বিশ্বব্যাপী ১০ বিলিয়ন কিলোগ্রাম কফি বর্জ্য ব্যবহারে বিজ্ঞানীদের অভিনব আবিষ্কার

উত্তরাপথঃ কফি হল বিশ্বব্যাপী খাওয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়গুলির মধ্যে একটি, সারা পৃথিবী জুরে লক্ষ লক্ষ মানুষ এক কাপ কফি দিয়ে তাদের দিন শুরু করে। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ১০ বিলিয়ন কিলোগ্রাম (২২ বিলিয়ন পাউন্ড) কফি বর্জ্য বিশ্বব্যাপী উৎপন্ন হয় যার বেশিরভাগই ল্যান্ডফিলে শেষ হয়।আমরা জানি যে কোনও জৈব বর্জ্যর ল্যান্ডফিলে নিষ্পত্তি একটি পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করে কারণ এটি মিথেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইড সহ প্রচুর পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করে, যা জলবায়ু পরিবর্তনে অবদান রাখে।

একবার বীজ থেকে কফি তৈরির প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হয়ে গেলে অবশিষ্ট কফি বর্জ্যর কি হবে? সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা সেই বাতিল কফি বর্জ্যর একটি ব্যবহারিক প্রয়োগ নিয়ে একটি উত্তেজনাপূর্ণ আবিষ্কার করেছেন।গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে ,একবার চাষ করার পর কফি গ্রাউন্ডগুলি বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনের জন্য পুনরায় ব্যবহার করা যেতে পারে, যা কফি গ্রাউন্ডগুলিকে অবিশ্বাস্যভাবে মূল্যবান সম্পদ করে তোলে। এই আবিষ্কারটি শুধুমাত্র বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি উদ্ভাবনী সমাধান প্রদান করে না বরং দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশ বান্ধব এক নতুন সম্ভাবনাও উন্মুক্ত করে।

এই গবেষণার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ফলাফলগুলির মধ্যে একটি হল সার হিসাবে কফি গ্রাউন্ডের সম্ভাবনা। কফি গ্রাউন্ডগুলি নাইট্রোজেন, পটাসিয়াম এবং ফসফরাসের মতো প্রয়োজনীয় পুষ্টিতে সমৃদ্ধ, যা উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মাটিতে কফি গ্রাউন্ডগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে, গবেষকরা উন্নত উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং ফসলের ফলন বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করেছেন। এই আবিষ্কারটি ঐতিহ্যগত সারের একটি পরিবেশ বান্ধব বিকল্প প্রদান করে কৃষিতে বিপ্লব ঘটাতে পারে।

বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান নির্মাণ শিল্পে ব্যবহারের জন্য কফি গ্রাউন্ডের মতো জৈব পণ্যগুলি ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছে। যেহেতু কফি গ্রাউন্ড সরাসরি কংক্রিটে যোগ করা যায় না কারণ কফি গ্রাউন্ডে থাকা রাসায়নিকগুলি বিল্ডিং উপাদানের শক্তিকে দুর্বল করে দেয় সেই কারণে গবেষকদলটি কম শক্তির মাত্রা ব্যবহার করে কফির বর্জ্যকে অক্সিজেন থেকে আলাদা করার সময় ৩৫০ °C (প্রায় ৬৬০ °F) তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করে।তাদের এই আবিষ্কার একই সময়ে একাধিক সমস্যার সমাধান করতে পারে।এই প্রক্রিয়াটিকে পাইরোলাইজিং বলা হয়। এটি জৈব অণুগুলিকে ভেঙ্গে ফেলে, যার ফলে বায়োচার নামক একটি ছিদ্রযুক্ত, কার্বন-সমৃদ্ধ চারকোল তৈরি হয়, যা সিমেন্ট ম্যাট্রিক্সের সাথে বন্ধন তৈরি করতে পারে এবং এর সাথে নিজেকে যুক্ত করতে পারে।

এছাড়াও , কফি গ্রাউন্ড কীটপতঙ্গ তাড়াতে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। কফির শক্তিশালী গন্ধ পোকামাকড় এবং কীটপতঙ্গের জন্য একটি প্রাকৃতিক প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করে, যা এটিকে একটি রাসায়নিক ভিত্তিক কীটনাশকের পরিবেশ বান্ধব বিকল্প করে তোলে। এই আবিষ্কার শুধুমাত্র ক্ষতিকারক রাসায়নিকের উপর নির্ভরতা কমায় না বরং পরিবেশ বান্ধব কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকেও উৎসাহিত করে।

