হতাশা ও অপমানে সুভাষ মুখার্জির মত ‘এক ডক্টর কি মৌত’

উত্তরাপথঃ দিনটা ছিল ১৯৮১ সালের ১৯ শে জুন শুধুমাত্র হতাশা ও অপমানে ভারতে প্রথম ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (IVF) এর জনক সুভাষ মুখার্জি তার জীবন শেষ করার দুঃখজনক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু কেন আমরা আমাদের দেশের একজন পথপ্রদর্শক চিকিৎসককে হারালাম ? ‘এক ডক্টর কি মৌত’ আমাদের সামনে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে দিয়েছে ।

১৯৭৮ সালে বিশ্বের প্রথম ‘টেস্ট টিউব’ শিশু লুইস ব্রাউনের পৃথিবীতে আসার মাত্র ৬৭ দিন পর ভারতে জন্ম হয় প্রথম IVF শিশুর বাঙালি চিকিৎসক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে।১৯৭৮ সালের ৩ অক্টোবর, কানুপ্রিয়া আগরওয়াল (দুর্গা) নামে এক টেস্ট টিউব শিশুর জন্ম হয়। ডাক্তার সুভাষ মুখার্জি ভারতে প্রথম ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন IVF) পদ্ধতি সফল ভাবে ব্যবহার করেছিলেন।চিকিৎসা বিজ্ঞানে তার যুগান্তকারী কাজ সত্ত্বেও, দুর্ভাগ্যের বিষয় এই মানুষটিকে কেউ সেই সময় বিশ্বাস করেনি।এমনকি চিকিৎসক সম্প্রদায়ের কাছ থেকেও তিনি সংশয় এবং প্রত্যাখ্যানের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাঁর অবদানগুলি তার জীবদ্দশায় মূলত অস্বীকৃত ছিল কিন্তু তার মৃত্যুর পর তাকে অনেকটা লোক দেখনোর মত করে কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছিল,এর প্রাথমিক  কারণ হিসাবে জানা যায় তিনি তার গবেষণাকর্ম পিয়ার-রিভিউ জার্নালে প্রকাশ করেননি।

 এরপর, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক  এক বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়, যেখানে আইভিএফ গবেষণার অভিজ্ঞতা ছাড়াই পেশাদারদের নিয়ে কমিটিটি গঠন করা হয়েছিল যারা তার গবেষণার ফলাফলগুলিকে খারিজ করে দেয়। “বিশেষজ্ঞ” প্যানেল দ্বারা তার কাজ প্রত্যাখ্যান হওয়ার পরে তাকে চিকিৎসক , বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় এবং রাজ্য সরকার দ্বারা বহিষ্কৃত করা হয়েছিল। সেই সময় কেন্দ্রীয় সরকারও তাকে কোনো বৈজ্ঞানিক সম্মেলন বা বৈঠকের জন্য ভারতের বাইরে ভ্রমণ করতে নিষেধ করেছিল । তার বৈজ্ঞানিক গবেষণা শেয়ার করার ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে সীমিত করে দেওয়া হয়।

প্রসঙ্গত ডাক্তার সুভাস মুখার্জি ১৬ জানুয়ারী ১৯৩১ সালে হাজারিবাগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যা আজকের ঝাড়খণ্ডে রয়েছে। স্বাধীনতার দুই বছর পর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিওলজিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীকালে, তিনি ১৯৫৪ সালে কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস করেন এবং ১৯৫৮ সালে রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজ থেকে প্রজনন শারীরবৃত্তিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।এক দশক পরে তিনি প্রজনন এন্ডোক্রিনোলজিতে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেকটি পিএইচডি অর্জন করেন।এরপর তিনি ১৯৬৭ সালে কলকাতার এনআরএস মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন, যেখানে তিনি তার গবেষণার কাজের জন্য ক্যাম্পাসে থাকতেন। কাজ অন্তপ্রান এই মানুষটি তাঁর কাজের সুবিধার জন্য একটি বাড়ি বানিয়েছিলেন যেখানে বাড়ির উপরের তলার একটি ঘরে তিনি থাকতেন এবং নীচের ঘরে তার গবেষণার পরীক্ষার জন্য ইঁদুর, খরগোশ এবং বানর রাখতেন।

তার গবেষণা প্রধানত গর্ভাবস্থায় একজন মহিলার দেহে জৈব রাসায়নিক পরিবর্তনের উপর ভিত্তি করে ছিল।তিনি এডিনবার্গে থাকাকালীন ডিম্বাশয়ে কোলেস্টেরল এবং হরমোনের সম্পর্ক নিয়েও কাজ করেছিলেন। তিনি এরপর ধীরে ধীরে প্রজনন শারীরবৃত্তি এবং এন্ডোক্রিনোলজিতে গবেষণার উপর বেশী জোর দেন।

এর মাঝে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার বিএস মেডিকেল কলেজে কাজে যোগ দেন এবং সফলভাবে প্রথম আইভিএফ শিশু তৈরি করেন। একটি সফল IVF ইমপ্লান্ট শিশু জন্মের বিষয়ে ডাক্তার মুখার্জির দাবীকে সারা বিশ্বের বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় সহজে মেনে নিচ্ছিল না, কারণ ইংল্যান্ডে প্রথম IVF ইমপ্লান্টের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি থেকে তার কৌশলগুলি আলাদা ছিল। ফিজিওলজিস্ট রবার্ট জি এডওয়ার্ডস, গাইনোকোলজিস্ট ডাঃ প্যাট্রিক স্টেপটো এবং ভ্রূণ বিশেষজ্ঞ জিন পার্ডি ডাক্তার মুখার্জির মতো একই পদ্ধতি ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলেন।

