

প্রিয়াঙ্কা দত্তঃ আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রধান শহর পোর্ট ব্লেয়ার থেকে মাত্র ৪৪ কিমি দূরে রয়েছে পৃথিবীর আদিমতম জনগোষ্ঠী জারোয়াদের বাসস্থান।আন্দামানে বসবাসকারী প্রায় ছয় ধরনের আদিম জনজাতির অন্যতম এই জারোয়ারা, যারা প্রায় ৬০০০০ বছর ধরে এই আন্দামানেই রয়ে গেছে সভ্যতার ছোঁয়া বাঁচিয়ে। বহু দিন আগে তারা দক্ষিণ আন্দামান, বরাটাং, মধ্য ও উওর আন্দামানের বিস্তীর্ণ এলাকায় বসবাস করলেও ব্রিটিশ আমল থেকেই বিভিন্ন কারণে তাদের সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে । এখন কেবল এই বরাটাং এলাকায় তাদের মাত্র ৩৮০ (২০১১সালের জনগণনা অনুসারে) জনের মতো সদস্য অবশিষ্ট আছে।
পোর্ট ব্লেয়ার ও ডিগলিপুরের সংযোগকারী প্রধান সড়ক আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড বা ATR চলে গেছে জরোয়াদের নিজস্ব এলাকার বুক চিরে। বলা বাহুল্য, সেই আদিম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সভ্য মানুষের সখ্য গড়ে ওঠার কাহিনী খুব ছোট নয়। স্বাধীনতার অব্যবহিতপরেই আন্দামানের উন্নতি কল্পে পোর্টব্লেয়ারকে অন্যান্য দ্বীপের সঙ্গে সংযুক্ত করার প্রয়োজন হয়ে পরে। আগে যাতায়াত বা পণ্য পরিবহনের জন্য জলপথ ব্যবহৃত হলেও প্রায় ১০-১২ ঘন্টা সময় লেগে যেতো। তাই ১৯৬০ এর দশকে শুরু হয় ATR নির্মাণের কাজ। কিন্তু জারোয়ারা তখনও অপরিচিত মানুষদের জন্য ছিলো ত্রাস। প্রায়শই PWD এর কর্মীদের উপর হামলা চালাতে থাকে তারা। কয়েকজন নিহত আবার বেশ কয়েকজন আহতও হয় তাদের তিরের আঘাতে। তেমনই একজন আহত ব্যাক্তি কালি মুত্তু। তাঁর শরীরে প্রায় তিরিশটি তিরের আঘাত নিয়েও তিনি ফিরে আসতে পেরেছিলেন জিরকাটাং এর ক্যাম্পে। আর ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে জিরকাটাং চেক পোস্টের কাছে নির্মাণ করেছিলেন মারিয়াম্মা দেবীর মন্দির। যা এখনও বরাটাং ভ্রমণকারীদের কাছে ভোর রাতের আশ্রয়স্থল।
অবশেষে পাকা রাস্তা নির্মিত হলো আর জারোয়রাও ধীরে ধীরে সভ্য জগতের সঙ্গে পরিচিত হতে লাগলো। শোনা যায়, ১৯৯৭ সাল নাগাদ এক জড়োয়া যুবককে স্থানীয় বসতির নালা থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তাকে পোর্ট ব্লেয়ার এর হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করে আবার তার বাসস্থানে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকেই জড়োয়া জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গভীর জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে তারা খাদ্য বা অন্যান্য সামগ্রী পাওয়ার আশায় দাঁড়িয়ে থাকত রাস্তার ধারে। কিন্তু প্রথম দিকে সেই রাস্তা দিয়ে যাতায়াতকারী গাড়ির ড্রাইভার ও কিছু অত্যুৎসাহী পর্যটকদের দ্বারা জরোয়ারা ক্রমাগত নিগৃহত হতে লাগে । এমনকি জারওয়া মহিলাদের শ্লীলতাহানিও বাদ যায়নি। অগত্যা বিভিন্ন NGO ও কলকাতা হাই কোর্টের হস্তক্ষেপে একটি জনস্বার্থ মামলার রায়ে ২০০৮ সাল থেকে আইন করে নিয়ন্ত্রণ করা হয় ATR এ যান চলাচল।


