১০০ বছর আগে টেলিভিশনের জন্মের পেছনে ছিল চাঞ্চল্যকর ষড়যন্ত্র ও হিংস্র প্রতিযোগিতা!

উত্তরাপথঃ আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে, ১৯৩৬ সালে, টেলিভিশনের জন্ম হয়েছিল এক রোমাঞ্চকর গল্পের মধ্য দিয়ে। এই গল্পে ছিল তীব্র প্রতিযোগিতা, ষড়যন্ত্র, উৎসবের আমেজ আর এক বিধ্বংসী দুর্ঘটনা। গল্পের চরম মুহূর্ত এলো যখন ১৯৩৬ সালের ৩০ নভেম্বর লন্ডনের ক্রিস্টাল প্যালেসে আগুন লেগে টেলিভিশনের উদ্ভাবক জন লজি বেয়ার্ডের ল্যাবরেটরির একটা বড় অংশ ধ্বংস হয়ে গেল। এর চেয়ে খারাপ সময় আর তাঁর কাছে হতে পারত না! বেয়ার্ড তখন লড়াই করছিলেন EMI নামের এক বিশাল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে, যারা গুগলিয়েলমো মারকনি ও আমেরিকান রেডিও কোম্পানি RCA-এর সঙ্গে জোট বেঁধে আধুনিক ইলেকট্রনিক টিভি প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছিল। বেয়ার্ডের হাতেই ছিল পুরনো যন্ত্রচালিত টিভি প্রযুক্তি। এই যন্ত্রচালিত টিভি-ই তাকে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তারবিহীন চলন্ত ছবি প্রেরণকারী হিসেবে খ্যাতি এনে দিয়েছিল, ১৯২৫ সালে।

টেলিভিশনের শুরুর দিনগুলো

টেলিভিশনের শুরুর দিনগুলো ছিল একটা যুদ্ধক্ষেত্রের মতো। অনেক উদ্ভাবকই এই নতুন মাধ্যমের জন্য লড়াই করছিলেন। জন লজি বেয়ার্ড ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। তিনি প্রথম বেতারের মাধ্যমে চলমান ছবি পাঠাতে সক্ষম হন, যেমনটা ১৯২৫ সালের জুন মাসে পপুলার সায়েন্স ম্যাগাজিনের লেখক নিউটন বার্ক লিখেছিলেন। কিন্তু বেয়ার্ডের প্রাথমিক সাফল্যের পর তিনি ব্যর্থ হন কারণ তিনি পুরনো যান্ত্রিক (মেকানিকাল) প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করেছিলেন, যখন নতুন ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি অনেক বেশি কার্যকর ছিল।

বেয়ার্ডের যান্ত্রিক টেলিভিশন সিস্টেম সেই সময়ের জন্য বিপ্লবী ছিল। এটা দিয়ে তিনি একটা ল্যাবরেটরির এক ঘর থেকে আরেক ঘরে মানুষের মুখের হাসি, চোখের পলক ফেলা—এসব ছবি পাঠাতে পারতেন, তাও কোনো তার বা ফটোগ্রাফি ছাড়াই! কিন্তু ছবিগুলো এতটাই অস্পষ্ট ছিল যে, বেয়ার্ডের ছবি দেখে মনে হতো যেন কোনো ভৌতিক মুখ! তবু বার্ক লিখেছিলেন, “মুখের আউটলাইন স্পষ্ট, চোখের গর্তের ছায়া আর খোলা মুখের আকৃতি পরিষ্কার দেখা যায়।”

অন্যদের অবদান

বেয়ার্ডের কাজ একা তার নিজের ছিল না। তিনি অনেক আগের উদ্ভাবকদের কাজের ওপর ভিত্তি করে এগিয়েছিলেন। ফরাসি প্রকৌশলী মরিস লেব্লাঁ ১৮৮০-এর দশকে টেলিভিশন ট্রান্সমিশনের প্রথম নীতিগুলো প্রকাশ করেছিলেন। জার্মান উদ্ভাবক পল নিপকো ১৮৮৫ সালে একটা “ইলেকট্রিক টেলিস্কোপ” তৈরি করেন, যেটা স্থির ছবি স্ক্যান করে তারের মাধ্যমে পাঠাতে পারত। এদিকে, ওয়াশিংটনের চার্লস জেনকিন্স ১৯২৫ সালে প্রথম ভিডিও ও অডিও একসঙ্গে পাঠান, যদিও তার সিস্টেম শুধু স্থির ছবি নিয়ে কাজ করত।

বেয়ার্ডের সিস্টেম কীভাবে কাজ করত?

