্পর্কিত নথি। (NASA Sea Level Change Portal, DFAT, World Bank Open Data, Reuters, WIRED, Live Science, Wikipedia)
আরও পড়ুন
Fried rice syndrome: আগের দিনের রান্না করা ভাত খেলে হতে পারে এই বিশেষ অসুখটি
উত্তরাপথঃ আপনার কি বাসী ভাত বা পান্তা খাওয়ার অভ্যেস আছে? সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম (Fried rice syndrome) নিয়ে আমরা প্রায়ই অবশিষ্ট খাবার গরম করে আবার খাই। কিন্তু জানেন কি এই অভ্যাস আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। অনেক সময় পর আগের রান্না করা ভাত খাওয়ার ফলে পেট সংক্রান্ত সমস্যা হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে খাবার পুনরায় গরম করলে এতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, কিন্তু তা নয়। যে খাবারেই স্টার্চ থাকে না কেন, এতে উপস্থিত টক্সিন তাপ প্রতিরোধী। অর্থাৎ খাবার গরম করার পরও ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয় না। ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম নামে এই সমস্যা সম্পর্কিত একটি অবস্থা রয়েছে। আজ আমরা এই ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম অবস্থার লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। ভাত রান্না করার পর, যখন অবশিষ্ট ভাত কয়েক ঘন্টা বা সারারাত ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয় এবং তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে শুরু করে, তখন এই অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম। .....বিস্তারিত পড়ুন
World Children's Day: সত্যিই কি ‘বিশ্ব শিশু দিবস´পালনের কোনও যৌক্তিকতা আছে ?
প্রীতি গুপ্তাঃ হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকটি দিন তারপর ১৪ নভেম্বর আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বজুড়ে পালন করা হবে ‘বিশ্ব শিশু দিবস´(World Children's Day)।এই দিনটি শিশুদের মঙ্গলের জন্য, তাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি অনুকূল বিশ্ব তৈরি করার প্রচেষ্টার একটি দিন।কিন্তু প্রশ্ন,সত্যি কি হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সারা বিশ্ব জুড়ে শিশু দিবস পালন করার কোনও যৌক্তিকতা আছে? আদৌ কি এর কোনও লাভ আমরা আমাদের প্রান্তিক স্তরের শিশুদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি ? সম্প্রতি কাজের প্রয়োজনে রাজস্থানের উদয়পুর শহরে আসা। আমরা সবাই জানি উদয়পুর বিখ্যাত তার হ্রদের কারণে । এখানকার স্থানীয় থেকে পর্যটক সকলেই এই সুন্দর হ্রদগুলির আকর্ষণে বারবার ছুঁটে যায়। ‘ফতে সাহেব লেক’ রাজস্থানের উদয়পুরের এক বিখ্যাত পর্যটক স্থল।এখানে বহু মানুষ সকাল- বিকেল এই লেকের চার ধারে হাঁটাহাঁটি করতে বেরিয়ে পড়ে। সেভাবেই দুই দিন আগে বিকেলে হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়লাম ‘ফতে সাহেব লেকের ধারে হাঁটার উদ্দেশ্য নিয়ে। হাঁটার মাঝখানে হঠাৎ করে একটি বাচ্চাছেলে আওয়াজ করে ডাকছে ,বললাম কিছু বলবি? সে বলল একটু দাঁড়াতে। ও ছুটে গিয়ে হাতে করে কয়েকটি বেলুন নিয়ে এসে হাজির । সে বারবার বেলুন কেনার অনুরোধ জানাতে লাগল। হাতে অন্য কাজের চাপ নেই অনেকটা অবসর সময় তাই আমি অনেকটা সাংবাদিক সুলভ মন নিয়ে বললাম ঠিক আছে আমি তোর বেলুন নেব ,কিন্তু তার আগে আমি তোকে যা বলব তার তার ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে। সে খুশী খুশী রাজি হয়ে গেল । .....বিস্তারিত পড়ুন
ফ্লিম রিভিউ -ওপেনহাইমার
উত্তরাপথ: বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান দ্বারা পরিচালিত”ওপেনহাইমার” একটি মাস্টারপিস মুভি। ছবিতে জে. রবার্ট ওপেনহেইমার, এক নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পারমাণবিক বোমার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।এই সিনেমায় ওপেনহাইমার এর জটিল জীবনকে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই হিসেবে 'ওপেনহাইমার'কে বায়োপিক বলা যেতে পারে। কারণ এটি একজন মানুষের গল্প। এই ছবির গল্প তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত।ছবির শুরুতে পারমাণবিক বোমা তৈরির আবেগের কথা বলা হয়েছে। যেখানে নায়ক কিছু না ভেবে নিবেদিতপ্রাণভাবে এমন একটি অস্ত্র তৈরিতে নিয়োজিত থাকে যা বিশ্বকে ধ্বংস করতে পারে। অস্ত্র তৈরি হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে নায়ক তার কাজের ফলাফল দেখে অপরাধবোধে পূর্ণ হয়। এবং তৃতীয় পর্যায়টি হল রাজনীতি যা ওপেনহাইমারকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। পুরো সিনেমাটি রঙিন হলেও রাজনৈতিক অংশ সাদা-কালো রাখা হয়েছে। এই তিনটি সময়কালে যা কিছু ঘটছে, তা সবই একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। .....বিস্তারিত পড়ুন
Bandna Festival: ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পাঁচ দিন বাঁদনার আমেজে মশগুল থাকে
বলরাম মাহাতোঃ চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী কার্তিক অমাবস্যার আগের দিন থেকে মোট পাঁচ দিন ব্যাপী বাঁদনার(Bandna Festival) আমেজে মশগুল থাকে ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অবশ্য, পরবের শুভ সূচনা হয় তারও কয়েকদিন আগে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক শাসন ব্যবস্থার চূড়ামণি হিসাবে গাঁয়ের মাহাতো, লায়া, দেহরি কিম্বা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি নির্ধারণ করেন- ৩, ৫, ৭ বা ৯ ক’দিন ধরে গবাদি পশুর শিং-এ তেল মাখাবে গৃহস্বামী! রুখামাটির দেশের লোকেরা কোনোকালেই মাছের তেলে মাছ ভাজা তত্ত্বের অনুসারী নয়। তাই তারা গোরুর শিং-এ অন্য তেলের পরিবর্তে কচড়া তেল মাখানোয় বিশ্বাসী। কারণ কচড়া তেল প্রস্তুত করতে গোধনকে খাটাতে হয় না যে! কচড়া তেলের অপ্রতুলতার কারণে বর্তমানে সরষের তেল ব্যবহৃত হলেও, কচড়া তেলের ধারণাটি যে কৃষিজীবী মানুষের গবাদি পশুর প্রতি প্রেমের দ্যোতক, তা বলাই বাহুল্য! এভাবেই রাঢ বঙ্গে গোবর নিকানো উঠোনে হাজির হয়- ঘাওয়া, অমাবস্যা, গরইয়া, বুঢ়ি বাঁদনা ও গুঁড়ি বাঁদনার উৎসবমুখর দিনগুলি। পঞ্চদিবসে তেল দেওয়া, গঠ পূজা, কাঁচি দুয়ারি, জাগান, গহাইল পূজা, চুমান, চউক পুরা, নিমছান, গোরু খুঁটা, কাঁটা কাঢ়া প্রভৃতি ১১টি প্রধান পর্ব সহ মোট ১৬টি লোকাচারের মাধ্যমে উদযাপিত হয় বাঁদনা পরব(Bandna Festival )। .....বিস্তারিত পড়ুন