

প্রীতি গুপ্তা,রাজস্থানঃ রাজস্থানের উদয়পুরের মধুম্যান নামে পরিচিত মোহন খাটিক শুধু নিজের জন্য নয়, এতদিন অন্যদেরও স্বাবলম্বী করতে কাজ করছেন। ১০টি মৌমাছির বাক্স দিয়ে শুরু হওয়া তার এই যাত্রা এখন প্রায় ১৫০টি মৌমাছির বাক্সে পৌঁছেছে। এছাড়া গ্রামের অন্যান্য গ্রামবাসীকেও তারা এ কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত করছেন।কিন্তু ইদানিং আমরা খবর পায় যে এই এলাকা এবং অন্যান্য এলাকার মৌমাছি পালনকারীরা গভীর সমস্যায় রয়েছে। গত কয়েক বছরে মধুর দাম ক্রমাগত পতনের কারণে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছে যে তারা তাদের ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাদের কাছে মধু ব্যবসা এখন আর লাভজনক নয়। কাঁচা মধুর দামে এমন পতন আগে কখনো দেখা যায়নি। কেন দাম কমছে? তাও এমন সময়ে যখন মধুর বিক্রি ক্রমাগত বাড়ছে এবং কোভিড-১৯ সংক্রমণের সময় থেকে, এর অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্যের কারণে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ এটি গ্রহণ করছে। এখন এক গ্লাস জলে লেবু মিশিয়ে মধু পান করা লক্ষাধিক পরিবারের মধ্যে সাধারণ হয়ে উঠেছে, এই অবস্থায় মধুর দামের পতন চমকপ্রদ।এছাড়াও, আমরা এটাও জানি যে কেন্দ্রীয় সরকার মৌমাছি পালনকারীদের জন্য বৃহৎ পরিসরে কর্মসূচি চালাচ্ছে। তাদের জীবিকা ও মৌমাছি পালনের জন্য সরকার ৫০০ কোটি টাকা খরচ করছে। এমন সময়ে এ পেশার প্রতি মোহভঙ্গের কারণ কী হতে পারে?
এই ব্যাপারে আমরা একাধিক মৌমাছি পালনকারীদের সাথে কথা বলি , তাদের কথায় “২০১৪-১৫ সাল পর্যন্ত আমরা মধুর ভালো দাম পাচ্ছিলাম। এর পর মধুর দাম কমের প্রক্রিয়া শুরু হয়। আগে মধুর দাম ছিল প্রতি কেজি ১৫০ টাকা। এখন তা ৬০-৭০ টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে।” রাজস্থানের ভরতপুর জেলায় প্রচুর পরিমাণে কাঁচা মধু উৎপাদিত হয়। এখানকার মৌমাছি পালনকারী রাম গোপাল বলেন, “আমি মৌমাছির বাক্স দ্বিগুণ করেছি, কিন্তু বর্তমানে আয় গত পাঁচ বছরের সবচেয়ে কম। এখন আমি এই কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছি।” সেই গ্রামের আরেক মধু চাষির কথায় , “লাভ কম হওয়ায় আমি মৌমাছি পালন ছেড়ে দিয়েছি।” তাদের কথায় একজন মৌমাছি পালনকারী তখনই বাঁচতে পারে যখন মধুর দাম প্রতি কেজি কমপক্ষে ১২০ টাকা হয়, কিন্তু এই সময়ে দামটি লাভজনক নয়। এরপর আমরা মধুর বাজার বোঝার জন্য ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে যাই। তারা দাম কমার কথা স্বীকার করলেও প্রকাশ্যে এর কারণ ব্যাখ্যা করেননি। সবার একই কথা ছিল, “শুনেছি চিনির শরবত মধুতে মেশানো হচ্ছে। কোম্পানিগুলো অল্প মধুর সাথে চিনির শরবত মিশিয়ে প্রচুর মুনাফা করছে।” কারা এই কাজ করছে তার কোনো ধারণা নেই তাদের।
তবে সম্প্রতি একটি রিপোর্টে মধু ভেজালের একটি বিস্তৃত তথ্য আমাদের সামনে এসেছে, যেখানে অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের লাভ বাড়ানোর জন্য মধুতে ভুট্টার সিরাপ বা বেতের চিনির মতো সস্তা মিষ্টি যুক্ত করছে৷ এটি শুধুমাত্র মধুর প্রকৃত স্বাস্থ্য উপকারিতা থেকে ব্যবহারকারীদের প্রতারণা করছেনা বরং গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকিও তৈরি করছে কারণ এই ভেজালগুলিতে বিভিন্ন ক্ষতিকারক পদার্থ এবং অ্যালার্জেন থাকতে পারে।
