রুকসানা রহমান, কানাডা
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। প্রথমবারের মতে ১৯০৭ সালে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলন জার্মানির স্টুটগার্টে অনুষ্ঠিত হয়। তবে ওই সম্মেলনটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে ছিলো না। পুঁজিবাদী কাঠামোকে নাড়া দিতেই সাম্যবাদী এক আন্দোলনের রূপরেখা বিনির্মিত হয়। পরের বছর ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে এক বিরাট সমাবেশ করে। নারী নেত্রী ক্লারা জেটকিন ওই সমাবেশের নেতৃত্ব দেন। শুটা ছিলো জার্মানির এই নেত্রীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত প্রথম অস্তির্জাতিক নারী জমায়েত। ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে ১৭টি দেশের ১০০ জন প্রতিনিধি নিয়ে ৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলন। ১৯১১ সালে ৮ মার্চ তৃতীয় সমাবেশে নেত্রী ক্লারা জেটকিনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দিনটিকে ‘নারীর সমঅধিকার পালন দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং প্রতিবছর তা আনুষ্ঠানিকভাবে আয়ােজন করার প্রত্যয় ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন’ বিশ্বব্যাপী আবেদন জাগায়। বিভিন্ন দেশে সমাবেশ, মিছিল, পথসভার মাধ্যমে দিবসটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয়। ১৯১৪ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দিবসটির তাৎপর্য বিবেচনায় পালন করা শুরু হয়। ১৯৪৫ সালে সানফ্রান্সিসকোতে জাতিসংঘ সমতাভিত্তিক চুক্তিতে নারী অধিকারের যৌক্তিক দাবিগুলো বিবেচনায় আনে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ – এর মধ্যে জাতিসংঘ ৮ মার্চ নারী দিবসকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এরপর থেকে বিশ্বজুড়ে দিবসটি নারীর অধিকার সুরক্ষায় পালিত হচ্ছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর আধুনিক যুগ পরম্পরায় উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতেও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয় নারীরা শুধু সামাজিক বৈষম্যেই নয়, পুরুষের তুলনায় অর্থনৈতিক তারতম্যের শিকার হচ্ছে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারখানাগুলোতে নারী শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য দাবি শ্রম মজুরি, শ্রমঘণ্টা কমানোসহ আরও অনেক শ্রমনীতি আদায়ের লক্ষ্যে রাজপথে নেমে আসে। সেই অধিকার আদায়ের সূচীপত্র শুরু হয় আমেরিকর বস্ত্রশিল্পের নারী শ্রমিকদের কাজের সময় কমানোর দাবিতে রাজপথে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়। যে সােচ্চার কষ্ঠে নারীরা তাদের অধিকার অর্জনের দৃষ্ট ঘোষণা দেয় তা সমকালে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলে। দিনটি ছিল ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ। তবে এই বৈপ্লবিক দিন তার মর্যাদায় অভিষিক্ত হতে আরও অর্ধ শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৮৫৭ সালের ধারাবাহিকতায় ১৮৬০ সালে ৮ মার্চ নারী শ্রমিকর৷ একাত্মতা ঘোষণা করে অধিকার আদায়ে সম্মিলিতভাবে ইউনিয়ন গঠন করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়। ফলে বিক্ষিপ্ত এবং অসাংগঠনিকভাবে ছড়ানো এই নারী অধিকার আন্দোলন আলোর মুখ দেখতে আরও ২৯ বছর পার করে দেয়। