মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর নিষেধাজ্ঞা হোক যুক্তিসম্মত ও ভারসাম্যপূর্ণ

উত্তরাপথঃ মত প্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড। তবে এই স্বাধীনতা যদি দায়িত্ববোধ ও যুক্তিসঙ্গত সীমারেখার বাইরে চলে যায়, তাহলে তা জাতীয় স্বার্থ ও সামাজিক সম্প্রীতির জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। তাই এই স্বাধীনতার ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞা থাকা প্রয়োজন — তবে তা অবশ্যই যুক্তিপূর্ণ, ভারসাম্যপূর্ণ এবং আইনের সীমানার মধ্যে হতে হবে।

সম্প্রতি হরিয়ানার আশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আলি খান মাহমুদাবাদের গ্রেফতার নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। তাঁর একটি ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। যদিও ঠিক কী অপরাধের জন্য তাঁকে আটক করা হয়েছে, সেই বিষয়ে পুলিশের বক্তব্য ছিল অস্পষ্ট। পরে সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে মুক্তি দিলেও, তাদের পর্যবেক্ষণ ও শর্তগুলি বেশ কঠোর ছিল।

আদালতের নির্দেশে অধ্যাপক মাহমুদাবাদকে তাঁর পাসপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে, নিষেধ করা হয়েছে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক বা পাহালগাম হামলা নিয়ে কোনো পোস্ট করা থেকে। পাশাপাশি, আদালত তদন্ত বন্ধ করতে অস্বীকার করেছে এবং একটি বিশেষ তদন্তকারী কমিটি গঠন করেছে, যারা অধ্যাপকের পোস্টে ব্যবহৃত ভাষার ধারা ও মনোভাব বিশ্লেষণ করবে।

এই ঘটনার প্রেক্ষিতে একটি বড় প্রশ্ন উঠে আসে—মত প্রকাশের স্বাধীনতা কি আজ নিরাপদ? সাংবাদিকতা, একাডেমিক চর্চা ও সামাজিক মাধ্যমে নিজস্ব মত প্রকাশের জায়গা কি ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে? এই প্রশ্নগুলো আমাদের সমাজ ও বিচার ব্যবস্থাকে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করছে।

সুপ্রিম কোর্ট পূর্বেও একাধিকবার বলে এসেছে, নিম্ন আদালত এবং সরকারি তদন্তকারী সংস্থাগুলো যেন গ্রেফতারের ক্ষমতা ব্যবহার করার সময় আরও বেশী সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এই সতর্কবাণী অনেকসময় যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না।

অবশ্যই, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দিকটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই যুক্তিতে যদি নাগরিকের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে গণতন্ত্রের ভিত্তিই দুর্বল হয়ে পড়বে। রাষ্ট্র এবং নাগরিকের মধ্যে এই ভারসাম্য রক্ষা করাটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

আমাদের মনে রাখতে হবে, একজন নাগরিকের মত প্রকাশের অধিকার শুধু তার একক স্বাধীনতা নয়, বরং একটি মুক্ত সমাজের নিদর্শন। এই অধিকার রক্ষার দায় যেমন ব্যক্তির, তেমনই রাষ্ট্রেরও। কোনো মতামত যদি সত্যিই ঘৃণার ভাষা ব্যবহার করে, উসকানি দেয় বা হিংসা ছড়ায়—তাহলে তা আইনের আওতায় আনা একান্ত জরুরি। কিন্তু সে বিষয়ে প্রমাণ থাকা, নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া এবং বিচারব্যবস্থার মধ্যেই সমাধান খোঁজা উচিত। সাম্প্রতিক এই ঘটনাটি আবারও প্রমাণ করল—মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি বিষয়েই আমাদের সংবেদনশীলতা ও যুক্তিবোধ থাকা প্রয়োজন। এই স্বাধীনতা যেন অন্ধ দমননীতির শিকার না হয়, বরং তা যেন গঠনতন্ত্রের মূল চেতনার প্রতিফলন হয়ে ওঠে—এটাই গণতন্ত্রের জন্য আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যৎ গড়ার পথ। এক কথায় স্বাধীনতা মানে দায়িত্ব; আর রাষ্ট্রের শক্তি মানে জনগণের সুরক্ষা, নিপীড়ন নয়।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Free Gift in Politics: ভারতের নির্বাচন ও ফ্রি গিফট সংস্কৃতি

উত্তরাপথঃ ফ্রি গিফট (Free gift in politics)এর রাজনীতি সম্প্রতি ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করছে। বিনামূল্যে কোটি কোটি জনগণকে উপহার প্রদান যা রাজকোষের উপর অতিরিক্ত বোঝা ফেলবে এই সত্যটি জানা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক দলগুলি ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য ফ্রি গিফট (Free gift in politics) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনের দৌড়ে একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।এক সময় প্রয়াত তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতা বিনামূল্যে শাড়ি, প্রেসার কুকার, ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন সেট ইত্যাদির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের আগে যে বিনামূল্যের সংস্কৃতি শুরু করেছিলেন তা পরবর্তী কালে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি দ্রুত অনুসরণ করেছিল। এরপর ২০১৫ সালে আম আদমি পার্টি নেতৃত্ব দিল্লির ভোটারদের কাছে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, জল, বাস ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

World Children's Day: সত্যিই কি ‘বিশ্ব শিশু দিবস´পালনের কোনও যৌক্তিকতা আছে ?