প্রায় ৫০ কিমি এলাকায় এখন তাই থাকে পুলিশের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা। ভোর থেকেই শুরু হয়ে যায় পর্যটকদের গাড়ি ও অন্যান্য যানবাহনের লাইন। ভোর ছয়টায় শুরু হয় প্রথম কনভয়। এদিকে জিরকাটাং ও অন্যদিকে মিডল স্ট্রেইট এর মাঝে ঘন জঙ্গলে ঘেরা আঁকা বাঁকা রাস্তায় কোথাও অকারণে দাঁড় করানো যাবে না গাড়ি। সর্বাধিক গতি বেঁধে দেওয়া হয়েছে ঘণ্টায় ৪০ কিমি। কোনও ভাবে ফোন বা ক্যামেরার ব্যবহারও নিষিদ্ধ। এভাবেই চার বার কনভয় করে যাতায়াত চলে বরাটাং আর পোর্ট ব্লেয়ার এর মধ্যে। পথিমধ্যেই কখনও কখনও দেখা মেলে এই জারোয়াদের। দলবেঁধে বা একক ভাবে তারা দাঁড়িয়ে দেখে সভ্য মানুষের যাত্রা আর সভ্য মানুষরাও উপভোগ করে আদিম মানুষ চাক্ষুষ করার আনন্দ।
এবার আসা যাক জারওয়াদের জীবনযাত্রার কিছু কথায়। মনে করা হয় তারা হলো অধুনা বিলুপ্ত জাঙ্গিল উপজাতির বিচ্ছিন্ন শাখা। এদের সঙ্গে আফ্রিকার ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীন জনগোষ্ঠির সাদৃশ্য পাওয়া যায়। আক্রমণকারী জাতি হিসাবে পরিচিত হলেও সাধারণত আত্মরক্ষা ও খাদ্য সংগ্রহের জন্য তারা তির ধনুক বা লাঠি ,বল্লমের মতো অস্ত্র ব্যাবহার করে। সাধারণত জঙ্গলের ফল মূল কন্দ আর বুনো শুয়োর, নদী ও খাড়ির মাছ আর কচ্ছপ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী খেয়ে জীবন ধারণ করে। তবে সভ্য সমাজের সংস্পর্শে এসে তারা পর্যটকদের বা স্থানীয়দের দেওয়া কলা, নারকেল প্রভৃতি খাবার খেতে শিখেছে। যদিও তাদের স্বাস্থ্যের জন্য তা ক্ষতিকর হতে পারে। মাঝে মাঝেই তারা হাম, ম্যালেরিয়া প্রভৃতি মহামারীর শিকার হয়।পূর্বে তারা কোনও রকম পোশাক ব্যবহার করত না। তবে মেয়েরা নিম্নাঙ্গে গাছের ছাল বা পাতার আবরণ রাখে। পুরুষদের মাথায় লাল ফেটি বাঁধতে দেখা যায়। এরা শামুক ও ঝিনুকের খোল দিয়ে নির্মিত গয়না ব্যাবহার করে। এই জাতির বিশেষত্ব হলো এদের দেহে বিভিন্ন রঙের ট্যাটুর ব্যবহার। বিভিন্ন পরিস্থিতি বা কার্যকলাপ ফুটিয়ে তুলতে এরা শরীরের বিভিন্ন অংশে শুয়োরের চর্বি, মাটি ও কোরালের গুঁড়ি মিশিয়ে লাল, সাদা বা মেটে রঙের ট্যাটু আঁকে। যেমন কোনো মহিলা গর্ভবতী হলে তার জন্য নির্দিষ্ট ট্যাটু। কেউ জঙ্গলে মধু খেলে সেটা প্রকাশের জন্য বা কারো বিবাহ সম্পন্ন হলে তার জন্য ভিন্ন ভিন্ন ট্যাটু আঁকা হয়। জারোয়ার সাধারণত আনন্দ করেই বাঁচতে ভালোবাসে। আর তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের নাচের মাধ্যমে। নিজেদের মধ্যেই দলবদ্ধ ভাবে তারা নৃত্য গীত নিয়ে মেতে ওঠে। তারা পরস্পরের সঙ্গে জড়োয়া ভাষাতেই কথা বলে। এদের বিবাহের মধ্যে কোনও বিশেষত্ব নেই। তবে কৈশরেই এরা জীবনসঙ্গী নির্বাচন করে নেয়। পরিবারতান্ত্রিক এদের সমাজে এখনও সবাই দলবদ্ধ ভাবে বসবাস করে। জঙ্গলের ডালপালা আর পাতা দিয়ে নির্মিত এদের ঝুপড়ির মত ঘরের নাম চাদ্দা। এই জনগোষ্ঠীর মানুষরা বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার ভালোবাসে। তবে বিপদ বুঝলে আক্রমণ করতে ছাড়ে না।
অবশেষে বলি, সবুজ দ্বীপের রাজার এই রাজত্বে আমারাই কিন্তু বহিরাগত। আন্দামান ভ্রমণের একটা বড় আকর্ষণ ATR ধরে গভীর অরণ্যে এই জারোয়া শ্রেণীর মানুষজনদের দেখা পাওয়া আর বরাটাং এর লাইম কেভ ও মাড ভলকানো দেখা। এক্ষেত্রে জারোয়া সম্প্রদায়ের নিজস্বতা যেন ক্ষুণ্ন না হয়, সে দ্বায়িত্ব অবশ্যই আমাদের সকলের। পর্যটনের খাতিরে সেই স্বকীয়তা নষ্ট হলে ক্ষতি কিন্তু আখেরে আমাদেরই।