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে নারীর অধিকার আদায়ের ব্যাপারটি আরও জোরালো ভাবে তুলে ধরেন। শ্রম মজুরিতে বৈষম্যের শিকার নারীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে লড়াই এবং মানুষ হিসেবে নিজের মর্যাদাকে সংহত করতে নারী সমাজ একসময় দৃঢ় প্রতিবাদে কর্তৃত্ববাদী শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। সেই উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে শিল্প বিকাশের ধ্রুপদী যুগে শ্রেণী বিভাজন যখন সামাজিক বৈধন্যকে সর্বনাশা পর্যায়ে দাঁড় করায়, তখন নিপীড়িত ও বঞ্চিত নারীরা আন্দোলন, এমনকি সম্মুখ সমরকে আলিঙ্গন করতেও পিছপা হয়নি। সভ্যতার সূর্য যখন মধ্যগগনে, আধুনিক সমাজ বিনির্মাণে আধিপত্যবাদী শক্তি যখন বিভিন্নভাবে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে নিজেরা সম্পদের পাহাড় গড়তে বদ্ধপরিকর, সেই একই প্রক্রিয়ার ধনের মজুদ তৈরিতে শ্রম বিনিয়োগকারী নারী তাদের শ্রম ছাড়া অৱ সৰ ঘুরিয়ে ফেলে। সেখানে অসহায় ও দুর্বল গোষ্ঠী হিসেবে নারীর অবস্থা হয় ভয়াবহ ও শোচনীয়। নারী – পুরুষের সমান অধিকার অর্জন ছিলো একেবারেই অনিশ্চিত। অতি সহজভাবে অনুমেয়, একজন শিল্প – কারখানার মালিক তার ব্যবসায় যে অর্থ লগ্নি করে, সেখান থেকে মুনাফা আসে অনেক বেশি। সবই কি যান্ত্রিক সভ্যতার অবসান? যাই কি অতি অল্প সময়ে বেশি পণ্য উৎপাদন করে ধনবাদীকে আরও ধন তৈরি করতে মূল নির্ণায়ক শক্তি? কথাটা আংশিক সত্য হলেও পুরোপুরি নয়। এখানে উৎপাদনের মূল নির্ণায়ক শক্তি অসংখ্য শ্রম বিনিয়োগকারী শ্রেণী। যাদের মূল্যবান শ্রমের বিনিময়ে মালিক পক্ষ ঐশ্বর্য সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু মূল নির্ণায়ক শক্তি শ্রমিক নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হতে থাকে। শ্রমিকদের মধ্যে যারা নারী, তারা এমনিতেই সামাজিক বৈষম্যের শিকার সেই শিশুকাল থেকে। বৃহত্তর সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশে এসে আরও অসমি আর বঞ্চনাকে বরণ করে নেয়া ছাড়া কোনো উপায়ও থাকে না। মজুরি প্রাষ্টিতে নারী শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়, যেটা অবর্ণনীয়। শ্রমের ধরণ এবং সময় নারী – পুরুষের বেলায় কোনো তারতম্য হয় না। কিন্তু মজুরি প্রদানের সময় সেখানেও ব্যবধান দৃশ্যমান। আট ঘণ্টা কর্ম সময়ে একজন পুরুষ যে মজুরি পায়, সেখানে নারীকে দেয়া হয় ‘অর্ধেকমাত্র’। যেকোন সমাজের মূল্যবোধ, সংস্কার এবং চেতনা এমনভাবে তৈরি হয় যেখানে জন্ম থেকেই কন্যা সন্তানরা প্রথমেই তার বাবা – মার হাতেই নিপীড়ন আর নির্যাতনের আবর্তে পড়ে। সভ্যতাৰর্জিত অতি আদিম প্রাচীন সমাজের শুহাবাসী বন্য মানুষদের মধ্যে এমন ব্যবধান ছিলো না বলে ঐতিহাসিক ও সমাজ বিজ্ঞানীদের অভিমত। বন্যদশায় আদিম