কৃষ্ণগহ্বরের খোঁজে ইসরো

ক্যাসিওপিয়া এ, একটি তারার অবশিষ্টাংশ যেটি ১০,০০০ বছর আগে সুপারনোভাতে পরিণত হয়েছে ! ছবিটি XPoSat দ্বারা তোলা হয়নি এবং শুধুমাত্র বোঝানোর উদ্দেশ্যে দেওয়া হলো। XPoSat এর ছবি তোলার ক্ষমতা নেই। এই ছবিটি NASA-এর হাবল এবং স্পিটজার স্পেস টেলিস্কোপ এবং চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরি থেকে প্রাপ্ত তথ্য সমন্বিত যৌগিক চিত্র। ছবিটি ISRO Spaceflight এর এক্স হ্যান্ডল থেকে সংগৃহীত

ড. সায়ন বসুঃ ২০২৩ পেরিয়ে ২০২৪-এও ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর মহাকাশ গবেষণায় অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটেই চলেছে! সূর্য, মঙ্গল, চাঁদ পেরিয়ে এবার তার নজর এই বিশ্বচরাচরের শক্তিশালী রাক্ষসের দিকে। ইসরোর লক্ষ্য এবার কৃষ্ণগহ্বর ! ১লা জানুয়ারি শ্রীহরিকোটার কাছে একটি ছোট দ্বীপ থেকে এক্সরে-পোলারিমিটার কৃত্রিম উপগ্রহ (XPoSat) উৎক্ষেপণ করা হলো যার উদ্দেশ্য ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরের গতিবিধি সম্বন্ধে তথ্য পাঠানো।

প্রথমে আসুন সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক কি ভাবে কৃষ্ণগহ্বর তৈরী হয়| কৃষ্ণগহ্বর সাধারণত বিশাল তারা থেকে তৈরি হয়, যাদের ভর আমাদের সূর্যের চেয়ে অনেক কয়েকগুণ বেশি। এই বিশাল নক্ষত্রগুলি তাদের কেন্দ্রস্থলে পারমাণবিক ফিউশন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায় যা হাইড্রোজেনকে হিলিয়ামে রূপান্তর করে এবং আলো এবং তাপের আকারে শক্তি বিকিরণ করে। এই বাহ্যিক বিকিরণ আর মহাকর্ষীয় শক্তির মধ্যে দড়ি টানাটানির খেলায় শেষমেশ তারার পতন হয়| তারাদের জীবনকালের সবটাই কাটে অন্তর্বর্তী মহাকর্ষীয় বল এবং পারমাণবিক ফিউশন প্রক্রিয়া থেকে তৈরী হওয়া শক্তির বাহ্যিক বলের টানাটানির মধ্যে| যখন একটি বিশাল তারা তার পারমাণবিক জ্বালানী নিঃশেষ করে, বিশেষ করে যখন এটি লোহার মতো ভারী উপাদানগুলিকে মিশ্রিত করতে শুরু করে, তখন বাহ্যিক চাপ হ্রাস পায় এবং মাধ্যাকর্ষণ বল প্রাধান্য পেতে শুরু করে। এই ভাবে মাধ্যাকর্ষণ বল ক্ষমতা গ্রহণ করার সাথে সাথে নক্ষত্রের কেন্দ্রটি তার নিজস্ব ওজনের নীচে ভেঙে পড়ে। এই প্রক্রিয়া দ্রুত ঘটে এবং তারার বাইরের স্তরগুলিও ভিতরের দিকে পড়তে থাকে। পতনকারী উপাদানগুলি কেন্দ্রস্থল থেকে ছিটকে যেতে শুরু করে এবং এর থেকে তৈরি হয় সুপারনোভা নামে পরিচিত একটি শক্তিশালী বিস্ফোরণ। এই বিস্ফোরণের সময় নির্গত শক্তি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য সমগ্র ছায়াপথকে ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম| 

সুপারনোভা বিস্ফোরণের পর যা অবশিষ্ট থাকে তা নির্ভর করে মৃত তারার কেন্দ্রের ভরের উপর। যদি তার ভর সূর্যের ভরের (চন্দ্রশেখর সীমা) প্রায় ১.৪ গুণের কম হয় তবে এটি একটি ঘন অবশিষ্টাংশ গঠন করে যা নিউট্রন তারকা নামে পরিচিত। যদি কেন্দ্রের ভর এই সীমা অতিক্রম করে, তবে মাধ্যাকর্ষণ সমস্ত শক্তিকে ছাপিয়ে যায় এবং কেন্দ্রটি  ভেঙে পড়তে থাকে এবং কেন্দ্রে একটি অসীম ঘনত্বের একটি বিন্দু (যা সিঙ্গুলারিটি নামে পরিচিত) তৈরি হয়। এর আশেপাশের স্থান-কাল এতটাই বিকৃত হয়ে যায় যে কিছুই, এমনকি আলোও তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। সিঙ্গুলারিটির চারপাশের সীমানা যা অতিক্রম করে কিছুই বেরিয়ে আসতে পারে না তাকে ঘটনা দিগন্ত বা event horizon বলা হয়। একবার মৃত তারার ভর তার শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধের মধ্যে সংকুচিত হয়ে গেলে (ঘটনা দিগন্তের সীমানা), একটি কৃষ্ণগহ্বর  তৈরি হয়। শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধের আকার কৃষ্ণগহ্বর-এর ভরের সাথে সরাসরি সমানুপাতিক। কৃষ্ণগহ্বর গঠন একটি জটিল এবং চিত্তাকর্ষক প্রক্রিয়া, এবং এটি ছায়াপথের বিবর্তন এবং মহাবিশ্বের গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

