।। বাংলার একমাত্র মুখোশের গ্রাম ।।

 প্রিয়াঙ্কা দত্তঃ পুরুলিয়ার ছৌ নাচ এখন বিশ্ব বন্দিত। আর যে মুখোশ এই ছৌ নাচকে এনে দিয়েছে এক অনন্য মাত্রা , সেই মুখোশ নির্মাণকারী গ্রামের নাম চড়িদা। বাংলার একমাত্র মুখোশ গ্রাম |

এই মুখোশ তৈরীর ইতিহাসও ছৌ নাচের মতই প্রাচীন | অতীতে যদিও ছৌ নাচে কোনও মুখোশ ব্যবহৃত হত না | আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকেরা দেবদেবীর আরাধনায় ও বৃষ্টির উপাসনায় মুখে ছাই মেখে বিভিন্ন পশু পাখির আচরণ নকল করে  ধামসা মাদলের তালে তালে  নৃত্য প্রদর্শন করত | অনেকে বলেন ছৌ কথাটি এসেছে ছাউনি (সেনা) থেকে | তাই এই নাচে মার্শাল আর্টের প্রভাব দেখা যায় | উনিশ শতকে স্থানীয় রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ছৌ নাচ ক্রমে পরিচিতি লাভ করতে থাকে |

ছৌ নাচের বিভিন্ন প্রকার ভেদের মধ্যে পুরুলিয়া ছৌ নাচেই মুখোশের বহুল ব্যবহার দেখা যায় | এর পিছনে প্রকৃত কারণ গবেষকরা ভালো বলতে পারবেন | তবে জনশ্রুতি আছে যে, প্রায় দেড়শ বছর আগে বাঘমুন্ডির রাজা মদন মোহন সিংদেও তাঁর রাজবাড়িতে দেবী দেবতার মূর্তি গড়ার কাজে বর্ধমান থেকে আগত কিছু শিল্পীকে নিযুক্ত করেন | তাঁরা জাতিতে ছিলেন সূত্রধর |অযোধ্যা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছোট্ট গ্রাম চড়িদা। তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে হিকিমডি নামে শীর্ণ এক নদী। মদন মোহন সিং দেও এই গ্রামেই বসবাসের জন্য জমি দিলেন বর্ধমান থেকে আসা সূত্রধর পরিবারদের | সেই সব শিল্পীরা মূর্তি তৈরীর সাথে সাথে হাত লাগান ছৌ নাচের মুখোশ তৈরীর কাজে | আর তারপর থেকেই  চড়িদা গ্রামের ইতিহাস বইতে লাগল অন্য খাতে।

এখানকার ভূমিপুত্র, পদ্মশ্রী গম্ভীর সিং মুড়ার হাত ধরে ছৌ নাচ পৌছে গেল বিশ্বের দরবারে | ২০১০ সালে UNESCO ছৌ কে দিলো কালচারাল হেরিটেজের তকমা আর ২০১৮ সালে ছৌ মুখোশ পেলো জিওগ্রাফিকাল ইনডেক্স ট্যাগ | এখন পুরুলিয়ার পর্যটন মানচিত্রের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এই মুখোশের গ্রাম চড়িদা |

মুখোশ তৈরীর কলা কৌশল আগের থেকে এখন অনেক বদলে গেলেও তার ঐতিহ্য কোনও অংশে কমেনি | চড়িদা গ্রামে এখন প্রায় পাঁচশ পরিবারের বাস | এর মধ্যে দেড়শ পরিবারই মুখোশ নির্মানের কাজে দিনরাত নিযুক্ত |  মুখোশ নির্মাণকারী বেশিরভাগই সূত্রধর পদবী যুক্ত।সাধারণ মাপের এক একটা মুখোশ তৈরী করতে মোটামুটি তিন থেকে পাঁচদিন সময় লাগে | আর তার নির্মাণশৈলী ও কিন্তু সহজ নয়। মুখোশের আকার ও সাজসজ্জার ওপর নির্ভর করে তার নির্মানের সময় |

