

উত্তম কুমার পতিঃ “ক্ষমা” শব্দটি এত পবিত্র কেন জানো তাতে মা আছে। কথাটা কে বলেছেন মনে নেই, কিন্তু কথাটা মনে গেঁথে আছে। এই পৃথিবীতে একমাত্র মা -শিশুর সম্পর্কই প্রাকৃতিক, বাকি সব সম্পর্কই সামাজিক। তাইতো সংকটে- সমস্যায়- যন্ত্রণায় আমাদের অন্তর থেকে বেরিয়ে আসে যে শব্দ তা এই এক অক্ষরের “মা”।মায়ের এই প্রাকৃতিক টান কেউ কি উপেক্ষা করতে পারেন? মায়ের সঙ্গসুখ যে শিশুর কপালে জোটে না তার মত হতভাগ্য শিশু আর কে আছে? এই হতভাগ্য শিশুদের অন্তরের ক্ষত শুকোয় না আজীবন। প্রমাণ, রবীন্দ্রনাথ। ঠাকুর বাড়ির দস্তুরমত মা’কে কাছে পাননি শিশু রবীন্দ্রনাথ। মানুষ হয়েছেন চাকরদের তত্ত্বাবধানে।ছিলেন মাতৃস্তন্যবঞ্চিত।ধাইমার স্তন্যপান করেই বড় হয়েছেন।উপরন্তু খুব অল্প বয়সেই মাতৃহীন হয়েছিলেন তিনি।মা’র স্নেহ পাওয়ার আকুতি তাই তাঁর লেখায় অনেকবার এসেছে।সেই যে “বীরপুরুষ” কবিতায় যেখানে ছোট শিশুটি কল্পনা করছে, ডাকাত দলের হাত থেকে সে মাকে রক্ষা করছে, আর মা তাঁর শিশু পুত্রের বীরত্বে অভিভূত হয়ে পালকি থেকে নেমে চুমো খেয়ে তাকে কোলে তুলে নিচ্ছেন। আর শিশুটি তখন ভাবছে এমন যদি সত্য হতো খুব ভালো হতো।
” রোজ কত কি ঘটে যাহা তাহা
এমন কেন সত্য হয় না আহা”
“সহজ পাঠে”ও তো আছে মাকে নিয়ে একটি শিশুর বনবাসী হওয়ার কল্পনা বিলাস। সেই যে—
“-ঐখানে মা পুকুর-পাড়ে
জিয়ল গাছের বেড়ার ধারে হোথায় হব বনবাসী,
কেউ কোত্থাও নেই। “
শুধু শিশুটি থাকবে আর থাকবেন তার মা। শিশুটি তার মাকে অভয় দিচ্ছে —-
“বাঘ ভাল্লুক অনেক আছে —-
আসবে না কেউ তোমার কাছে
দিনরাত্তির কোমর বেঁধে
থাকবো পাহারাতে। “
এখানেও মাতৃসান্নিধ্য – বঞ্চিত রবীন্দ্রনাথের কল্পনাবিলাস।
এ তো গেল রবীন্দ্রনাথের কথা। তিনি না হয় কবি। কিন্তু সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী যিনি তাঁর মনও কি মায়ের জন্য ব্যাকুল হয়? হয় বৈকি, খুব হয়।”সব পাখি ঘরে ফেরে —–” তাই জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে মায়ের জন্য মন কেমন করে উঠেছিল বিবেকানন্দের।
স্বামীজী তখন দীর্ঘ প্রবাস থেকে দেশে ফিরেছেন।দেশে ফিরে প্রতিষ্ঠা করেছেন রামকৃষ্ণ মিশন।অত্যধিক পরিশ্রমে তাঁর শরীর তখন ভেঙে পড়েছে।তিনি তখন ক্লান্ত।তখন তিনি চাইছেন কর্ম থেকে অব্যাহতি।চাইছেন জগতের কাজ থেকে অব্যাহতি নিয়ে নিজের কিছু কাজ করতে।