প্রীতি গুপ্তাঃ হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকটি দিন তারপর ১৪ নভেম্বর আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বজুড়ে  পালন করা হবে ‘বিশ্ব শিশু দিবস´(World Children's Day)।এই দিনটি শিশুদের মঙ্গলের জন্য, তাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি অনুকূল বিশ্ব তৈরি করার প্রচেষ্টার একটি দিন।কিন্তু প্রশ্ন,সত্যি কি হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সারা বিশ্ব জুড়ে শিশু দিবস পালন করার কোনও যৌক্তিকতা আছে? আদৌ কি এর কোনও লাভ আমরা আমাদের প্রান্তিক স্তরের শিশুদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি ? সম্প্রতি কাজের প্রয়োজনে রাজস্থানের উদয়পুর শহরে আসা। আমরা সবাই জানি উদয়পুর বিখ্যাত তার হ্রদের কারণে । এখানকার স্থানীয় থেকে পর্যটক সকলেই এই সুন্দর হ্রদগুলির আকর্ষণে বারবার ছুঁটে যায়। ‘ফতে সাহেব লেক’ রাজস্থানের উদয়পুরের এক বিখ্যাত পর্যটক স্থল।এখানে বহু মানুষ সকাল- বিকেল এই লেকের চার ধারে হাঁটাহাঁটি করতে বেরিয়ে পড়ে। সেভাবেই দুই দিন আগে বিকেলে হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়লাম ‘ফতে সাহেব লেকের ধারে হাঁটার উদ্দেশ্য নিয়ে। হাঁটার মাঝখানে হঠাৎ করে একটি বাচ্চাছেলে আওয়াজ করে ডাকছে ,বললাম কিছু বলবি? সে বলল একটু দাঁড়াতে। ও ছুটে গিয়ে হাতে করে কয়েকটি বেলুন নিয়ে এসে হাজির । সে বারবার বেলুন কেনার অনুরোধ জানাতে লাগল। হাতে অন্য কাজের চাপ নেই অনেকটা অবসর সময় তাই আমি অনেকটা সাংবাদিক সুলভ মন নিয়ে বললাম ঠিক আছে আমি তোর বেলুন নেব ,কিন্তু তার আগে আমি  তোকে যা বলব তার তার ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে। সে খুশী খুশী রাজি হয়ে গেল । .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে

উত্তরাপথঃ হঠাৎ করেই একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে।২০২৩ এর ৩০ অক্টোবর  প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি মৃত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত একটি নতুন দ্বীপের জন্ম দিয়েছে। বিস্ফোরণের পর জাপানের ওগাসাওয়ারা দ্বীপ চেইনের কাছে বিশাল বিশাল পাথরের টুকরো দেখা গেছে। এ বিষয়ে জাপানি গবেষক বলেন, গত মাসে প্রশান্ত মহাসাগর জলের নিচে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের পর টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে ইওটো দ্বীপের কাছে একটি ছোট নতুন দ্বীপের উদ্ভব হয়েছে।টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ফুকাশি মায়েনো জানিয়েছেন যে নতুন দ্বীপ, এখনও যার নাম নেই প্রশান্ত মহাসাগরের ইওটো দ্বীপ থেকে ১ কিলোমিটার দূরে ১০০ মিটার ব্যাসের একটি পাথুরে দ্বীপে একটি phreatomagmatic বিস্ফোরণ ঘটেছে। টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে বিস্ফোরণটি দেখা গেছে। ভূপৃষ্ঠের নীচে জলের সাথে লাল গরম ম্যাগমা সংঘর্ষের কারণে প্রতি কয়েক মিনিটে বিস্ফোরণ ঘটে।গত ২১ অক্টোবর, ২০২৩-এ অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছিল, যা আগে ইও জিমা নামে পরিচিত ছিল এবং এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্থান ছিল। প্রায় ১০ দিন ধরে অগ্ন্যুৎপাত চলার পর, আগ্নেয়গিরির উপাদান অগভীর সমুদ্রতলের উপর জমা হয় এবং প্রায় ১৬০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় বড় বড় পাথরের আকারে সমুদ্র পৃষ্ঠের উপরে উঠে আসে। .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক

উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই  সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top