মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে “ফেলুদা” যখন দক্ষিণ আফ্রিকা

ড. সায়ন বসু*, জোহানেসবার্গ

HartRAO-এ অবস্থিত রেডিও টেলিস্কোপের ছবি | স্বত্ব- Thomas Abbott 

দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন শহরের প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত কারু অঞ্চলে (যেটি মূলত একটি মরুভূমি) শুরু হয়েছে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ যেখানে বসানো হচ্ছে ১৯৭টি রেডিও টেলিস্কোপ যা কিনা আমাদের সাহায্য করবে মহাবিশ্বের রহস্য আরও ভালো করে জানতে। ২০১২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়া সম্মিলিতভাবে পৃথিবীর সব থেকে বড় এবং সব থেকে শক্তিশালী টেলিস্কোপ তৈরি করার কাজ শুরু করে। এই প্রোজেক্টটির নাম হল “Square Kilometre Array (SKA)”। দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার সাথে সহকারী দেশ হিসেবে আছে কানাডা, ফ্রান্স, চীন, জার্মানি, ইতালি, পর্তুগাল, স্পেন, সুইডেন, সুইটজ্যারল্যান্ড, হল্যান্ড, ব্রিটেন এবং ভারত| এতগুলো দেশ এই প্রোজেক্টে যুক্ত থাকলেও টেলিস্কোপগুলি বসানো হচ্ছে মূলত দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়াতে। গোটা প্রোজেক্টটি সম্পূর্ণ হতে খরচা হবে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার। 

আমি দক্ষিণ আফ্রিকার যে অবদান এই প্রোজেক্টে সেই কথাই তুলে ধরবো আজকের লেখাতে কারণ আমরা অনেকেই জানি না যে পৃথিবীর এই প্রান্তে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো একটি দেশে জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে কি পরিমাণ গবেষণা বা প্রযুক্তিগতভাবে কাজকর্ম হচ্ছে বর্তমান সময়ে। এখানে উল্লেখ করা খুবই জরুরি যে মেরিনার-৪ থেকে মঙ্গলগ্রহের প্রথম যে ছবি সেটিও দক্ষিণ আফ্রিকার একটি মানমন্দিরেই (ইংরাজিতে যাকে বলে অবজারভেটরি) পাঠানো হয়েছিল যার নাম হার্টেবিসথেক (Hartebeesthoek) রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি অবজারভেটরি যাকে এখানে স্থানীয়রা HartRAO নামে  চেনে । এই মানমন্দিরটি ১৯৬১ সালে নাসা তৈরি করে । প্রায় ৬১ বছর পুরনো হওয়া সত্ত্বেও এই মানমন্দির আজও রেডিও অ্যাস্ট্রোনমিতে তার অবদান রেখে চলেছে । 

এখন প্রশ্ন হল একটি রেডিও টেলিস্কোপ কি করে কাজ করে? বাড়িতে যেমন ছোট ছোট ডিশ টিভির অ্যান্টেনা থাকে রেডিও টেলিস্কোপও ঠিক তেমনই একটি অ্যান্টেনা কিন্তু আকারে বেশ অনেকটা বড়। রেডিও টেলিস্কোপের কাজ হল মহাজাগতিক বস্তু (যেমন নক্ষত্রপুঞ্জ) থেকে বিচ্ছুরিত রেডিও তরঙ্গ সংগ্রহ করা। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সেই সব রেডিও তরঙ্গ নিয়ে মহাজাগতিক বস্তুদের ছবি তৈরি করেন এবং তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বোঝার চেষ্টা করেন। একটি টেলিস্কোপের বদলে যদি অনেক টেলিস্কোপকে একসাথে ব্যবহার করা যায় তাহলে আরও অনেক বেশি ভালো মানের এবং আরও নিখুঁত ছবি পাওয়া যেতে পারে। এই চিন্তা থেকেই SKA প্রোজেক্টের শুরু| বর্তমানে মোট ৬৪ টি রেডিও টেলিস্কোপ কাজ করছে যা কিনা MeerKAT নামক একটি প্রোজেক্টের অংশ। যদি ভবিষ্যতে এই ৬৪ টি টেলিস্কোপকেও SKA-এ অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হবে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, ১৯৭ টি রেডিও টেলিস্কোপের মধ্যে সব থেকে বেশি দূরত্বে যে দুটি টেলিস্কোপ থাকবে তাদের মধ্যে দূরত্ব হবে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। যে গতিতে কাজ এগোচ্ছে তাতে করে মনে করা হচ্ছে ২০২৭ নাগাদ টেলিস্কোপগুলি বসানো হয়ে যাবে। 

এবার আসা যাক মূল প্রশ্নে। এই ১৯৭ টি টেলিস্কোপ বসিয়ে কি লাভ বা এগুলোর সাহায্যে আমরা কি জানতে পারবো ? 