গবেষকরা দেখেছেন যে কৃষি প্রয়োগের পাশাপাশি, কফির স্থলগুলি জৈব জ্বালানীর উৎস হিসাবেও ব্যবহার করা যেতে পারে। পাইরোলাইসিস নামক একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, কফি গ্রাউন্ডগুলিকে জৈব তেলে রূপান্তরিত করা যেতে পারে, যা পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উৎস হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই আবিষ্কারটি শুধুমাত্র জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমায় না বরং শক্তি উৎপাদনের জন্য একটি দীর্ঘস্থায়ী সমাধানও প্রদান করে।

বিজ্ঞানীরা কসমেটিক শিল্পে কফি গ্রাউন্ডের অ্যাপ্লিকেশনগুলিও অন্বেষণ করেছেন। কফি গ্রাউন্ডে এক্সফোলিয়েটিং বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেছে, যা এগুলিকে ত্বকের যত্নের পণ্যগুলির জন্য একটি চমৎকার উপাদান করে তোলে। কফি গ্রাউন্ডের মৃদু ঘর্ষণকারীতা মৃত ত্বকের কোষগুলিকে অপসারণ করতে সাহায্য করে, ত্বককে মসৃণ এবং পুনরুজ্জীবিত করে। এই আবিষ্কারটি পরিবেশ বান্ধব স্কিনকেয়ার পণ্যগুলির বিকাশের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

যদিও এই গবেষণাগুলি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, কিন্তু এই উত্তেজনাপূর্ণ ফলাফলগুলি ল্যান্ডফিলে যাওয়া জৈব বর্জ্যের পরিমাণকে ব্যাপকভাবে হ্রাস করার জন্য একটি উদ্ভাবনী উপায় হিসেবে উঠে আসছে আমাদের সামনে। কফি বর্জ্যর অ্যাপ্লিকেশনগুলি আপাতদৃষ্টিতে  নগন্য মনে হলেও ভবিষ্যতে অন্যান্য জৈব বর্জ্য কম করার ক্ষেত্রে এবং আমাদের পরিবেশ রক্ষা করার ক্ষেত্রে একটি সবুজ এবং কার্যকর বিকল্পের পথ প্রশস্ত করতে পারে।

সূত্রঃ Journal of Cleaner Production.

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


ফ্লিম রিভিউ -ওপেনহাইমার

উত্তরাপথ: বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান দ্বারা পরিচালিত”ওপেনহাইমার” একটি মাস্টারপিস মুভি। ছবিতে জে. রবার্ট ওপেনহেইমার, এক নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পারমাণবিক বোমার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।এই সিনেমায় ওপেনহাইমার এর জটিল জীবনকে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই হিসেবে 'ওপেনহাইমার'কে বায়োপিক বলা যেতে পারে।  কারণ এটি একজন মানুষের গল্প। এই ছবির গল্প তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত।ছবির শুরুতে পারমাণবিক বোমা তৈরির আবেগের কথা বলা হয়েছে।  যেখানে নায়ক কিছু না ভেবে নিবেদিতপ্রাণভাবে এমন একটি অস্ত্র তৈরিতে নিয়োজিত থাকে যা বিশ্বকে ধ্বংস করতে পারে।  অস্ত্র তৈরি হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে নায়ক তার কাজের ফলাফল দেখে অপরাধবোধে পূর্ণ হয়।  এবং তৃতীয় পর্যায়টি হল রাজনীতি  যা ওপেনহাইমারকে মোকাবেলা করতে হয়েছে।  পুরো সিনেমাটি রঙিন হলেও রাজনৈতিক অংশ সাদা-কালো রাখা হয়েছে।  এই তিনটি সময়কালে যা কিছু ঘটছে, তা সবই একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। .....বিস্তারিত পড়ুন

Roop Kishor Soni: একটি আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য তুলে ধরেছেন