 তিনি তার জীবদ্দশায় অসংখ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন তা সত্ত্বেও, তিনি তার উত্তরাধিকার তার যুগান্তকারী গবেষণা এবং তিনি যে অগণিত জীবন তৈরিতে সহায়তা করেছিলেন তার মাধ্যমে বেঁচে আছেন। আজ, IVF হল সাহায্যকারী প্রজননের একটি ব্যাপকভাবে স্বীকৃত এবং সফল পদ্ধতি, যা বন্ধ্যাত্বের সাথে লড়ায়ে লক্ষ লক্ষ দম্পতিদের আশা দেয়।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


NASA Carbon Emission: পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে

উত্তরাপথঃ কার্বন নির্গমন (NASA Carbon Emission) সম্পর্কে নাসার সর্বশেষ আবিষ্কার পৃথিবীর জন্য এক সতর্কতা সংকেত। মহাকাশ সংস্থার মতে, পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে, যার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। NASA এর এই আবিষ্কারটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, সেইসাথে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেছে।নাসার সর্বশেষ গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে পৃথিবীর মহাসাগর এবং ভূমি-ভিত্তিক বাস্তুতন্ত্র আগের চেয়ে কম কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে গত এক দশকে ভূমি এবং মহাসাগর দ্বারা শোষিত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৫% হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

ফ্লিম রিভিউ -ওপেনহাইমার

উত্তরাপথ: বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান দ্বারা পরিচালিত”ওপেনহাইমার” একটি মাস্টারপিস মুভি। ছবিতে জে. রবার্ট ওপেনহেইমার, এক নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পারমাণবিক বোমার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।এই সিনেমায় ওপেনহাইমার এর জটিল জীবনকে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই হিসেবে 'ওপেনহাইমার'কে বায়োপিক বলা যেতে পারে।  কারণ এটি একজন মানুষের গল্প। এই ছবির গল্প তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত।ছবির শুরুতে পারমাণবিক বোমা তৈরির আবেগের কথা বলা হয়েছে।  যেখানে নায়ক কিছু না ভেবে নিবেদিতপ্রাণভাবে এমন একটি অস্ত্র তৈরিতে নিয়োজিত থাকে যা বিশ্বকে ধ্বংস করতে পারে।  অস্ত্র তৈরি হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে নায়ক তার কাজের ফলাফল দেখে অপরাধবোধে পূর্ণ হয়।  এবং তৃতীয় পর্যায়টি হল রাজনীতি  যা ওপেনহাইমারকে মোকাবেলা করতে হয়েছে।  পুরো সিনেমাটি রঙিন হলেও রাজনৈতিক অংশ সাদা-কালো রাখা হয়েছে।  এই তিনটি সময়কালে যা কিছু ঘটছে, তা সবই একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। .....বিস্তারিত পড়ুন

Free Gift in Politics: ভারতের নির্বাচন ও ফ্রি গিফট সংস্কৃতি

উত্তরাপথঃ ফ্রি গিফট (Free gift in politics)এর রাজনীতি সম্প্রতি ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করছে। বিনামূল্যে কোটি কোটি জনগণকে উপহার প্রদান যা রাজকোষের উপর অতিরিক্ত বোঝা ফেলবে এই সত্যটি জানা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক দলগুলি ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য ফ্রি গিফট (Free gift in politics) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনের দৌড়ে একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।এক সময় প্রয়াত তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতা বিনামূল্যে শাড়ি, প্রেসার কুকার, ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন সেট ইত্যাদির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের আগে যে বিনামূল্যের সংস্কৃতি শুরু করেছিলেন তা পরবর্তী কালে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি দ্রুত অনুসরণ করেছিল। এরপর ২০১৫ সালে আম আদমি পার্টি নেতৃত্ব দিল্লির ভোটারদের কাছে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, জল, বাস ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

Side effects of vitamin: ভিটামিনের আধিক্য আপনার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে

উত্তরাপথঃ ভিটামিনের প্রয়োজনীয়তা আমরা সবাই নিশ্চয়ই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি যে সুস্থ থাকতে হলে শরীরে প্রয়োজনীয় সব ভিটামিন থাকা খুবই জরুরি।  ভিটামিন আমাদের সুস্থ করার পাশাপাশি আমাদের সমগ্র শরীরের বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  যাইহোক, এটি অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া আমাদের জন্য ক্ষতিকারকও হতে পারে।  আসুন জেনে নিই অতিরিক্ত ভিটামিন গ্রহণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Side effects of vitamin)সুস্থ থাকার জন্য শরীরে সব ধরনের পুষ্টি থাকা খুবই জরুরি।  এ কারণেই বয়স্ক থেকে শুরু করে চিকিৎসক, সবাই আমাদেরকে সুষম ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন।  সমস্ত পুষ্টি উপাদান আমাদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে সুস্থ করে তোলে।  এর মধ্যে ভিটামিন একটি, যা আমাদের সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top