কৃষ্ণগহ্বরের আশেপাশে যে সমস্ত উপাদান থাকে (যেমন গ্যাস) তারা মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশে থাকা গোলাকার চাকতির মতো অংশে (যাকে accretion disc) এসে পড়তে থাকে| গ্যাসের অণুগুলি কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশে এত দ্রুত ঘোরে যে তারা উত্তপ্ত হয় এবং এক্স-রে নির্গত করে। এই এক্স-রেগুলি পৃথিবী থেকে সনাক্ত করা যেতে পারে। এ ছাড়াও কৃষ্ণগহ্বরের কাছাকাছি তারার গতিবিধি দেখেও এদের শনাক্ত করা সম্ভব।

গত ৫ই জানুয়ারী, ইসরো XPoSat-কে তার XSPECT পেলোড ব্যবহার করে  ক্যাসিওপিয়া-এ সুপারনোভা পর্যবেক্ষণ শুরু করার নির্দেশ দেয়। একাধিক কক্ষপেথ চলাকালীন, এটি ওই সুপারনোভা থেকে নির্গত এক্স-রে অধ্যয়ন করে এবং ম্যাগনেসিয়াম, সিলিকন, সালফার, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি উপাদান সনাক্ত করে (চিত্রটি দেখুন)| ছবিটি ISRO Spaceflight এর এক্স হ্যান্ডল থেকে সংগৃহীত

 ৪৫০ কেজি ওজনের এই কৃত্রিম উপগ্রহ XPoSat এক্সরে বিকিরণ করে এমন ৫০টি উৎসকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করবে এবং তাঁদের সম্বন্ধে খুঁটিনাটি তথ্য জানাবে মহাকাশ বিজ্ঞানীদের | XPoSat দ্বারা সংগৃহীত তথ্য ব্যাবহার করে কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কিত তাত্ত্বিক মডেলগুলিকে যাচাই বা পরিমার্জন করার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও কৃষ্ণগহ্বর সময়ের সাথে বিকিরিত শক্তির পরিবর্তনশীলতা প্রদর্শন করার জন্য পরিচিত। এই বিকিরণ ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ করে, XPoSat এই পরিবর্তনশীলতা সম্পর্কে আমাদের নতুন তথ্য দিতে পারে। XPoSat-এর কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কিত অধ্যয়নগুলি চরম মহাকর্ষীয় পরিবেশে পদার্থের আচরণ সম্পর্কে অভূতপূর্ব অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে জ্যোতির্পদার্থ সংক্রান্ত গবেষণাকে এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি রাখে। 

** লেখক বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার University of Witwatersrand-র Centre for Astrophysics-এ কর্মরত ।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


World’s most polluted cities: নয়াদিল্লি, মুম্বাই এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়

উত্তরাপথঃ দিওয়ালি উদযাপনের একদিন পর জাতীয় রাজধানী নয়াদিল্লি, মুম্বাই এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের (World’s most polluted cities) তালিকায় উঠে এসেছে।সোমবার, অর্থাৎ দীপাবলির পরের দিন এই শহরগুলির বায়ুর গুণমান উল্লেখযোগ্য মাত্রায় খারাপ হয়েছে।বায়ুর গুনমান খারাপ হওয়ার পেছনে মাত্রাতিরিক্ত আতশবাজি জ্বালানোকে দায়ী করা হয়েছে। আমাদের বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের (World’s most polluted cities) তালিকায় যথারীতি প্রথম স্থান দখল করেছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। দীপাবলির পরের দিন এটির AQI (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) পরিসংখ্যান ছিল ৪০৭। নভেম্বরের শুরু থেকে, দিল্লিতে AQI পরিসংখ্যান খারাপ হয়েছে।  সুইস গ্রুপ আইকিউএয়ার শহরের বাতাসকে "বিপজ্জনক" বিভাগে রেখেছে।ভারতের আর্থিক রাজধানী মুম্বাই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়(World’s most polluted cities), ১৫৭ এর AQI সহ ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। কলকাতা ১৫৪ এর AQI সহ সপ্তম স্থানে রয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

সেলফির উচ্চ রেটিং কি আপনাকে আরওপাতলা হতে উৎসাহিত করছে ?

