Porphyrion: মহাজাগতিক ব্ল্যাক হোল জেটের বিস্ময়কর আবিষ্কার

Porphyrion-এর শিল্পীর চিত্রায়ন| ব্ল্যাক হোল জেটটি ১৪০টি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে একটির পর একটি রেখলে যা হবে তার থেকেও দীর্ঘ। এর দৈর্ঘ্য ২৩ মিলিয়ন আলোকবর্ষেরও বেশি। ছবিটি Cosmoknowledge নামক এক্স হ্যান্ডল থেকে সংগৃহীত|

ড. সায়ন বসুঃ সম্প্রতি জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি অবাক করা আবিষ্কার ঘটেছে, যা মহাবিশ্বের গঠন এবং তার বিকাশ সম্পর্কিত আমাদের ধারণাকে নতুনভাবে চ্যালেঞ্জ করছে। নেদারল্যান্ডসের LOFAR (Low-Frequency Array) রেডিও তরঙ্গ ডিটেক্টরের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন একটি নতুন ব্ল্যাক হোল জেট সিস্টেম, যার নামকরণ করা হয়েছে Porphyrion। LOFAR একটি অত্যাধুনিক রেডিও টেলিস্কোপ নেটওয়ার্ক যা কম ফ্রিকোয়েন্সি রেডিও তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মহাজাগতিক ঘটনাগুলির গভীর পর্যবেক্ষণ করা হয়, যা সাধারণত চোখে না দেখা যায়। LOFAR একটি নেটওয়ার্ক ভিত্তিক টেলিস্কোপ, যা নেদারল্যান্ডসের পাশাপাশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত। এতে নেদারল্যান্ডসের ছাড়াও যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফিনল্যান্ড, এবং সুইডেনের কয়েকটি স্থানে রেডিও অ্যন্টেনা রয়েছে। এইভাবে, LOFAR একটি ভার্চুয়াল সুপারটেলিস্কোপ হিসেবে কাজ করে, যা বিশ্বের বিভিন্ন অংশে অবস্থিত ডেটা সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম। LOFAR রেডিও তরঙ্গের মধ্যে এমন সংকেত গ্রহণ করেছিল, যা প্রমাণ করেছিল যে মহাবিশ্বের এক বিশাল অঞ্চলে শক্তিশালী এবং বিস্তৃত ব্ল্যাক হোল জেটের অস্তিত্ব রয়েছে। এই পর্যবেক্ষণগুলি পর্যালোচনা করার পর, বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছিলেন যে এই জেট সিস্টেমটি অতীতের বৃহত্তম জেট সিস্টেমগুলির তুলনায় অনেক বেশি বিস্তৃত এবং শক্তিশালী।

গ্রীক পুরাণের এক বিদ্রোহী দৈত্যের নামানুসারে এই সিস্টেমটির নামকরণ করা হয়েছে। এই ব্ল্যাক হোল জেট সিস্টেমটি বর্তমানে জানা সবচেয়ে বড়, যার আকার পূর্ববর্তী রেকর্ডধারী ব্ল্যাক হোল জেটের তুলনায় প্রায় ৭ মিলিয়ন আলোকবর্ষ বেশি বিস্তৃত। এমনকি এটি মহাবিশ্বের বৃহত্তম গঠনগুলির বিকাশকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হতে পারে, এমন ধারণা নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আরও গভীর অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন। এই অভূতপূর্ব বিস্তার যথেষ্ট বড়, যা মহাবিশ্বের বিকাশকে মহাজাগতিক স্কেলে প্রভাবিত করতে পারে। এই চাঞ্চল্যকর তথ্য সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে নেচার জার্নালে, ১৮ সেপ্টেম্বর। 

LOFAR টেলিস্কোপ নেটওয়ার্কের একটি টেলিস্কোপের ছবি|  ছবিটি Quite Interesting নামক এক্স হ্যান্ডল থেকে সংগৃহীত|

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী মার্টিজিন ওয়েই সংবাদ সম্মেলনে জানান, “আগে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন যে ব্ল্যাক হোলের জেটগুলি তাদের হোস্ট গ্যালাক্সির মধ্যে বা অন্তত খুব কাছাকাছি সীমাবদ্ধ থাকে। তবে আমরা নতুন প্রমাণ উপস্থাপন করছি যে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল শুধু তাদের গ্যালাক্সির উপরেই প্রভাব ফেলছে না, বরং তাদের চারপাশে থাকা মহাজাগতিক জালের ওপরও তাদের গভীর প্রভাব রয়েছে।”

ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর হলো মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় এবং শক্তিশালী জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তু। বিশেষভাবে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলগুলি (যেগুলির ভর সাধারণত সূর্যের ভরের থেকে অনেকগুণ বেশী), যা সাধারণত বড় গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকে, তারা গ্যালাক্সির গঠন এবং তারকা গঠনে গভীর প্রভাব ফেলে। তবে, ব্ল্যাক হোলের চারপাশে কিছু অসাধারণ ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তাদের থেকে ছড়ানো প্লাজমা ও কণার জেট। এই জেটগুলি একদিকে যেমন শক্তিশালী, তেমনি মহাজাগতিক স্কেলে বিরাট আকার ধারণ করে। ব্ল্যাক হোলের আকর্ষণীয় শক্তি প্লাজমাকে এমনভাবে আকর্ষণ করে যে, তা ব্ল্যাক হোলের চারপাশে ঘূর্ণায়মান হয়ে উচ্চ-শক্তির কণায় পরিণত হয় এবং সেগুলি মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। এই ব্ল্যাক হোল জেটগুলি মহাবিশ্বের গঠন এবং তার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলি গ্যালাক্সির মধ্যে তারকা গঠনের গতিকে প্রভাবিত করতে পারে, কখনও কখনও তা থামিয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে, সেগুলি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত গ্যাস ও ধুলার মেঘকে তাড়িত করে, যা তারকা গঠনে বাধা সৃষ্টি করে।

Porphyrion শুধু একক ব্ল্যাক হোল জেট সিস্টেম নয়। এর মতো আরো অনেক বড় ব্ল্যাক হোল জেট সিস্টেম মহাবিশ্বে আছে। একটি নাগরিক বিজ্ঞান প্রচেষ্টার (Citizen Science) মাধ্যমে ১০,০০০টিরও বেশি ব্ল্যাক হোল জেট সিস্টেম আবিষ্কৃত হয়েছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি সিস্টেম প্রায় ৩ মিলিয়ন আলোকবছর বা তার বেশি বিস্তৃত। যদিও এগুলির মধ্যে Porphyrion-এর মতো এত বড় কোন সিস্টেম নেই, তবুও এই প্রচেষ্টা মহাবিশ্বের বৃহৎ ব্ল্যাক হোল জেট সিস্টেমগুলি সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিকোণ প্রবর্তন করেছে। গবেষকরা এখন মনে করছেন যে এই ধরনের  ব্ল্যাক হোল জেট সিস্টেমগুলি হয়তো কম বিরল এবং এগুলির প্রভাব মহাবিশ্বের বিকাশে আরো বেশি হতে পারে। এর মানে, ভবিষ্যতে মহাবিশ্বের গঠন এবং বিকাশের প্রতি এই জেটগুলির প্রভাব আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হবে। 

Porphyrion-এর আবিষ্কার জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি বড় মাইলফলক। এই ব্ল্যাক হোল জেট সিস্টেমটি আমাদের মহাবিশ্বের গঠন এবং বিকাশ সম্পর্কে নতুন ধারণা প্রদান করছে। এটি শুধু গ্যালাক্সির মধ্যে তারকা গঠনের গতিকে প্রভাবিত করছে না, বরং মহাজাগতিক জালের উপরও তার প্রভাব ফেলছে। ভবিষ্যতে আরও গবেষণা এবং আবিষ্কার হবে, যা ব্ল্যাক হোল জেট সিস্টেমগুলির প্রভাব এবং মহাবিশ্বের বিকাশ সম্পর্কিত আমাদের ধারণাকে আরও সুস্পষ্ট করে তুলবে।

*লেখক বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার University of Witwatersrand এ পদার্থবিদ্যা বিভাগে গবেষক হিসেবে কর্মরত |

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


দীপাবলির সময় কেন পটকা ফোটানো নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা যায় না ?