বেয়ার্ডের ডিভাইসে ছিল একটা দ্রুত ঘুরন্ত ডিস্ক, যার মধ্যে একটা লেন্স থাকত। এই লেন্স আলোকে সেলেনিয়াম সেলে ফোকাস করত, যেটা আলোকে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তর করত। এই সংকেত রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে পাঠানো হত, কারণ তখন রেডিওই ছিল একমাত্র ব্যবহারযোগ্য মাধ্যম। রিসিভারে আরেকটা ডিস্ক থাকত, যেটা ছবিটাকে পুনর্গঠন করত। ছবিগুলো ছিল খুব সরু রেখার সমন্বয়ে গঠিত, যেগুলোর গাঢ়তা ভিন্ন হত। কিন্তু এই ডিভাইসের যান্ত্রিক সীমাবদ্ধতার কারণে ছবির গুণমান খুব ভালো হত না।

ইলেক্ট্রনিক টেলিভিশনের উত্থান

বেয়ার্ড যখন তার যান্ত্রিক সিস্টেম নিয়ে কাজ করছিলেন, তখন অন্যরা ইলেকট্রনিক টেলিভিশন তৈরি করছিলেন, যেখানে ক্যাথোড রশ্মি ব্যবহার করা হত। এই প্রযুক্তির জন্য ফিলো ফার্নসওয়ার্থ ও ভ্লাদিমির জ্বোরিজকিনের মধ্যে তুমুল পেটেন্ট যুদ্ধ শুরু হয়। ফার্নসওয়ার্থ ১৯৩০ সালে প্রথম ইলেকট্রনিক টেলিভিশনের পেটেন্ট পান, কিন্তু জ্বোরিজকিন ১৯২৩ সালেই আবেদন করেছিলেন। তাদের এই লড়াই আরসিএ-র সঙ্গে দীর্ঘ আইনি যুদ্ধে রূপ নেয়। আরসিএ জ্বোরিজকিনকে নিয়ে আমেরিকার প্রথম টেলিভিশন ব্রডকাস্টিং সিস্টেম তৈরি করে, যার নাম ছিল ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং কোম্পানি (এনবিসি), যেটি ১৯৩৯ সালে নিউয়র্ক ওয়ার্ল্ড ফেয়ারে প্রথম দেখানো হয়।

লন্ডনের লড়াই

টেলিভিশনের উন্নতির কেন্দ্র ছিল লন্ডন। ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি) ১৯৩৬ সালে BBC সিদ্ধান্ত নেয়—একেবারে হাতে-কলমে যাচাই করে দেখা হবে বেয়ার্ড ও EMI-এর প্রযুক্তির মধ্যে কে সেরা। একদিকে ছিল বেয়ার্ডের হাইব্রিড মেকানিক্যাল-ইলেকট্রনিক সিস্টেম, আরেকদিকে EMI-এর আধুনিক, ৪০৫ লাইন রেজোলিউশন সম্পন্ন ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি।

দুই দলই লন্ডনের অ্যালেক্সান্দ্রা প্যালেস থেকে একই রকম অনুষ্ঠান সম্প্রচার করত, যাতে তাদের তুলনা করা যায় দু’পক্ষই একই জায়গা থেকে—লন্ডনের আলেকজান্দ্রা প্যালেস থেকে সম্প্রচার শুরু করল। কিন্তু আগুন বেয়ার্ডের সবকিছু শেষ করে দিল। তার গবেষণাগার ভস্মীভূত হল, যন্ত্রপাতি ধ্বংস হলো। প্রতিযোগিতায় আর টিকে থাকতে পারলেন না তিনি। কিছুদিন পরই টেলিভিশনের কাজ থেকে তিনি সরে দাঁড়ালেন।

বেয়ার্ড ১৯৪৬ সালে মারা যান—তার টেলিভিশন আবিষ্কারের কোনো আর্থিক লাভ না পেয়েই। অথচ তার সেই যন্ত্রচালিত ‘অস্পষ্ট মুখাবয়ব’, যা অনেকটা হরর সিনেমার জেসন ভরহিসের মতো দেখতে ছিল, ইতিহাসের এক অমূল্য অধ্যায় হয়ে রইল।

তিনি প্রমাণ করে গেছেন—চেষ্টা আর কল্পনার জোরে মানুষ কেমন করে ভবিষ্যৎ গড়ে তোলে। তার পথ ধরেই এসেছে আধুনিক টেলিভিশন, এসেছে রঙিন পর্দা, ৮কে রেজোলিউশন, স্মার্ট টিভি।আজ আমরা যা দেখি, যা উপভোগ করি—তার পেছনে রয়েছেন জন লোগি বেয়ার্ডের মতো স্বপ্নবাজ একজন মানুষ। তাঁর স্বপ্নের আগুনেই তো একদিন জ্বলে উঠেছিল টেলিভিশনের পর্দা।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক

উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই  সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন

সেলফির উচ্চ রেটিং কি আপনাকে আরওপাতলা হতে উৎসাহিত করছে ?