উত্তরাপথঃ সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে সেলফি তোলা এবং নিজেকে পাতলা হিসাবে দেখানোর মধ্যে একটি সম্পর্ক থাকতে পারে। যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক সেন্ট জন ইউনিভার্সিটির রুথ নাইট এবং ইউনিভার্সিটি অফ ইয়র্কের ক্যাথরিন প্রেস্টন সম্প্রতি PLOS ONE জার্নালে তাদের ফলাফল প্রকাশ করেছেন।সেখানে সেলফির উচ্চ রেটিং এবং আমাদের শরীরের গঠনের মধ্যে যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।    বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ায় সেলফি হল এক জনপ্রিয় ছবি দেওয়ার ধরন। যিনি সেলফি তোলেন তিনি ক্যামেরাকে তাদের শরীর থেকে দূরে রেখে নিজেই নিজের ছবি তোলে। আগের গবেষণায় বলা হয়েছে সেলফিগুলি দেখার ফলে ছবির বিষয়গুলি সম্পর্কে দর্শকদের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন

দীপাবলির সময় কেন পটকা ফোটানো নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা যায় না ?

উত্তরাপথঃ দীপাবলির পরের দিন, যখন কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (CPCB) শহরের বায়ু মানের সূচকের তালিকা প্রকাশ করে,তখন  দেখা যায় রাজধানী দিল্লি বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দূষিত শহরের প্রথমেই রয়েছে। CPCB-এর মতে, ১২ নভেম্বর বিকেল ৪ টায় দিল্লির বায়ু মানের সূচক ছিল ২১৮ যা ভোরের দিকে বেড়ে ৪০৭ এ পৌঁছায় । ৪০০ – ৫০০ AQI  এর স্তর সুস্থ ব্যক্তিদের প্রভাবিত করে। দীপাবলির সারা রাত, লোকেরা পটকা ফাটিয়ে দীপাবলি উদযাপন করে। ১৩ নভেম্বর বিকেল ৪ টায় কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ আবার তথ্য প্রকাশ করে এই তালিকায়, দিল্লির গড় বায়ু মানের সূচক ছিল ৩৫৮ যা 'খুব খারাপ' বিভাগে পড়ে।   বায়ু দূষণের এই পরিস্থিতি শুধু দিল্লিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না।  নয়ডার বায়ু মানের সূচক ১৮৯ থেকে ৩৬৩ এ এবং রোহতক, হরিয়ানার ১৩৭ থেকে বেড়ে ৩৮৩ হয়েছে। দীপাবলির দুই দিন দিল্লি ,নয়ডা  ,কলকাতা, মুম্বাই সহ দেশের অন্যান্য শহরেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। এই দিনগুলিতে মানুষ বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে বাধ্য হয়েছে। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জাতীয় রাজধানী দিল্লি এবং নয়ডায় সবুজ পটকা ছাড়া যে কোনও ধরণের আতশবাজি ফাটান সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ। আদালত সবুজ পটকা পোড়ানোর সময়ও নির্ধারণ করে দিয়েছে রাত ৮টা থেকে ১০টা। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশের মানে কী?  আদালতের এই আদেশ কি এখন প্রত্যাহার করা উচিত?  পুলিশ কেন এই আদেশ কার্যকর করতে পারছে না?  এর জন্য কি পুলিশ দায়ী নাকি সরকারের উদাসীনতা রয়েছে এর পেছনে? .....বিস্তারিত পড়ুন

Fructose: নতুন গবেষণায় ফ্রুক্টোজকে স্থূলতার কারণ বলা হয়েছে

উত্তরাপথঃ একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় জোরালো প্রমাণ দেওয়া হয়েছে যে ফ্রুক্টোজ (Fructose), সাধারণত প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং পানীয়গুলিতে থাকা এক ধরনের চিনি, যা স্থূলতার প্রাথমিক চালক। বছরের পর বছর ধরে, পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা , পাশ্চাত্য খাদ্যে, স্থূলতার মূল কারণ নিয়ে বিতর্ক করেছেন, কেউ কেউ অত্যধিক ক্যালোরি গ্রহণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, অন্যরা কার্বোহাইড্রেট বা চর্বি জাতীয় খাবারকে দায়ী করেছেন। Obesity জার্নালে সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে ফ্রুক্টোজকে স্থূলতার প্রকৃত চালক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।The University of Colorado Anschutz Medical Campus এর Dr. Richard Johnson এবং তার দলের মতে, ফ্রুক্টোজ হল একটি সাধারণ চিনি যা ফল এবং মধুর প্রাথমিক পুষ্টি। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top