

বলরাম মাহাতোঃ আদিবাসী যেমন – কুড়মি, ওঁরাও, সাঁওতাল, মুন্ডা, পাহান, ভূমিজ সহ প্রায় ৩৮ টি জাতির মানুষ করম পরব পালন করে । প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শুক্ল একাদশী তিথিতে করম পরব উৎসব হয়ে থাকে। এর সাত / পাঁচ / তিন দিন আগে মেয়েরা ভোরবেলায় শালের দাঁতন কাঠি ভেঙে নদী বা পুকুরে স্নান করে বাঁশ দিয়ে বোনা ছোট টুপা ও ডালায় বালি দিয়ে ভর্তি করেন। তারপর গ্রামের প্রান্তে একস্থানে ডালাগুলিকে রেখে জাওয়া গান গাইতে গাইতে তিন পাক ঘোরে। এরপর তাতে তেল ও হলুদ দিয়ে মটর, মুগ, বুট, জুনার ও কুত্থির বীজ মাখানো হয়। অবিবাহিত মেয়েরা স্নান করে ভিজে কাপড়ে ছোট শাল পাতার থালায় বীজগুলিকে বুনে দেন ও তাতে সিঁদুর ও কাজলের তিনটি দাগ টানা হয়, যাকে জাওয়া ডালি বলা হয়। এরপর ডালাতে ও টুপাতে বীজ বোনা হয়। এরপর প্রত্যেকের জাওয়া চিহ্নিত করার জন্য কাশকাঠি পুঁতে দেওয়া হয়। একে জাওয়া পাতা বলা হয়। যে সমস্ত কুমারী মেয়েরা এই কাজ করেন, তাঁদের জাওয়ার মা বলা হয়। ডালার জাওয়াগুলিকে নিয়ে তাঁরা গ্রামে ফিরে আসেন।
করম পুজোর দিন গ্রামের বয়স্কদের একটি নির্দিষ্ট স্থানে দুইটি করম ডাল এনে পুঁতে রাখা হয়, যা সন্ধ্যার পরে করম ঠাকুর এবং ধরম ঠাকুর হিসেবে পূজিত হন। কুমারী মেয়েরা সারাদিন উপোষ করে সন্ধ্যার পরে থালায় ফুল, ফল সহকারে নৈবেদ্য সাজিয়ে এই স্থানে গিয়ে পূজা করেন। করম ডালে ভেঁট (আলিঙ্গন) নেন, যা বৃক্ষের প্রতি ভালবাসার প্রতীক । এরপর করম ডাল ও জাওয়া ডালি কে ঘিরে নাচ-গান চলে। পরদিন সকালে মেয়েরা জাওয়া থেকে অঙ্কুরিত বীজগুলিকে উপড়ে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়ে বাড়িতে বিভিন্ন স্থানে সেগুলিকে ছড়িয়ে দেন। এরপর করম ডালটিকে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয় জলাশয়ে।এই জাওয়া উঠানোর মধ্য দিয়ে কৃষি উৎসবকে লক্ষ্য করে মেতে ওঠে পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, ছোট-নাগপুর ,উড়িষ্যার এমনকি সুদূর আসামের আদিবাসী ভাই বোনেরা।এটি সাত দিন ধরে বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম হওয়ার উৎসব গ্রামে গঞ্জে আদিবাসী ও অ-আদিবাসীর মনে দামামা বাজায় যার শেষ হয় ধুমসা,মাদল, নাচগান ও গীতের মধ্য দিয়ে।
পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ করে পুরুলিয়া জেলায় ছোট বড় প্রায় সব গ্রামে এই করম পরব কে উপলক্ষ করে সমস্ত আচার লোকাচার মেনে কুমারী মেয়েরা জাওয়া পাতায় পূজা করে। ছোট নাগপুরের কৃষি সভ্যতার সঙ্গে যুক্ত অতি প্রাচীন এই সংস্কৃতি রক্ষার্থে প্রতিবছরই করম পরব বিভিন্ন এলাকায় আনুষ্ঠানিক রূপে উদযাপিত হয়। শুধু মাত্র পুরুলিয়াতেই নয় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতে এবং ভিন রাজ্য ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা ও আসামে কৃষি সভ্যতার সূচনার এই উৎসব পালন করা হয় গ্রামে গ্রামে অঙ্কুরোদগম প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক রূপ দিয়ে সভ্যতার বিকাশে তা কতটা তাৎপর্য পূর্ণ তা বিকশিত হয় করম নাচ ও জাওয়া গানের মধ্য দিয়ে।এই রকম একটি করম গান হলো -“আজ রে করম ঠাকুর ঘরে দুয়ারে রে ঘরে দুয়ারে আর কালরে করম ঠাকুর কাশনদীর পাড়ে”
মেয়েরা নিজেদের জীবনের সুখ দুঃখ কাহিনী তুলে ধরে এই জওয়া গানের মধ্য দিয়ে।ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখকে বাইরে রেখে সংযোগের এই সার্বজনীন উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় বসে করম আকড়ার আসর। করম উৎসব সাধারণত কুমারী মেয়েরা তাদের ভাই ও পরিবারের মঙ্গল কামনার্থে পালন করে থাকে। যার সূচনা কবে হয়েছিল তা বলা সম্ভব নয়। প্রাচীন যুগে যখন মানুষের শিকার একমাত্র জীবনের অবলম্বন ছিল, মানুষরা কৃষিকাজের ব্যবহার জানতোনা।সেইসময় ঘরের বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা ফলের বীজ ও ঘাসের বীজ নিয়ে খেলা করতো এবং যখন খেলা শেষ হয়ে যেত তখন সেগুলিকে পরের দিনে খেলার জন্য বালির মধ্যে ঢাকিয়ে রাখতো।এরপর একদিন তারা দেখল পুতে রাখা বীজটা অংকুর হয়ে গেছে এবং এখান থেকেই তাদের চাষের পদ্ধতির আবিষ্কার হল।