এই নিজের কাজের একটি ছিল মায়ের জন্য কিছু করার বাসনা।তাঁর মনে হয়েছে মায়ের প্রতি সন্তানের কর্তব্য তিনি পালন করতে পারেননি। জগতের কর্মযজ্ঞে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু সময় দিতে পারেননি মাকে। স্বামীজী তখনই অনুভব করেছিলেন তাঁর জীবনদীপ নিভে আসছে। নানাজনকে চিঠিতে লিখছেন তিনি আর কয়েক বছরই মাত্র বাঁচবেন। এমন সময়ই মায়ের জন্য ব্যাকুল হয়েছে সন্ন্যাসীর হৃদয়। ১৭ই জানুয়ারি ১৯০০, মিসেস বুলকে স্বামীজি লিখলেন।
” এটা আমার কাছে ক্রমেই স্বচ্ছতর হয়ে উঠছে মঠের কাজ ছেড়ে দিয়ে কিছু সময়ের জন্য মায়ের কাছে ফিরে যাই।আমার জন্য তাঁকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তাঁর শেষ দিনগুলিতে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য আনার চেষ্টা আমাকে অবশ্যই করতে হবে । “
স্বামীজী চেয়েছিলেন তাঁর মায়ের জন্য একটি বাড়ি বানাবেন। কিন্তু বানাবো বললেই তো হয় না তার জন্য টাকা লাগে। সন্ন্যাসী তিনি, টাকা পাবেন কোথায়? আমেরিকাতে যতটুকু রোজগার করেছেন সব ব্যয় হয়ে গেছে মঠ মিশন প্রতিষ্ঠায়। তাই নিরুপায় স্বামীজী সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন তাঁর আস্থাভাজন খেতড়ির মহারাজা অজিত সিংহের কাছে।সেই অজিত সিংহ যিনি ইতিমধ্যেই স্বামীজীর মা’কে মাসিক ১০০ টাকা অর্থসাহায্য করছিলেন।স্বামীজী মহারাজকে লিখলেন—–
“মহারাজ এর কাছে আজ একটি আমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন নিয়ে হাজির হচ্ছি, —এই জেনে যে আপনার কাছে মন খুলতে আমার একটুও লজ্জা নেই, এবং আমি আপনাকে এ জীবনে একমাত্র বন্ধু বলে মনে করি। যা লিখছি তা আপনার মনে সাড়া জাগায়, ভালো, যদি না জাগায়, আমার নির্বুদ্ধিতা ক্ষমা করবেন যেমন বন্ধুরা করে থাকে।……………. আমার বুকের মধ্যে একটি পাপ সর্বদাই পীড়া দেয় পৃথিবীর সেবা করার জন্য আমি আমার মায়ের সম্বন্ধে শোচনীয় উদাসীনতা দেখিয়েছি। আবার আমার দ্বিতীয় ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ বাইরে চলে যাওয়ায় মা শোকে একেবারে মুহ্যমান। এখন আমার শেষ ইচ্ছা, কয়েক বছরের জন্য যেন মায়ের সেবা করতে পারি। আমি মায়ের সঙ্গে বাস করতে এবং বংশ লোপ নিবারণ করতে ছোট ভাইয়ের বিয়ে দিতে চাই । মা এখন একটা যা -তা, কুঠুরিতে আছেন।তাঁর জন্য ভালো একটা বাড়ি করে দিতে এবং ছোট ভাইয়ের জন্য কিছু সংস্থান করতে চাই। এখন রামচন্দ্রের বংশোদ্ভব(মহারাজার) একজনের পক্ষে এই ব্যবস্থা করে দেওয়া কি খুব বড় কাজ বিশেষত যাকে ভালোবাসেন এবং বন্ধু বলে মনে করেন তার জন্য?