(১) SKA প্রোজেক্ট থেকে আমরা এমন কিছু নতুন তথ্য জানতে পারবো মহাবিশ্বের সম্বন্ধে যেগুলি আমরা এখনও সম্পূর্ণভাবে জানতে পারিনি। এই টেলিস্কোপগুলি এতটাই শক্তিশালী  যে আজ থেকে প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর আগে যে বিগ-ব্যাং থেকে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি বলে ধরা হয়, সেই সময়ে মহাবিশ্ব কেমন ছিল তার তথ্য দেবে । (২) আইনস্টাইন যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের (Gravitational wave) অস্তিত্বের কথা তাত্বিকভাবে বলে গেছেন তারও অস্তিত্ব প্রমাণ করবে এই SKA| (৩) আমরা জানি যে এই মহাবিশ্বের প্রায় ৬৮ শতাংশ যা দিয়ে তৈরি তা হল ডার্ক ম্যাটার, SKA প্রমাণ করতে সাহায্য করবে এই ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব। (৪) যেহেতু বিগ-ব্যাং এর সময় এই মহাবিশ্ব কেমন ছিল তা জানা যাবে তাই এটাও জানা যাবে যে ছায়াপথ কি ভাবে তৈরি হয়েছিল এবং সময়ের সাথে তাদের বিবর্তন কি ভাবে হয় । (৫) আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের মাঝখানে যে কৃষ্ণ গহ্বর আছে তার বিবর্তন কি ভাবে হচ্ছে এবং তার প্রভাব আমাদের ছায়াপথের ওপর কেমন ভাবে পরছে তার খবরও দেবে SKA। (৬) এগুলির সাথে SKA-এর টেলিস্কোপগুলির থেকে সংগৃহীত রেডিও তরঙ্গ থেকে এটা জানার চেষ্টা করা হবে যে এই মহাবিশ্বে কি আমরা একা নাকি আমাদের মতো আরও কেউ আছে কোন এক কোনাতে ? 

MeerKAT-এর অন্তর্গত কয়েকটি টেলিস্কোপের ছবি| পিছনের দিকে আকাশে দেখা যাচ্ছে আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কিছু অংশ| ছবিটি SKA এর ওয়েবপেজ থেকে নেওয়া হয়েছে ।

MeerKAT থেকে সংগৃহীত রেডিও তরঙ্গ থেকে পাওয়া আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের সব থেকে স্পষ্ট ছবি । সব থেকে উজ্বল অংশটি হল আমাদের ছায়াপথের মাঝের অংশ যেখানে “স্যাজেতেরিয়াস এ*” নামক একটি কৃষ্ণ গহ্বর আছে | ছবিটি SKA এর ওয়েবপেজ থেকে নেওয়া ।

সব কিছু মিলিয়ে বর্তমানে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আশায় বুক বেঁধে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কবে দক্ষিণ আফ্রিকাতে SKA প্রোজেক্টটি সম্পূর্ণ হবে এবং তারা তাদের বহু কাঙ্ক্ষিত গবেষণার মাধ্যমে তুলে ধরবেন এই মহাবিশ্বের অজানা নতুন তথ্য ।

মেরিনার-৪ থেকে HartRAO-তে পাঠানো মঙ্গল গ্রহের উপরিপৃষ্ঠের প্রথম ছবি ।  ছবিটি HartRAO এর ওয়েবপেজ থেকে নেওয়া ।

HartRAO অবজারভেটরি সম্বন্ধে জানতে চোখ রাখুন – http://www.hartrao.ac.za/

SKA প্রোজেক্ট সম্বন্ধে জানতে চোখ রাখুন – https://www.sarao.ac.za/about/the-project/

*লেখক বর্তমানে University of Witwatersrand-এর Centre for Astrophysics-এ কর্মরত রেডিও অ্যাস্ট্রোনমির গবেষক এবং SKA প্রোজেক্টের অংশ । সাথে উনি HartRAO অবজারভেটরির পূর্বতন গবেষক ।

খবরটি শেয়ার করুণ

1 thought on “মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে “ফেলুদা” যখন দক্ষিণ আফ্রিকা”

  1. Pingback: Indian Astronomy: ভারতবর্ষ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা (প্রথম কিস্তি) - উত্তরাপথ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