এইভাবে অংকুর হওয়ার জন্য তাদের মনে যে আনন্দ হইলো সেখান থেকেই তারা এই জাওয়া পাতিয়ে তাকে ঘিরে নাচ-গান করে নাচতে শুরু করলো। প্রাচীনকালের অনেকেরই এই ধারণা যে বীজের এই অঙ্কুরোদগম প্রক্রিয়া থেকেই কৃষি সভ্যতার সূচনা ও বিকাশ এর জন্য মেয়েদের কৃতিত্ব রয়েছে। কারণ মেয়েরাই এটা প্রথম শুরু করেছিল বীজ থেকে অঙ্কুরোদগমের প্রক্রিয়া এবং কৃষিকাজের সূচনা।সেই থেকেই তার সেলিব্রেশন করা হয় এই জাওয়া গানের মধ্য দিয়ে। তাই এই জাওয়া পরবকে বলা হয় সেলিব্রেশন অফ জার্মিনেশন।প্রাচীনকাল থেকেই পরবের মধ্যে দিয়ে কৃষিকাজের সূচনাকে একটা সংস্কৃতি রূপে পালন করা হয়ে আসছে।বর্তমানে করম উৎসব বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্কুল কলেজেও পালন করা হচ্ছে এবং রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এই দিনটিকে পূর্ণ ছুটির ঘোষণা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন
দীপাবলির সময় কেন পটকা ফোটানো নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা যায় না ?
উত্তরাপথঃ দীপাবলির পরের দিন, যখন কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (CPCB) শহরের বায়ু মানের সূচকের তালিকা প্রকাশ করে,তখন দেখা যায় রাজধানী দিল্লি বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দূষিত শহরের প্রথমেই রয়েছে। CPCB-এর মতে, ১২ নভেম্বর বিকেল ৪ টায় দিল্লির বায়ু মানের সূচক ছিল ২১৮ যা ভোরের দিকে বেড়ে ৪০৭ এ পৌঁছায় । ৪০০ – ৫০০ AQI এর স্তর সুস্থ ব্যক্তিদের প্রভাবিত করে। দীপাবলির সারা রাত, লোকেরা পটকা ফাটিয়ে দীপাবলি উদযাপন করে। ১৩ নভেম্বর বিকেল ৪ টায় কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ আবার তথ্য প্রকাশ করে এই তালিকায়, দিল্লির গড় বায়ু মানের সূচক ছিল ৩৫৮ যা 'খুব খারাপ' বিভাগে পড়ে। বায়ু দূষণের এই পরিস্থিতি শুধু দিল্লিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। নয়ডার বায়ু মানের সূচক ১৮৯ থেকে ৩৬৩ এ এবং রোহতক, হরিয়ানার ১৩৭ থেকে বেড়ে ৩৮৩ হয়েছে। দীপাবলির দুই দিন দিল্লি ,নয়ডা ,কলকাতা, মুম্বাই সহ দেশের অন্যান্য শহরেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। এই দিনগুলিতে মানুষ বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে বাধ্য হয়েছে। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জাতীয় রাজধানী দিল্লি এবং নয়ডায় সবুজ পটকা ছাড়া যে কোনও ধরণের আতশবাজি ফাটান সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ। আদালত সবুজ পটকা পোড়ানোর সময়ও নির্ধারণ করে দিয়েছে রাত ৮টা থেকে ১০টা। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশের মানে কী? আদালতের এই আদেশ কি এখন প্রত্যাহার করা উচিত? পুলিশ কেন এই আদেশ কার্যকর করতে পারছে না? এর জন্য কি পুলিশ দায়ী নাকি সরকারের উদাসীনতা রয়েছে এর পেছনে? .....বিস্তারিত পড়ুন
Electoral Bond এর গোপনীয়তা সরিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে, জানাতে হবে প্রাপ্ত অনুদানের পরিমাণ
উত্তরাপথঃ বুধবার, নির্বাচনী বন্ড (Electoral Bond)প্রকল্পের আইনি বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের শুনানি হয়। শীর্ষ আদালত তার মন্তব্যে বলেছে, 'নির্বাচনী বন্ডগুলি রাজনৈতিক দলগুলিকে বেনামী অর্থ প্রদান করে, কারণ তাদের কেনাকাটা সম্পর্কিত রেকর্ডগুলি স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কাছে উপলব্ধ যা শুধুমাত্র তদন্তকারী সংস্থাগুলি অ্যাক্সেস করতে পারে৷ এর আগে নির্বাচনী বন্ড’ (Electoral Bond) সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টে (Supreme Court) কেন্দ্র দাবি করেছিল, রাজনৈতিক দলগুলির আয়ের উৎস জানার অধিকার নেই জনতার।এবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তৎপর হল নির্বাচন কমিশন (Election Commission of India)।