আর কার কাছে আবেদন জানাবো জানিনা।ইউরোপ থেকে যে টাকা পেয়েছি, তার সবই কাজের জন্য এবং তার শেষ পাই পয়সা পর্যন্ত দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি অন্যের কাছে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে সাহায্য চাইতে পারি না। আমার পারিবারিক ব্যাপার সম্বন্ধে মহারাজের কাছে খুলে বললুম এবং তা অন্য কেউ জানবে না। “
চিঠির শেষে স্বামীজি লেখেন “এ একেবারে ব্যক্তিগত চিঠি আপনি পারবেন কি পারবেন না , দয়া করে তার করে জানাবেন কি? “
খেতড়িকে লেখা স্বামীজীর পরবর্তী চিঠি থেকে বোঝা যায় মহারাজ কিছু অনুকূল উত্তর দিয়েছিলেন। তখন স্বামীজী জানিয়েছিলেন একটা ছোট বাড়ির খরচ লাগবে দশ হাজার টাকার মত।
স্বামীজীর জীবনীকার শ্রীমতি লুইবার্ক অনুমান করেছেন শেষ পর্যন্ত খেতড়ির রাজার পক্ষে ১০ হাজার টাকা দেওয়া সম্ভব হয়নি। আর স্বামীজীও তাঁর মাকে আলাদা বাড়ি তৈরি করে দিতে পারেননি। তার পরিবর্তে তিনি ৬০০০ টাকা দিয়ে নিজের খুড়ির কাছ থেকে পৈতৃক বাড়ির একটা অংশ কিনে নেন। মঠ তহবিল থেকে এজন্য তাকে পাঁচ হাজার টাকা ধার করতে হয়। যদিও সে বাড়ির দখল নেওয়ার জন্য স্বামীজিকে শেষ পর্যন্ত আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়। আদালতের এই খরচও মঠ তহবিল থেকে তাঁকে ধার নিতে হয়। অবশেষে বাড়ির দখল পাওয়া যায়। স্বামীজি শেষপর্যন্ত তাঁর ধার নেওয়া সব টাকা শোধ করতে পেরেছিলেন।যদিও স্বামীজীর আর শেষ পর্যন্ত মায়ের কাছে ফেরা হয়নি।তবুও শেষ অব্দি মায়ের জন্য এক চিলতে বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন তাঁর বিশ্বজয়ী সন্ন্যাসী সন্তান।জন্মদাত্রীর কোলে ফেরা হল না শেষ পর্যন্ত,এর কিছু পরেই স্বামীজীকে কোল দেবেন বিশ্বমাতা, দিনটি ৪ ঠা জুলাই ১৯০২।
আরও পড়ুন
Bandna Festival: ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পাঁচ দিন বাঁদনার আমেজে মশগুল থাকে
বলরাম মাহাতোঃ চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী কার্তিক অমাবস্যার আগের দিন থেকে মোট পাঁচ দিন ব্যাপী বাঁদনার(Bandna Festival) আমেজে মশগুল থাকে ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অবশ্য, পরবের শুভ সূচনা হয় তারও কয়েকদিন আগে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক শাসন ব্যবস্থার চূড়ামণি হিসাবে গাঁয়ের মাহাতো, লায়া, দেহরি কিম্বা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি নির্ধারণ করেন- ৩, ৫, ৭ বা ৯ ক’দিন ধরে গবাদি পশুর শিং-এ তেল মাখাবে গৃহস্বামী! রুখামাটির দেশের লোকেরা কোনোকালেই মাছের তেলে মাছ ভাজা তত্ত্বের অনুসারী নয়। তাই তারা গোরুর শিং-এ অন্য তেলের পরিবর্তে কচড়া তেল মাখানোয় বিশ্বাসী। কারণ কচড়া তেল প্রস্তুত করতে গোধনকে খাটাতে হয় না যে! কচড়া তেলের অপ্রতুলতার কারণে বর্তমানে সরষের তেল ব্যবহৃত হলেও, কচড়া তেলের ধারণাটি যে কৃষিজীবী মানুষের গবাদি পশুর প্রতি প্রেমের দ্যোতক, তা বলাই বাহুল্য! এভাবেই রাঢ বঙ্গে গোবর নিকানো উঠোনে হাজির হয়- ঘাওয়া, অমাবস্যা, গরইয়া, বুঢ়ি বাঁদনা ও গুঁড়ি বাঁদনার উৎসবমুখর দিনগুলি। পঞ্চদিবসে তেল দেওয়া, গঠ পূজা, কাঁচি দুয়ারি, জাগান, গহাইল পূজা, চুমান, চউক পুরা, নিমছান, গোরু খুঁটা, কাঁটা কাঢ়া প্রভৃতি ১১টি প্রধান পর্ব সহ মোট ১৬টি লোকাচারের মাধ্যমে উদযাপিত হয় বাঁদনা পরব(Bandna Festival )। .....বিস্তারিত পড়ুন
ফ্লিম রিভিউ -ওপেনহাইমার