উত্তরাপথঃ রাজস্থান মানেই ওজনদার রূপার গহনা ,আর তার উপর কারুকাজ। প্রচলিত এই ধারনা ভেঙ্গে আজ রূপোর গহনাকে আধুনিকতার সাথে শিল্পের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন যে ব্যক্তি তিনি হলেন রূপ কিশোরী সোনী(Roop Kishor Soni)।তিনি ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে তার অসাধারণ শিল্প কর্মের জন্য জাতীয় পুরুস্কার পান। রাজস্থানের জয়সলমেরের শহরের এই শিল্পী ৩.৮ গ্রাম ওজনের ০.৯ সেমি চওড়া রৌপ্য আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য খোদাই করেছেন।এই ছোট রূপার আংটিতে শিল্পী তাজমহল, সিডনি অপেরা হাউস, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, চীনের গ্রেট ওয়াল, আইফেল টাওয়ার, বিগ বেন, পিসার হেলানো টাওয়ার এবং মিশরীয় পিরামিডের চিত্র এক সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন।এছাড়াও তিনি আরও দুটি পৃথক ডিজাইনের অত্যাশ্চর্য আংটি  তৈরি করেছেন।৮.৬ গ্রাম ওজনের একটি রিংয়ে তিনি সূর্যাস্তের সময় ভারতীয় উট সাফারি সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভারতীয় বিশেষত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন,এবং অন্যটিতে বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবী ছবি এবং মন্দির খোদাই করেছিলেন। শিল্পী বলেছেন যে তিনি তার বাবার কাছ থেকে তার শৈল্পিক দক্ষতা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সেই সাথে তিনি বলেন "আমার বাবাও একজন জাতীয় পুরুস্কার প্রাপ্ত শিল্পী ছিলেন। তিনি আমাকে শিল্পের এই দক্ষতা শিখিয়েছিলেন কারণ তিনি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে শিল্পের ফর্মটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।" .....বিস্তারিত পড়ুন

সম্পাদকীয়-  রাজনৈতিক সহিংসতা ও আমাদের গণতন্ত্র

সেই দিনগুলো চলে গেছে যখন নেতারা তাদের প্রতিপক্ষকেও সম্মান করতেন। শাসক দলের নেতারা তাদের বিরোধী দলের নেতাদের কথা ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন।  আজ রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে।  কেউ কারো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়।  আগ্রাসন যেন রাজনীতির অঙ্গ হয়ে গেছে।  রাজনৈতিক কর্মীরা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খুন বা মানুষ মারার মত অবস্থার দিকে ঝুঁকছে। আমাদের দেশে যেন রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না।আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে বেশি মানুষ নিহত হচ্ছেন।  ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) অনুসারে, ২০১৪ সালে, রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৪০০ জন প্রাণ হারিয়েছিল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২০০০ জন মারা গিয়েছিল।  আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য গর্বিত হতে পারি, কিন্তু এটা সত্য যে আমাদের সিস্টেমে অনেক মৌলিক সমস্যা রয়েছে যা আমাদের গণতন্ত্রের শিকড়কে গ্রাস করছে, যার জন্য সময়মতো সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। .....বিস্তারিত পড়ুন

বিশ্বকাপ ২০২৩: পাকিস্তানকে হারিয়ে Afghanistan এ ঈদের মতো পরিস্থিতি

আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০২৩-এর ২২ তম ম্যাচে আফগানিস্তান পাকিস্তানকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছে। সেই ম্যাচে পাকিস্তানকে ৮ উইকেটে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে আফগানিস্তান। এই প্রথম ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে হারাল আফগানিস্তান আর এই পাকিস্তানকে হারিয়ে আফগানিস্থানে(Afghanistan)এখন ঈদের মতো পরিস্থিতি।এক আফগানিস্থানি সমর্থকের মতে এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এবং নিজেদের মত করে তারা তাদের এই খুশী উদযাপন করেছেন। এক্স হ্যান্ডেলে এক সমর্থকের মতে, সেদিন উদযাপন ছিল, পার্টি ছিল। এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এছাড়াও, এটি ছিল ২০২৩ বিশ্বকাপের তৃতীয় বড় আপসেট । টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় বাবর আজমের দল। প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান দল ২৮২ রান করে। জবাবে আফগানিস্তান দল ২৮৩ রান তাড়া করে ৪৯ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্য অর্জন করে। এই ম্যাচে হারের পর বেশ ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল অধিনায়ক বাবর আজমকে। ম্যাচ-পরবর্তী উপস্থাপনার সময়, তিনি দলের ত্রুটিগুলি তালিকাভুক্ত করেছিলেন এবং পরাজয়ের জন্য নিজেদের দায়ী করেছিলেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top