রাতের ঘামের সমস্যা এবং এ সম্পর্কে আপনি কি করতে পারেন  

উত্তরাপথঃ রাতের ঘামের সমস্যা শরীরের কুলিং সিস্টেমের একটি স্বাভাবিক অংশ, তাপ মুক্তি এবং সর্বোত্তম শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে।তবে রাতের ঘাম একটি সাধারণ সমস্যা যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে।এর  অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্য ঘুম ব্যাহত হতে পারে, যার ফলে ক্লান্তি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। আপনি যদি রাতে অতিরিক্ত ঘাম অনুভব করেন, তাহলে তার অন্তর্নিহিত কারণটি চিহ্নিত করা এবং এটি মোকাবেলার জন্য কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রাতের ঘামের কিছু সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করা হল।মেনোপজ: যে কেউ, বয়স বা লিঙ্গ নির্বিশেষে, রাতের ঘাম অনুভব করতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন

NASA Carbon Emission: পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে

উত্তরাপথঃ কার্বন নির্গমন (NASA Carbon Emission) সম্পর্কে নাসার সর্বশেষ আবিষ্কার পৃথিবীর জন্য এক সতর্কতা সংকেত। মহাকাশ সংস্থার মতে, পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে, যার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। NASA এর এই আবিষ্কারটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, সেইসাথে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেছে।নাসার সর্বশেষ গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে পৃথিবীর মহাসাগর এবং ভূমি-ভিত্তিক বাস্তুতন্ত্র আগের চেয়ে কম কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে গত এক দশকে ভূমি এবং মহাসাগর দ্বারা শোষিত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৫% হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Electoral Bond এর গোপনীয়তা সরিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে, জানাতে হবে প্রাপ্ত অনুদানের পরিমাণ

উত্তরাপথঃ বুধবার, নির্বাচনী বন্ড (Electoral Bond)প্রকল্পের আইনি বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের শুনানি হয়। শীর্ষ আদালত তার মন্তব্যে বলেছে, 'নির্বাচনী বন্ডগুলি রাজনৈতিক দলগুলিকে বেনামী অর্থ প্রদান করে, কারণ তাদের কেনাকাটা সম্পর্কিত রেকর্ডগুলি স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কাছে উপলব্ধ যা শুধুমাত্র তদন্তকারী সংস্থাগুলি অ্যাক্সেস করতে পারে৷ এর আগে নির্বাচনী বন্ড’ (Electoral Bond) সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টে (Supreme Court) কেন্দ্র দাবি করেছিল, রাজনৈতিক দলগুলির আয়ের উৎস জানার অধিকার নেই জনতার।এবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তৎপর হল নির্বাচন কমিশন (Election Commission of India)।বুধবার বিকেল ৫টার মধ্যে যাবতীয় হিসেব জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কমিশনের তরফে।নির্বাচনী বন্ডের (Electoral Bond)মামলায় কেন্দ্রের আর্জি সত্বেও সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক দলগুলিকে আয়ের উৎস জানাতে বলেছিল। আদলত নির্দেশ দিয়েছিল, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক দল কত অনুদান মিলেছে, সেই তথ্য বন্ধ খামে জানাতে হবে।এর আগেও নির্বাচনী বন্ডের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একাধিক মামলা হয়েছে শীর্ষ আদালতে। মামলাকারীরা অভিযোগ করেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলি এই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ বিদেশ থেকে পেতে পারে এর ফলে গণতন্ত্র ধ্বংস হবে। যদিও কোনও রাজনৈতিক দলই এই দাবি মানতে চায়নি। ৩ অক্টোবর মামলার শুনানিতে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সব তথ্য দিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এই রায়ের পরেই তৎপর হল কমিশন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Free Gift in Politics: ভারতের নির্বাচন ও ফ্রি গিফট সংস্কৃতি

উত্তরাপথঃ ফ্রি গিফট (Free gift in politics)এর রাজনীতি সম্প্রতি ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করছে। বিনামূল্যে কোটি কোটি জনগণকে উপহার প্রদান যা রাজকোষের উপর অতিরিক্ত বোঝা ফেলবে এই সত্যটি জানা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক দলগুলি ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য ফ্রি গিফট (Free gift in politics) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনের দৌড়ে একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।এক সময় প্রয়াত তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতা বিনামূল্যে শাড়ি, প্রেসার কুকার, ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন সেট ইত্যাদির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের আগে যে বিনামূল্যের সংস্কৃতি শুরু করেছিলেন তা পরবর্তী কালে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি দ্রুত অনুসরণ করেছিল। এরপর ২০১৫ সালে আম আদমি পার্টি নেতৃত্ব দিল্লির ভোটারদের কাছে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, জল, বাস ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top