উত্তরাপথ: বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান দ্বারা পরিচালিত”ওপেনহাইমার” একটি মাস্টারপিস মুভি। ছবিতে জে. রবার্ট ওপেনহেইমার, এক নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পারমাণবিক বোমার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।এই সিনেমায় ওপেনহাইমার এর জটিল জীবনকে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই হিসেবে 'ওপেনহাইমার'কে বায়োপিক বলা যেতে পারে। কারণ এটি একজন মানুষের গল্প। এই ছবির গল্প তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত।ছবির শুরুতে পারমাণবিক বোমা তৈরির আবেগের কথা বলা হয়েছে। যেখানে নায়ক কিছু না ভেবে নিবেদিতপ্রাণভাবে এমন একটি অস্ত্র তৈরিতে নিয়োজিত থাকে যা বিশ্বকে ধ্বংস করতে পারে। অস্ত্র তৈরি হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে নায়ক তার কাজের ফলাফল দেখে অপরাধবোধে পূর্ণ হয়। এবং তৃতীয় পর্যায়টি হল রাজনীতি যা ওপেনহাইমারকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। পুরো সিনেমাটি রঙিন হলেও রাজনৈতিক অংশ সাদা-কালো রাখা হয়েছে। এই তিনটি সময়কালে যা কিছু ঘটছে, তা সবই একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। .....বিস্তারিত পড়ুন
সেলফির উচ্চ রেটিং কি আপনাকে আরওপাতলা হতে উৎসাহিত করছে ?
উত্তরাপথঃ সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে সেলফি তোলা এবং নিজেকে পাতলা হিসাবে দেখানোর মধ্যে একটি সম্পর্ক থাকতে পারে। যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক সেন্ট জন ইউনিভার্সিটির রুথ নাইট এবং ইউনিভার্সিটি অফ ইয়র্কের ক্যাথরিন প্রেস্টন সম্প্রতি PLOS ONE জার্নালে তাদের ফলাফল প্রকাশ করেছেন।সেখানে সেলফির উচ্চ রেটিং এবং আমাদের শরীরের গঠনের মধ্যে যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ায় সেলফি হল এক জনপ্রিয় ছবি দেওয়ার ধরন। যিনি সেলফি তোলেন তিনি ক্যামেরাকে তাদের শরীর থেকে দূরে রেখে নিজেই নিজের ছবি তোলে। আগের গবেষণায় বলা হয়েছে সেলফিগুলি দেখার ফলে ছবির বিষয়গুলি সম্পর্কে দর্শকদের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন
Karar Oi Lauh Kapat: কাজী নজরুলের এই গানকে ঘিরে বিতর্কে এ আর রহমান
উত্তরাপথঃ বিতর্কে 'পিপ্পা' ছবির সঙ্গীত পরিচালক অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান।সম্প্রতি কবি কাজী নজরুল ইসলামের পরিবার একটি হিন্দি ছবিতে কবির জনপ্রিয় গান 'করার ঐ লৌহ কাপাত...' (Karar Oi Lauh Kapat )।কিন্তু এ আর রহমানের সঙ্গীত পরিচালনায় ওই গানটি যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে আপত্তি জানিয়েছে নজরুল পরিবার।বিতর্কের পর যে চুক্তির আওতায় ওই গানটি ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে তা প্রকাশ্যে আনার দাবি তুলেছে কবির পরিবার।'পিপ্পা' শিরোনামের হিন্দি চলচ্চিত্রটি যেখানে (Karar Oi Lauh Kapat )গানটি ব্যবহার করা হয়েছে তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া একজন ভারতীয় সেনা সৈনিককে কেন্দ্র করে একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। ছবির সঙ্গীত পরিচালক অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান। গানের কথা ঠিক রেখেও সুর পাল্টানোর অভিযোগে ভারত ও বাংলাদেশে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।কবির পরিবারের অভিযোগ, গানটি ব্যবহারের অনুমতি দিলেও সুর পরিবর্তনের অনুমতি দেওয়া হয়নি।পরিবারের সদস্যরাও ছবিটি থেকে গানটি বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। .....বিস্তারিত পড়ুন