আরও পড়ুন
সময়
অনসূয়া পাঠক: একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের জেনারেল ম্যানেজার সবুজ বোস। রাজারহাট নিউটাউনের একটি বহুতল আবাসনে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে সুখী জীবন তার। কাজের বাইরে উনার নেশা বলতে নামীদামী পুরানো মডেলের হাত ঘড়ি কালেকশন। এই বিষয়ে তাঁর সংগ্রহশালাটি রীতিমতো চমকে দেবার মতো। তিনি যে বিদেশী মডেলের রিস্ট ওয়াচটি সবচেয়ে বেশী ব্যাবহার করেন সেটা হঠাৎই একদিন খারাপ হয়ে যাওয়াতে পার্শ্ববর্তী করিম চাচার ঘড়ির দোকানে তিনি যান। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে দোকানের শো কেসে তাঁর নজর আটকে যায় জার্মানি মডেলের একটি পুরানো ঘড়ির দিকে। এই .....বিস্তারিত পড়ুন
ChatGPT শিক্ষার্থীদের জন্য আশীর্বাদ না অভিশাপ ?
উত্তরাপথ: ChatGPT বর্তমানে একটি বহুল প্রচলিত শব্দ বিশেষকরে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে। এবার আসা যাক ChatGPT নিয়ে ছাত্র সমাজের কেন এত আগ্রহ? ChatGPT হল একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial intelligence)। OpenAI এটিকে ২০২২ নভেম্বরে বাজারে আনে। এর মাধ্যমে একজন ব্যবহারকারী তার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর মুহূর্তে পেতে পারে এছাড়াও এই অ্যাপ ইমেল, প্রবন্ধ সেই সাথে কোড রচনার কাজেও সাহায্য করে। এবার আসাযাক ChatGPT র কাজ প্রসঙ্গে ধরুন আপনি রবীন্দ্রনাথের মত কবিতা লিখতে আগ্রহী অথচ আপনি কবি .....বিস্তারিত পড়ুন
বেতন, মাসে ৩০,০০০ আর সম্পত্তির মালিকানা ৭ কোটির বেশী
উত্তরাপথ: এ এক দুর্নীতির অনন্য নজির যা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি কে লজ্জায় ফেলবে । দুর্নীতির এই অভিযোগটি উঠেছে মধ্যপ্রদেশ পুলিশ হাউজিং কর্পোরেশনের সহকারী প্রকৌশলী ইনচার্জ হেমা মীনার বিরুদ্ধে।মধ্যপ্রদেশের সরকারি কর্মকর্তা দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের পর হেমা মীনা প্রচার মাধ্যমের নজরে আসে । এখন প্রশ্ন কে এই হেমা মীনা ? মধ্যপ্রদেশ পুলিশ হাউজিং কর্পোরেশনের চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োজিত সহকারী প্রকৌশলী ইনচার্জ যিনি মাসে ৩০,০০০ টাকা আয় করেন । দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে তার বাড়ি থেকে সাতটি বিলাসবহুল গাড়ি, ২০,০০০ বর্গফুট .....বিস্তারিত পড়ুন
শ্বাস-প্রশ্বাসে অস্বস্তি: স্লিপ অ্যাপনিয়া দীর্ঘ কোভিড ঝুঁকির সাথে যুক্ত
উত্তরাপথ: ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথের রিকভার ইনিশিয়েটিভ এবং এনওয়াইইউ ল্যাঙ্গোন হেলথের একটি সমীক্ষা অনুসারে কোভিড পরবর্তীকালে প্রাপ্তবয়স্কদের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষণগুলির জন্য ১২-৭৫% কোভিডের ঝুঁকি বেড়েছে, যা সরাসারি স্লিপ অ্যাপনিয়ার সঙ্গে যুক্ত । অথচ শিশুদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি প্রায় নেই । .....বিস্তারিত পড়ুন