উত্তরাপথঃ সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে সেলফি তোলা এবং নিজেকে পাতলা হিসাবে দেখানোর মধ্যে একটি সম্পর্ক থাকতে পারে। যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক সেন্ট জন ইউনিভার্সিটির রুথ নাইট এবং ইউনিভার্সিটি অফ ইয়র্কের ক্যাথরিন প্রেস্টন সম্প্রতি PLOS ONE জার্নালে তাদের ফলাফল প্রকাশ করেছেন।সেখানে সেলফির উচ্চ রেটিং এবং আমাদের শরীরের গঠনের মধ্যে যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।    বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ায় সেলফি হল এক জনপ্রিয় ছবি দেওয়ার ধরন। যিনি সেলফি তোলেন তিনি ক্যামেরাকে তাদের শরীর থেকে দূরে রেখে নিজেই নিজের ছবি তোলে। আগের গবেষণায় বলা হয়েছে সেলফিগুলি দেখার ফলে ছবির বিষয়গুলি সম্পর্কে দর্শকদের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন

সম্পাদকীয়-  রাজনৈতিক সহিংসতা ও আমাদের গণতন্ত্র

সেই দিনগুলো চলে গেছে যখন নেতারা তাদের প্রতিপক্ষকেও সম্মান করতেন। শাসক দলের নেতারা তাদের বিরোধী দলের নেতাদের কথা ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন।  আজ রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে।  কেউ কারো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়।  আগ্রাসন যেন রাজনীতির অঙ্গ হয়ে গেছে।  রাজনৈতিক কর্মীরা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খুন বা মানুষ মারার মত অবস্থার দিকে ঝুঁকছে। আমাদের দেশে যেন রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না।আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে বেশি মানুষ নিহত হচ্ছেন।  ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) অনুসারে, ২০১৪ সালে, রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৪০০ জন প্রাণ হারিয়েছিল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২০০০ জন মারা গিয়েছিল।  আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য গর্বিত হতে পারি, কিন্তু এটা সত্য যে আমাদের সিস্টেমে অনেক মৌলিক সমস্যা রয়েছে যা আমাদের গণতন্ত্রের শিকড়কে গ্রাস করছে, যার জন্য সময়মতো সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Roop Kishor Soni: একটি আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য তুলে ধরেছেন

উত্তরাপথঃ রাজস্থান মানেই ওজনদার রূপার গহনা ,আর তার উপর কারুকাজ। প্রচলিত এই ধারনা ভেঙ্গে আজ রূপোর গহনাকে আধুনিকতার সাথে শিল্পের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন যে ব্যক্তি তিনি হলেন রূপ কিশোরী সোনী(Roop Kishor Soni)।তিনি ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে তার অসাধারণ শিল্প কর্মের জন্য জাতীয় পুরুস্কার পান। রাজস্থানের জয়সলমেরের শহরের এই শিল্পী ৩.৮ গ্রাম ওজনের ০.৯ সেমি চওড়া রৌপ্য আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য খোদাই করেছেন।এই ছোট রূপার আংটিতে শিল্পী তাজমহল, সিডনি অপেরা হাউস, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, চীনের গ্রেট ওয়াল, আইফেল টাওয়ার, বিগ বেন, পিসার হেলানো টাওয়ার এবং মিশরীয় পিরামিডের চিত্র এক সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন।এছাড়াও তিনি আরও দুটি পৃথক ডিজাইনের অত্যাশ্চর্য আংটি  তৈরি করেছেন।৮.৬ গ্রাম ওজনের একটি রিংয়ে তিনি সূর্যাস্তের সময় ভারতীয় উট সাফারি সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভারতীয় বিশেষত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন,এবং অন্যটিতে বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবী ছবি এবং মন্দির খোদাই করেছিলেন। শিল্পী বলেছেন যে তিনি তার বাবার কাছ থেকে তার শৈল্পিক দক্ষতা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সেই সাথে তিনি বলেন "আমার বাবাও একজন জাতীয় পুরুস্কার প্রাপ্ত শিল্পী ছিলেন। তিনি আমাকে শিল্পের এই দক্ষতা শিখিয়েছিলেন কারণ তিনি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে শিল্পের ফর্মটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।" .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top