মানভূমের লোক-পার্বণ : ডেনি ঠাকুর

ড. নিমাইকৃষ্ণ মাহাতঃ আমন ধান কাটা শেষ হয়ে যাবার পর মানভূম অঞ্চলের প্রতিটি কৃষকের বাড়িতে ‘ডেনিওঠা ‘ বা ‘ ডেনি ঠাকুর আনা ‘ পার্বণটি খুব আনন্দ  ও উৎসাহ সহকারে পালন করা হয়। এই পার্বণটির নির্দিষ্ট তিথি নেই । যার যেদিন ধান কাটা সম্পূর্ণ হয় এবং কাটা ধান খামারে আনার কাজ শেষ হয়, সেদিন বা পরে কোন শুভদিনে সেই কৃষকের বাড়িতে এই পার্বণটি অনুষ্ঠিত হয়।

এই পার্বণটির রীতি- পদ্ধতি আকর্ষণীয় । যখন আমন ধান কাটা  শেষ হওয়ার মুখে তখন ছয়টি ধানের গাছি না কেটে ক্ষেতের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়। এই ছয়টি ধানের গাছিকেই এতদ্ অঞ্চলে ‘ডেনি ঠাকুর ‘ নামে অভিহিত করা হয় । ক্ষেতের থেকে কাটা ধান খামারে আনা সম্পূর্ণ হলে ওই দিনই সন্ধ্যাবেলা বা সেদিন সম্ভব না হলে অন্য কোন শুভদিনে ‘ডেনি ঠাকুর ‘ খামারে আনা হয়।

এই পার্বণের আচরণীয় পদ্ধতি হল প্রথমে কৃষক তুলসী পাতা, আতপ চাল, সিদুর , ধূপ ইত্যাদি পূজার উপকরণ এবং একটি কাঁসার ঘটিতে জল ও দা (কাস্তে ) নিয়ে ক্ষেতে  যান।

ক্ষেতের মধ্যে পূর্ব থেকেই রেখে দেওয়া ছয়টি ধান গাছির  মধ্যে একটি গাছিকে কৃষক মাটিসহ উপড়ে ফেলেন এবং বাকি পাঁচটি ধানগাছিকে দা দিয়ে কেটে ফেলেন । কৃষক এই ধান গাছগুলিকে একত্রিত করেন এবং সামনে রেখে পূর্ব দিকে মুখ করে পূজা করেন ।  ক্ষেতে পূজা করার পর এই ধানের আঁটিটিকে  মাথার উপর চাপিয়ে ঘরের দিকে রওনা দেন । মাথায় করে ধানের গাছিটি বাড়ি আনার সময় ধানের শিসগুলি কৃষকের সামনের দিকে থাকে এবং মাটি সমেত মূল যুক্ত গোড়াটি ও অন্যান্য কর্তিত গোড়াগুলি তাঁর পিছনের দিকে থাকে । ধানের শিসগুলি হল মা লক্ষ্মীর প্রতীক । তাই,  মা লক্ষ্মীর প্রতীকরূপী শিসগুলিকে সামনের দিকে স্থান দেওয়া হয়। মাথায় করে ডেনি ঠাকুররূপী ধানের গোছাটি আনার সময় কৃষক কারো সাথে কথা বলেন না । হয়তো কথা বললে কৃষকের মাথায় অচলা লক্ষী চঞ্চলা হয়ে পড়তে পারেন এবং কৃষকের সংস্পর্শ ত্যাগ করতে পারেন। কৃষক ঘরের সদর দরজার বাইরে এসে দাঁড়ান এবং তাঁর সাথে থাকা ব্যক্তি ঘরের ভিতরে তাঁর আসার সংবাদ জানায় । তখন, সাধারণত বাড়ির গৃহিণী একটি কাঁসার ঘটির মুখ থেকে জল ফেলতে ফেলতে ( জল ধারাণি) কৃষককে খামার পর্যন্ত নিয়ে যান অর্থাৎ এক বিশুদ্ধ পথে , বিশুদ্ধ চিত্তে মা লক্ষ্মীকে ঘরে বরণ করেন । উল্লেখ্য সেদিন উঠান ও খামারে গোবর লেপন করা হয় এবং তুলসী মঞ্চ থেকে একদিকে বাইরের সদর দরজা পর্যন্ত,  অন্যদিকে গোয়াল ঘর ও খামার পর্যন্ত আলপনা দেওয়া হয় । কৃষক ধানের গোছাটিকে প্রণাম করে ধানের গাদা  বা ধানের পালই এর সামনে রেখে দেন। ডেনি ঠাকুর আনার দিনটি  কৃষকের বাড়িতে উৎসব আনন্দের দিন । ওই দিন তাঁর বাড়িতে পিঠে তৈরি করা হয় এবং নানা সুস্বাদু খাবার খাওয়া হয় । 

সুতরাং , এ দেখা যাচ্ছে দেখা যাচ্ছে ‘ ডেনি ঠাকুর ওঠা ‘ বা ‘ ডেনি ঠাকুরআনা ‘  মানভূমঅঞ্চলের কৃষকদের জীবনে এক আনন্দমুখর পার্বণে পরিণত হয়েছে।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


NASA Carbon Emission: পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে

উত্তরাপথঃ কার্বন নির্গমন (NASA Carbon Emission) সম্পর্কে নাসার সর্বশেষ আবিষ্কার পৃথিবীর জন্য এক সতর্কতা সংকেত। মহাকাশ সংস্থার মতে, পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে, যার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। NASA এর এই আবিষ্কারটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, সেইসাথে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেছে।নাসার সর্বশেষ গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে পৃথিবীর মহাসাগর এবং ভূমি-ভিত্তিক বাস্তুতন্ত্র আগের চেয়ে কম কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে গত এক দশকে ভূমি এবং মহাসাগর দ্বারা শোষিত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৫% হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