সাংবাদিক এবং খাদ্য বিজ্ঞানীদের একটি দল দ্বারা পরিচালিত তদন্তে দেখা গেছে যে মধু শিল্পের কিছু বড় ব্যবসায়ী এই প্রতারণামূলক কাজকর্মে জড়িত। তারা যে তথ্য সামনে এনেছে তাতে বাজারে বিক্রি হওয়া মধুর ৭০% পর্যন্ত কোনো না কোনোভাবে ভেজাল। এই ভেজাল মধু প্রায়ই বাজারে কম দামে বিক্রি হয়, যা বাজেট-সচেতন ভোক্তাদের জন্য একটি আকর্ষণীয় বিকল্প হিসেবে তৈরি করে। তবে ভেজাল মধু খাওয়ার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহভেজাল মধু শনাক্ত করার জন্য যেমন বিভিন্ন পরীক্ষাগুলি বিশেষজ্ঞরা তৈরি করেছেন , তেমনি শিল্পসংস্থাগুলিও ভেজাল সনাক্ত যাতে না করা যায় সেই ব্যাপারে নিত্য নতুন উপায় খুঁজে বের করছেন যা মধুকে বিশ্বের সবচেয়ে ভেজাল খাদ্য পণ্য হিসাবে তুলে ধরেছে।ল্যাবরেটরি পরীক্ষাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য ভেজাল ব্যবসা ক্রমাগতভাবে বিকশিত হয়েছে।এখন মধু জালিয়াতি বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের বিষয়।ভারত সরকার জানে যে মধু ব্যবসায় কিছু ভুল আছে সেই কারণেমধুর বিশুদ্ধতার মান বারবার পরিবর্তিত হয়েছে।সরকার রপ্তানিকৃত মধুর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ও উন্নত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে।
ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (FAO) এর মতে, “মধু হল একটি প্রাকৃতিক মিষ্টি পদার্থ যা মৌমাছি দ্বারা উৎপাদিত হয় এবং উদ্ভিদের পরাগায়নের মাধ্যমে বা উদ্ভিদের জীবন্ত অংশগুলিকে আলাদা করে বা জীবন্ত উদ্ভিদকে চুষে ফেলা পোকামাকড় দ্বারা প্রাপ্ত হয়। “মৌমাছিরা সংগ্রহ করে, রূপান্তর করে, ডিহাইড্রেট করে এবং সংরক্ষণ করে এবং মৌচাকে পরিপক্ক করে।” তাই চিনির সঙ্গে মধুতে ভেজাল থাকলে তা মধু বলে গণ্য হবে না। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জাগে আমরা যে মধু খাচ্ছি তাতে কি চিনি মেশানো আছে?
মধুর মান নির্ধারণ ৬০ বছর ধরে স্থিতিশীল থাকার পর FSSAI ২০১৪ সালে মধুর মানে অ্যান্টিবায়োটিকের সীমা নির্ধারণ করে দেয়।২০১০ সালে, FSSAI একটি পরামর্শ জারি করে স্পষ্ট করে যে কীটনাশক এবং অ্যান্টিবায়োটিক মধুতে অনুমোদিত নয়। ২০১৪ সালে, মধুর মান সংশোধন করা হয় এবং অ্যান্টিবায়োটিকের গ্রহণযোগ্য সীমা নির্ধারণ করা হয়।মধুর গুণমান উন্নত করার জন্য ডিসেম্বর ২০১৪ এর মানগুলি মধু প্রক্রিয়াকরণ শিল্পকে একটি ধাক্কা বলে মনে করা হলেও শিল্প সংস্থাগুলি মধুতে সামান্য চিনির সিরাপ যোগ করে কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। এই ভেজাল মধু খাওয়ার ফলে স্থূলতা, ডায়াবেটিস এবং অ্যালার্জি সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের মত । উপরন্তু, এটি মৌমাছি পালনকারীদের এবং কৃষকদের প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে দিচ্ছে যারা খাঁটি, উচ্চ-মানের মধু উৎপাদনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে। মধুতে ভেজাল পরিবেশেরও ক্ষতি করছে, কারণ এটি অস্থিতিশীল চাষাবাদকে উৎসাহিত করে যা মৌমাছি এবং অন্যান্য পরাগায়নকারীদের ক্ষতি করছে। এই ব্যাপারে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংঘঠনের পক্ষ থেকে ভোক্তাদের সতর্ক থাকার জন্য এবং শুধুমাত্র বিশ্বস্ত উৎস থেকে মধু কেনার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে, যেমন স্থানীয় মৌমাছি পালনকারী বা স্বনামধন্য ব্র্যান্ড যারা গুণমান এবং স্বচ্ছতার প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতির জন্য পরিচিত।
আরও পড়ুন
Karar Oi Lauh Kapat: কাজী নজরুলের এই গানকে ঘিরে বিতর্কে এ আর রহমান