প্রথমেই সেই হিকিমডি নদীর তীরবর্তী এলাকার মাটি এনে তৈরী করা হয় মুখোশের ছাঁচ । শিল্পীদের মতে, এই মাটি ছাড়া ছৌ এর মুখোশ অসম্পূর্ণ |  সেই মুখোশের ছাঁচ প্রথমে ছাই দিয়ে ভালো করে ঘষে তাতে আট থেকে দশ স্তরে কাগজের আস্তরণ দেওয়া হয় | ভালো করে শুকিয়ে গেলে তাতে বেলে মাটির পাতলা আস্তরণ দিয়ে জড়িয়ে দেওয়া হয় একটি মাটি লেপা কাপড়ের টুকরো | আবারও শুকিয়ে নেওয়া হয় সেই ছাঁচ ।এবার কাঠের একখানা বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে তাকে পালিশ করে প্রয়োজন মতো ফুটিয়ে তোলা হয় চোখ ,নাক, মুখের অংশগুলি | আরেকবার ভালো করে শুকিয়ে নিয়ে তার থেকে সাবধানে তুলে নেওয়া হয় কাপড়ের আস্তরণ | এবার খড়ি মাটির প্রলেপ দিয়ে বিভিন্ন রং ও জড়ি ,চুমকি, রাংতা দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয় ছৌ এর বর্ণাঢ্য মুখোশ |
আগে সব রং ও সাজসজ্জা ছিলো প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরী | বর্তমানে যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যাবহার করা হচ্ছে কৃত্রিম রং ও প্লাস্টিকের উপকরণও | আগত পর্যটকদের কথা ভেবে মুখোশ গুলি আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তোলা হচ্ছে । মূলত পুরাণের বিভিন্ন কাহিনী তুলে ধরা হয় ছৌ নাচে। তাই  বিভিন্ন দেবদেবীর আদলেই ছৌ নাচের মুখোশ তৈরী করা হয়। আর থাকে অসুর ও দেবদেবীর বাহনের অবয়ব। এই মুখোশে রঙের ব্যবহারও হয় নির্দিষ্ট ভাবে। হলুদ, নীল ও গাঢ় বাদামী রং ব্যবহৃত হয় দেবদেবী বা বীর ও নাড়ীর মুখোশের ক্ষেত্রে আর কালো ও সবুজ রং ব্যবহৃত হয় আসুরিক মুখোশের ক্ষেত্রে । তবে এখন অন্যান্য অনেক জনসচেতনতা মূলক কাহিনী যেমন প্রদর্শিত হচ্ছে ছৌ নাচের মাধ্যমে তেমনই যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা হচ্ছে মুখোশের সম্ভার। এখানকার সব থেকে প্রাচীন ও জনপ্রিয় মুখোশ হলো এক সাঁওতাল দম্পতির মুখায়বব। আসলে তার নাম কীরাত- কীরাতিন। এটি শিব পার্বতীর রূপকার্থে নির্মিত।
ছোট বড় নানান আকারের মুখোশের দেখা মেলে রাস্তার ধারের দোকান গুলোতে। প্রায় প্রতি বাড়িতেই দেখা যায়, নারী পুরুষ নির্বিশেষে নিবিষ্ট মনে এই শিল্প কর্ম করে চলেছেন। তার সাথে চলছে পর্যটকের বিকিকিনি। এসব শিল্প অমূল্য হলেও দরদাম করে পছন্দসই মুখোশটি বেছে নেন অতিথিরা। পুরুলিয়ার অযোধ্যা ভ্রমণের স্মৃতি স্বরূপ সুসজ্জিত দেওয়ালে স্থান পায় বাংলার ঐতিহ্যবাহী ছৌ মুখোশ।