সহযাত্রী

দীপা - আর তো এগারো বছর আটমাস বারোদিন চাকরি , তাই না ? অংশু - বাপরে বরাবরই তোমার স্মৃতিশক্তি প্রবল , এতোটা মনে আছে ? দীপা- ঘোরো টো টো করে আর কটা বছর , আফটার রিটায়ার্ড মেন্ট কি করবে ? অংশু - ফার্ম হাউস ,গাছপালা পশুপাখি নিয়ে থাকবো। দীপা- বাঃ উন্নতি হয়েছে। যে অংশুবাবু কখনও একটা ফুলের চারা লাগায়নি সে কিনা ফার্ম হাউস করবে … অংশু - সময়ের সাথে সব বদলায় ম্যাডাম , আচ্ছা তোমার কনুইয়ের নীচে সেই পোড়া দাগটা দেখি তো গেছে কিনা … দীপা- তুমি অনেক রোগা হয়ে গেছো , তা ওজন কত শুনি ? অংশু - সত্তর বাহাত্তর হবে বোধহয় মাপিনি, দীপা - তা কেনো মাপবে ? একটা অগোছালো মানুষ। অংশু - যাক বাবা তাও অপদার্থ শব্দ টা বলোনি। দীপা - ভাবোনা ডিভোর্স হয়েছে বলে সে অধিকার নেই। সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়েও আসলে সমাজটাই শেখোনি , আর কি শিখেছো বলো, ঐ ছেলে পড়ানো , সেমিনার আর লেখালেখি। তা ধন্যবাদ তোমার রূপালী ঠৌট উপন্যাস এবছর একাডেমি পেলো , দারুণ লেখো তুমি, আগের চেয়ে অনেক ধার। অংশু- বাঃ তুমি পড়েছো ? দীপা- সব পড়েছি , তোমার রিসেন্ট উপন্যাসের নায়িকা মেঘনা টি কে ? মানে কার আড়ালে কাকে লিখেছো ? অংশু - এও কি বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপিকাকে বলে দিতে হবে ? দীপা- বারোটা বছর সময়ের শাসনে অনেক বদলালেও আমি বোধহয় সেই বড্ড সেকেলেই রয়ে গেলাম। অংশু - একা একাই কাটিয়ে দিলে বারো বছর। দীপা- একই প্রশ্ন আমিও করতে পারি। অংশু - আচ্ছা দীপা আজ না হয় শেষবারের মতো বলি, আমার মধ্যে কি ছিলো না বলোতো ? কেনো পারোনি এই বাউন্ডুলে ভবঘুরে মানুষটার সাথে চিরকালের ঘর বাঁধতে ? আমি কি ভালোবাসতে জানি না ? .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে

উত্তরাপথঃ হঠাৎ করেই একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে।২০২৩ এর ৩০ অক্টোবর  প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি মৃত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত একটি নতুন দ্বীপের জন্ম দিয়েছে। বিস্ফোরণের পর জাপানের ওগাসাওয়ারা দ্বীপ চেইনের কাছে বিশাল বিশাল পাথরের টুকরো দেখা গেছে। এ বিষয়ে জাপানি গবেষক বলেন, গত মাসে প্রশান্ত মহাসাগর জলের নিচে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের পর টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে ইওটো দ্বীপের কাছে একটি ছোট নতুন দ্বীপের উদ্ভব হয়েছে।টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ফুকাশি মায়েনো জানিয়েছেন যে নতুন দ্বীপ, এখনও যার নাম নেই প্রশান্ত মহাসাগরের ইওটো দ্বীপ থেকে ১ কিলোমিটার দূরে ১০০ মিটার ব্যাসের একটি পাথুরে দ্বীপে একটি phreatomagmatic বিস্ফোরণ ঘটেছে। টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে বিস্ফোরণটি দেখা গেছে। ভূপৃষ্ঠের নীচে জলের সাথে লাল গরম ম্যাগমা সংঘর্ষের কারণে প্রতি কয়েক মিনিটে বিস্ফোরণ ঘটে।গত ২১ অক্টোবর, ২০২৩-এ অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছিল, যা আগে ইও জিমা নামে পরিচিত ছিল এবং এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্থান ছিল। প্রায় ১০ দিন ধরে অগ্ন্যুৎপাত চলার পর, আগ্নেয়গিরির উপাদান অগভীর সমুদ্রতলের উপর জমা হয় এবং প্রায় ১৬০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় বড় বড় পাথরের আকারে সমুদ্র পৃষ্ঠের উপরে উঠে আসে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Side effects of vitamin: ভিটামিনের আধিক্য আপনার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে

উত্তরাপথঃ ভিটামিনের প্রয়োজনীয়তা আমরা সবাই নিশ্চয়ই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি যে সুস্থ থাকতে হলে শরীরে প্রয়োজনীয় সব ভিটামিন থাকা খুবই জরুরি।  ভিটামিন আমাদের সুস্থ করার পাশাপাশি আমাদের সমগ্র শরীরের বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  যাইহোক, এটি অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া আমাদের জন্য ক্ষতিকারকও হতে পারে।  আসুন জেনে নিই অতিরিক্ত ভিটামিন গ্রহণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Side effects of vitamin)সুস্থ থাকার জন্য শরীরে সব ধরনের পুষ্টি থাকা খুবই জরুরি।  এ কারণেই বয়স্ক থেকে শুরু করে চিকিৎসক, সবাই আমাদেরকে সুষম ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন।  সমস্ত পুষ্টি উপাদান আমাদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে সুস্থ করে তোলে।  এর মধ্যে ভিটামিন একটি, যা আমাদের সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top