মানুষরা প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে নিজেদের টিকিয়ে রাখতো। একাত্বতায় নারী পুরুষ উভয়েই কোন গােষ্ঠী কিংবা গোত্রের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে জীবনযাপন করত। স্থায়ী কোনো নিবাস ছিলো না, উৎপাদনের কোন উপবণ সেসময় দেখা যায়নি, ফলমূল সগ্রহ করি আদিম অর্থনীতিতে নিরাপদ জায়গায় যাযাবর বৃত্তিই ছিল আদিম মানুষের একমাত্র উপায়। নারী – পুরুষের ব্যবধান তো ছিলো না বরং পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম পরিবার হিসেবে আজও চিহ্নিত হয়ে আছে মাতৃতান্ত্রিকতার অবস্থান। অবাধ স্বেচ্ছাচার আর দলগত বিয়েতে পিতৃয়ে কোন স্বীকৃতিই ছিলো না। মার গর্ভ থেকে সন্তান আসত বলেই মায়ের পরিচয় জানা যেতো। ফলে জন্মলাই ছিলো সন্তানের সমস্ত কৃতিত্বের দাবিদার। এমন কি সম্পদ ও বংশপঞ্জিও নির্ধারিত হতো মায়ের দিক থেকে। এমন নিয়মের ব্যত্যয় বহুকাল ঘটেনি। কিন্তু সভ্যতার সূর্য আলো ছড়ানোর সন্ধিক্ষণে শারীরিকভাবে পরাক্রমশালী পুরুষরা নিজেদের কী অর্জনের উপায় আর অবলম্বন তৈরিতে মনোযোগী হয়। উৎপাদন ব্যবস্থায় সম্পদ মজুদ করার যে নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয় , সেখানে পুরুষদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে পিতৃত্বের পরিচয়ের। ফলে দলগত বিয়ে থেকে বিবাহ বন্ধনটা হয়ে যায় একজন পুরুষ ও একজন নারীর মধ্যে। সমাজচিন্তক এঙ্গেলসের মতে সমাজের পরিবার ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির উত্তৰ নারী জাতির ঐতিহাসিক পরাজয়। সেখান থেকে নারীরা অনেক লড়াই – বিপ্লব করেও সে আধিপত্য আর সমান অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ যখন মধ্যযুগে তাদের নতুন আস্তানা গড়ে তোলে সেখানেও সিংহভাগ মানুষ দাসত্বের শৃঙ্খলে পড়ে সমস্ত মানবিক আর মৌলিক অধিকার শূন্য হয়ে যায়। এখনও চরম নৃশংসতাকে আমরা মধ্যযুগীয় বর্বরতা হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি। বিজ্ঞানের জয়যাত্ৰ যখন পৃথিবীব্যাপী আলোর দ্যুতি ছড়াতে থাকে, তখনই সভ্যতার সূর্য তার পূর্ণ আভায় বিকশিত হলেও সিংহভাগ নারী নিরাপত্তাহীনতা, বঞ্চনা আর নির্যাতনের আবর্তে পড়তে থাকে। সিংহভাগই আজও অসহায়, লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত। আজও কন্যাশিশু যথার্থ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে না, বাল্যবিয়ের শিকার হয়, শ্রম মজুরিতে ধানের আবর্তে পড়ে। সনতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে এদেশে বিন্নি সূচকে ইতোমধ্যে অনেকখানি এগিয়েছে নারী। পাশাপাশি নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণের মতো অমানবিক, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নারীদের বিপর্যস্ত করছে, এটাও কোনভাবে অস্বীকার করার পথ নেই। ব্যক্তি মানুষের সচেনতা যত বাড়বে, ততই নারীর প্রতি সহনশীলতা, সম্মান আর মর্যাদার ব্যাপারটিও বাড়বে সমান তালে। এটাই হোক নারী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য।
আরও পড়ুন