চড়িদা গ্রামে এই মুখোশ শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এক সংগ্রহশালা। বিভিন্ন সংগঠন সারা বছর জুড়ে আয়োজন করে বিভিন্ন কর্মশালা। গ্রামের শিল্পীরা, কেউ রাজ্য কেউ বা কেন্দ্রীয় পুরস্কার বিজয়ী। ছৌ নাচ আর মুখোশের পসরা সাজিয়ে দেশে বিদেশে যান গ্রামের মানুষ। নানা অনুষ্ঠানে প্রায়ই ডাক পড়ে তাঁদের। কিন্তু এতো কিছুর সত্ত্বেও দারিদ্র্যের কারণে শিল্পীরা মাঝে মাঝেই হতাশ হয়ে পড়েন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ তো রয়েইছে তার সাথে সকল পর্যটকের কাছে অনুরোধ , শুধুমাত্র সহানুভূতি নয় প্রকৃত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় রক্ষা করুন বাংলার এই ঐতিহ্যকে।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


কানারা ব্যাঙ্কের উপর ২.৯২ কোটি জরিমানা করল আরবিআই

উত্তরাপথ: সম্প্রতি ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বিভিন্ন নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য কানারা ব্যাঙ্কের উপর ২.৯২ কোটি টাকা জরিমানা করেছে। ২০২০ সালের জুলাই মাসে আরবিআই দ্বারা ব্যাঙ্কের একটি স্ক্রুটিনি করা হয়েছিল,তাতে যাচাই-বাছাইয়ের পরে, আরবিআই দেখতে পেয়েছে যে ব্যাঙ্ক ফ্লোটিং রেট খুচরা ঋণ এবং এমএসএমই-কে ঋণের সুদকে একটি বাহ্যিক বেঞ্চমার্কের সাথে সংযুক্ত করতে কানারা ব্যাঙ্ক ব্যর্থ হয়েছে এবং ২০২০-২১ আর্থিক বছরে অনুমোদিত ও পুনর্নবীকরণকৃত ফ্লোটিং রেট রুপি ঋণের সুদকে তার প্রান্তিক খরচের সাথে সংযুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে।আরবিআই বলেছে, অযোগ্য সংস্থার নামে বেশ .....বিস্তারিত পড়ুন

রাহুলের ভারতজোড় সাফল্য পেলেও, অভিষেক কি পারবে ?

উত্তরাপথ: রাহুল গান্ধীর ১৪৬ দিনের প্রায় ৩৮৫০ কিলোমিটার ভারতজোড় যাত্রার সাফল্য কংগ্রেস ঘরে তুলতেই তৃনমূলের নতুন উদ্যোগ জনসংযোগ যাত্রা।এই যাত্রায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ৬০ দিনে ৩,৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ " জনসংযোগ " করবেন। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার দিনহাটা থেকে শুরু হওয়া এই যাত্রা রাজ্যের সবচেয়ে দক্ষিণ প্রান্ত দক্ষিণ ২৪ পরগণার কাকদ্বীপে শেষ হবে। এই পুরো যাত্রায় অভিষেক মোট ২৫০টি সমাবেশে ভাষণ দেবেন। এখন প্রশ্ন তৃণমূল তথা অভিষেকের জনসংযোগ যাত্রার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। কংগ্রেস তথা রাহুল গান্ধীর ভারতজোড় যাত্রার উদ্দেশ্য .....বিস্তারিত পড়ুন

AFC এশিয়ান কাপ ২০২৩: সুনীলদের Blue Tiger অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি

উত্তরাপথ: অস্ট্রেলিয়া, উজবেকিস্তান এবং সিরিয়ার পাশাপাশি এএফসি এশিয়ান কাপ ২০২৩-এর বি গ্রুপে সুনীলদের Blue টাইগাররা। Blue টাইগাররা ১৩ জানুয়ারী, ২০২৪-এ আহমেদ বিন আলী স্টেডিয়ামে গ্রুপ পর্বের তাদের প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হবে।ভারতীয় পুরুষ ফুটবল দল এএফসি এশিয়ান কাপ কাতার ২০২৩-এ ১৩ জানুয়ারি আহমদ বিন আলি স্টেডিয়ামে গ্রুপ বি-তে প্রাক্তন চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করবে। এশিয়ার শীর্ষ ২৪ টি দল দোহার কাটরা অপেরা হাউসে তাদের গ্রুপ পর্বে অংশ গ্রহণ করেছে। এএফসি এশিয়ান কাপ কাতার ১২ জানুয়ারী .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top