উত্তরাপথঃ বিতর্কে 'পিপ্পা' ছবির সঙ্গীত পরিচালক অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান।সম্প্রতি কবি কাজী নজরুল ইসলামের পরিবার একটি হিন্দি ছবিতে কবির জনপ্রিয় গান 'করার ঐ লৌহ কাপাত...' (Karar Oi Lauh Kapat )।কিন্তু এ আর রহমানের সঙ্গীত পরিচালনায় ওই গানটি যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে আপত্তি জানিয়েছে নজরুল পরিবার।বিতর্কের পর যে চুক্তির আওতায় ওই গানটি ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে তা প্রকাশ্যে আনার দাবি তুলেছে কবির পরিবার।'পিপ্পা' শিরোনামের হিন্দি চলচ্চিত্রটি যেখানে (Karar Oi Lauh Kapat )গানটি ব্যবহার করা হয়েছে তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া একজন ভারতীয় সেনা সৈনিককে কেন্দ্র করে একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। ছবির সঙ্গীত পরিচালক অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান। গানের কথা ঠিক রেখেও সুর পাল্টানোর অভিযোগে ভারত ও বাংলাদেশে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।কবির পরিবারের অভিযোগ, গানটি ব্যবহারের অনুমতি দিলেও সুর পরিবর্তনের অনুমতি দেওয়া হয়নি।পরিবারের সদস্যরাও ছবিটি থেকে গানটি বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। .....বিস্তারিত পড়ুন
প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক
উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন
রাতের ঘামের সমস্যা এবং এ সম্পর্কে আপনি কি করতে পারেন
উত্তরাপথঃ রাতের ঘামের সমস্যা শরীরের কুলিং সিস্টেমের একটি স্বাভাবিক অংশ, তাপ মুক্তি এবং সর্বোত্তম শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে।তবে রাতের ঘাম একটি সাধারণ সমস্যা যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে।এর অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্য ঘুম ব্যাহত হতে পারে, যার ফলে ক্লান্তি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। আপনি যদি রাতে অতিরিক্ত ঘাম অনুভব করেন, তাহলে তার অন্তর্নিহিত কারণটি চিহ্নিত করা এবং এটি মোকাবেলার জন্য কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রাতের ঘামের কিছু সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করা হল।মেনোপজ: যে কেউ, বয়স বা লিঙ্গ নির্বিশেষে, রাতের ঘাম অনুভব করতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন
Bandna Festival: ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পাঁচ দিন বাঁদনার আমেজে মশগুল থাকে
বলরাম মাহাতোঃ চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী কার্তিক অমাবস্যার আগের দিন থেকে মোট পাঁচ দিন ব্যাপী বাঁদনার(Bandna Festival) আমেজে মশগুল থাকে ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অবশ্য, পরবের শুভ সূচনা হয় তারও কয়েকদিন আগে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক শাসন ব্যবস্থার চূড়ামণি হিসাবে গাঁয়ের মাহাতো, লায়া, দেহরি কিম্বা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি নির্ধারণ করেন- ৩, ৫, ৭ বা ৯ ক’দিন ধরে গবাদি পশুর শিং-এ তেল মাখাবে গৃহস্বামী! রুখামাটির দেশের লোকেরা কোনোকালেই মাছের তেলে মাছ ভাজা তত্ত্বের অনুসারী নয়। তাই তারা গোরুর শিং-এ অন্য তেলের পরিবর্তে কচড়া তেল মাখানোয় বিশ্বাসী। কারণ কচড়া তেল প্রস্তুত করতে গোধনকে খাটাতে হয় না যে! কচড়া তেলের অপ্রতুলতার কারণে বর্তমানে সরষের তেল ব্যবহৃত হলেও, কচড়া তেলের ধারণাটি যে কৃষিজীবী মানুষের গবাদি পশুর প্রতি প্রেমের দ্যোতক, তা বলাই বাহুল্য! এভাবেই রাঢ বঙ্গে গোবর নিকানো উঠোনে হাজির হয়- ঘাওয়া, অমাবস্যা, গরইয়া, বুঢ়ি বাঁদনা ও গুঁড়ি বাঁদনার উৎসবমুখর দিনগুলি। পঞ্চদিবসে তেল দেওয়া, গঠ পূজা, কাঁচি দুয়ারি, জাগান, গহাইল পূজা, চুমান, চউক পুরা, নিমছান, গোরু খুঁটা, কাঁটা কাঢ়া প্রভৃতি ১১টি প্রধান পর্ব সহ মোট ১৬টি লোকাচারের মাধ্যমে উদযাপিত হয় বাঁদনা পরব(Bandna Festival )। .....বিস্তারিত পড়ুন