টিউমার নির্মূল এর নতুন থেরাপিউটিক যা স্থায়ীভাবে গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার দূর করে
উত্তরাপথ: একটি বহু-প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা দল একটি অভিনব ক্যান্সার থেরাপিউটিক তৈরি করেছে, অ্যান্টিবডি টুকরোগুলিকে আণবিকভাবে তৈরি করা ন্যানো পার্টিকেলগুলির সাথে একত্রিত করে, যা গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারে আক্রান্ত ইঁদুরের ক্যান্সারকে স্থায়ীভাবে নির্মূল করে। "হিট অ্যান্ড রান" ড্রাগ ডেলিভারি সিস্টেম, কর্নেল প্রাইম ডটস (সি' ডটস) নামে পরিচিত, এটি বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের জন্য একটি বহুমুখী এবং অভিযোজনযোগ্য চিকিত্সা হিসাবে সম্ভাব্যতা দেখায়, ন্যূনতম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এবং বিষাক্ততার সাথে। গবেষকদের একটি বহু-প্রাতিষ্ঠানিক দল আবিষ্কার করেছে যে একটি নতুন ক্যান্সার থেরাপিউটি .....বিস্তারিত পড়ুন
বঞ্চনার আর এক নাম শবর
বলরাম মাহাতো: শবর কথাটির উৎপত্তি হয়েছে ‘সগর’ থেকে। ‘সগর’ শব্দের অর্থ হলো কুঠার। বোঝাই যাচ্ছে, শবররা কুঠার হাতে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। সেখান থেকেই শবর নামটির প্রচলন হয়। শবররা বাস করেন পশ্চিম বাংলা, চেন্নাই, মধ্যপ্রদেশ, ছোটনাগপুর আর উড়িষ্যায়। আমাদের দেশে বর্তমানে শবরদের সংখ্যা ২,০০০ এর কিছু বেশি। শবর কোনো একজনের নাম নয়, এটি একটি জনগোষ্ঠীর নাম। বর্তমানে ভারতে এই শবর জনগোষ্ঠী একটি .....বিস্তারিত পড়ুন
ওসাকা ক্যাসেল – ঐতিহাসিক এক দুর্গ ভ্রমণ
ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী, টোকিও, জাপান: কেল্লা বা দুর্গ এই নাম শুনলেই কল্পনায় ঐতিহাসিক ঘটনায় মোড়া রোমাঞ্চকর এক ভ্রমণক্ষেত্রের দৃশ্য ভেসে ওঠে। জাপানে এমন শতাধিক দুর্গ আছে যার সৌন্দর্য আজও যেমন বিমুগ্ধকর ঠিক তেমনি তার অতীতের সাদা কালো দিনের গল্প দর্শনার্থীকে অবাক করে। প্রাচীনকাল থেকেই জাপানে দুর্গ তৈরি হয়ে আসছে, তবে ইতিহাস বলছে দেশের রাজনৈতিক টানাপড়েন ও গৃহ যুদ্ধের কারণে ১৫ শতকের গোড়া থেকে দুর্গের বিশেষ প্রয়োজন দেখা দেয়। সামন্ত যুগে, জাপান বেশ কিছু ছোট ছোট স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল, যারা একে অপরের বিরুদ্ধে প্রায়ই যুদ্ধ ঘোষণা করত এবং .....বিস্তারিত পড়ুন
সময়
অনসূয়া পাঠক: একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের জেনারেল ম্যানেজার সবুজ বোস। রাজারহাট নিউটাউনের একটি বহুতল আবাসনে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে সুখী জীবন তার। কাজের বাইরে উনার নেশা বলতে নামীদামী পুরানো মডেলের হাত ঘড়ি কালেকশন। এই বিষয়ে তাঁর সংগ্রহশালাটি রীতিমতো চমকে দেবার মতো। তিনি যে বিদেশী মডেলের রিস্ট ওয়াচটি সবচেয়ে বেশী ব্যাবহার করেন সেটা হঠাৎই একদিন খারাপ হয়ে যাওয়াতে পার্শ্ববর্তী করিম চাচার ঘড়ির দোকানে তিনি যান। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে দোকানের শো কেসে তাঁর নজর আটকে যায় জার্মানি মডেলের একটি পুরানো ঘড়ির দিকে। এই .....বিস্তারিত পড়ুন