বুধবার বিকেল ৫টার মধ্যে যাবতীয় হিসেব জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কমিশনের তরফে।নির্বাচনী বন্ডের (Electoral Bond)মামলায় কেন্দ্রের আর্জি সত্বেও সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক দলগুলিকে আয়ের উৎস জানাতে বলেছিল। আদলত নির্দেশ দিয়েছিল, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক দল কত অনুদান মিলেছে, সেই তথ্য বন্ধ খামে জানাতে হবে।এর আগেও নির্বাচনী বন্ডের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একাধিক মামলা হয়েছে শীর্ষ আদালতে। মামলাকারীরা অভিযোগ করেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলি এই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ বিদেশ থেকে পেতে পারে এর ফলে গণতন্ত্র ধ্বংস হবে। যদিও কোনও রাজনৈতিক দলই এই দাবি মানতে চায়নি। ৩ অক্টোবর মামলার শুনানিতে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সব তথ্য দিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এই রায়ের পরেই তৎপর হল কমিশন। .....বিস্তারিত পড়ুন
PAN-Aadhar link: কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে নিষ্ক্রিয় করেছে
উত্তরাপথ : আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link)করার সময়সীমা শেষ হওয়ার পরে কেন্দ্রীয় সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ড নিষ্ক্রিয় করেছে৷ আপনি যদি এখনও প্যান কার্ডের সাথে আধার কার্ড লিঙ্ক না করে থাকেন, তাহলে আপনি সরকারের এই কঠোর পদক্ষেপের আওতায় এসেছেন। আপনি যদি আপনার আধার কার্ডকে প্যানের সাথে লিঙ্ক করতে চান তবে আপনি জরিমানা দিয়ে এটি সক্রিয় করতে পারেন। কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে আধারের সাথে লিঙ্ক না করার কারণে নিষ্ক্রিয় করেছে। একটি আরটিআই-এর জবাবে, সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস জানিয়েছে যে আধার কার্ডের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link) করার সময়সীমা ৩০ জুন শেষ হয়েছে। যারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আধার কার্ড এবং প্যান কার্ড লিঙ্ক করেননি তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দেশে ৭০ কোটি প্যান কার্ড বর্তমানে ভারতে প্যান কার্ডের সংখ্যা ৭০.২ কোটিতে পৌঁছেছে। এর মধ্যে প্রায় ৫৭.২৫ কোটি মানুষ আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক করেছেন। .....বিস্তারিত পড়ুন
Fried rice syndrome: আগের দিনের রান্না করা ভাত খেলে হতে পারে এই বিশেষ অসুখটি
উত্তরাপথঃ আপনার কি বাসী ভাত বা পান্তা খাওয়ার অভ্যেস আছে? সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম (Fried rice syndrome) নিয়ে আমরা প্রায়ই অবশিষ্ট খাবার গরম করে আবার খাই। কিন্তু জানেন কি এই অভ্যাস আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। অনেক সময় পর আগের রান্না করা ভাত খাওয়ার ফলে পেট সংক্রান্ত সমস্যা হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে খাবার পুনরায় গরম করলে এতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, কিন্তু তা নয়। যে খাবারেই স্টার্চ থাকে না কেন, এতে উপস্থিত টক্সিন তাপ প্রতিরোধী। অর্থাৎ খাবার গরম করার পরও ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয় না। ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম নামে এই সমস্যা সম্পর্কিত একটি অবস্থা রয়েছে। আজ আমরা এই ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম অবস্থার লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। ভাত রান্না করার পর, যখন অবশিষ্ট ভাত কয়েক ঘন্টা বা সারারাত ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয় এবং তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে শুরু করে, তখন এই অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম। .....বিস্তারিত পড়ুন