উত্তরাপথঃ দীপাবলির পরের দিন, যখন কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (CPCB) শহরের বায়ু মানের সূচকের তালিকা প্রকাশ করে,তখন  দেখা যায় রাজধানী দিল্লি বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দূষিত শহরের প্রথমেই রয়েছে। CPCB-এর মতে, ১২ নভেম্বর বিকেল ৪ টায় দিল্লির বায়ু মানের সূচক ছিল ২১৮ যা ভোরের দিকে বেড়ে ৪০৭ এ পৌঁছায় । ৪০০ – ৫০০ AQI  এর স্তর সুস্থ ব্যক্তিদের প্রভাবিত করে। দীপাবলির সারা রাত, লোকেরা পটকা ফাটিয়ে দীপাবলি উদযাপন করে। ১৩ নভেম্বর বিকেল ৪ টায় কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ আবার তথ্য প্রকাশ করে এই তালিকায়, দিল্লির গড় বায়ু মানের সূচক ছিল ৩৫৮ যা 'খুব খারাপ' বিভাগে পড়ে।   বায়ু দূষণের এই পরিস্থিতি শুধু দিল্লিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না।  নয়ডার বায়ু মানের সূচক ১৮৯ থেকে ৩৬৩ এ এবং রোহতক, হরিয়ানার ১৩৭ থেকে বেড়ে ৩৮৩ হয়েছে। দীপাবলির দুই দিন দিল্লি ,নয়ডা  ,কলকাতা, মুম্বাই সহ দেশের অন্যান্য শহরেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। এই দিনগুলিতে মানুষ বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে বাধ্য হয়েছে। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জাতীয় রাজধানী দিল্লি এবং নয়ডায় সবুজ পটকা ছাড়া যে কোনও ধরণের আতশবাজি ফাটান সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ। আদালত সবুজ পটকা পোড়ানোর সময়ও নির্ধারণ করে দিয়েছে রাত ৮টা থেকে ১০টা। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশের মানে কী?  আদালতের এই আদেশ কি এখন প্রত্যাহার করা উচিত?  পুলিশ কেন এই আদেশ কার্যকর করতে পারছে না?  এর জন্য কি পুলিশ দায়ী নাকি সরকারের উদাসীনতা রয়েছে এর পেছনে? .....বিস্তারিত পড়ুন

Fried rice syndrome: আগের দিনের রান্না করা ভাত খেলে হতে পারে এই বিশেষ অসুখটি

উত্তরাপথঃ আপনার কি বাসী ভাত বা পান্তা খাওয়ার অভ্যেস আছে? সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম (Fried rice syndrome) নিয়ে আমরা প্রায়ই অবশিষ্ট খাবার গরম করে আবার খাই। কিন্তু জানেন কি এই অভ্যাস আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। অনেক সময় পর আগের রান্না করা  ভাত খাওয়ার ফলে পেট সংক্রান্ত সমস্যা হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে খাবার পুনরায় গরম করলে এতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, কিন্তু তা নয়। যে খাবারেই স্টার্চ থাকে না কেন, এতে উপস্থিত টক্সিন তাপ প্রতিরোধী। অর্থাৎ খাবার গরম করার পরও ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয় না। ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম নামে এই সমস্যা সম্পর্কিত একটি অবস্থা রয়েছে। আজ আমরা এই ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম অবস্থার লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। ভাত রান্না করার পর, যখন অবশিষ্ট ভাত কয়েক ঘন্টা বা সারারাত ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয় এবং তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে শুরু করে, তখন এই অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম। .....বিস্তারিত পড়ুন

বিশ্বকাপ ২০২৩: পাকিস্তানকে হারিয়ে Afghanistan এ ঈদের মতো পরিস্থিতি

আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০২৩-এর ২২ তম ম্যাচে আফগানিস্তান পাকিস্তানকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছে। সেই ম্যাচে পাকিস্তানকে ৮ উইকেটে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে আফগানিস্তান। এই প্রথম ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে হারাল আফগানিস্তান আর এই পাকিস্তানকে হারিয়ে আফগানিস্থানে(Afghanistan)এখন ঈদের মতো পরিস্থিতি।এক আফগানিস্থানি সমর্থকের মতে এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এবং নিজেদের মত করে তারা তাদের এই খুশী উদযাপন করেছেন। এক্স হ্যান্ডেলে এক সমর্থকের মতে, সেদিন উদযাপন ছিল, পার্টি ছিল। এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এছাড়াও, এটি ছিল ২০২৩ বিশ্বকাপের তৃতীয় বড় আপসেট । টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় বাবর আজমের দল। প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান দল ২৮২ রান করে। জবাবে আফগানিস্তান দল ২৮৩ রান তাড়া করে ৪৯ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্য অর্জন করে। এই ম্যাচে হারের পর বেশ ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল অধিনায়ক বাবর আজমকে। ম্যাচ-পরবর্তী উপস্থাপনার সময়, তিনি দলের ত্রুটিগুলি তালিকাভুক্ত করেছিলেন এবং পরাজয়ের জন্য নিজেদের দায়ী করেছিলেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক

উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই  সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top