অধ্যাপক জয়ন্ত নারলিকার – আলোর পথযাত্রী

অধ্যাপক নারলিকারের লেখা কিছু বই| ছবিটি Dr Navnath Gavhane-র X-handle থেকে সংগৃহীত।

ড. সায়ন বসু*ঃ সালটা সম্ভবত ২০০৯, মাস্টার ডিগ্রীর শেষের দিকে তখন আমি জ্যোতির্বিজ্ঞান (Astrophysics) নিয়ে পড়াশোনা করছি। একদিন লাইব্রেরিতে চোখে পড়লো ‘Introduction to Cosmology’ নামের একটি বই, লেখক J.V. Narlikar। তখন কেনার সামর্থ্য না থাকলেও, জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা শুরু করার পর থেকে আজ অব্দি বইটি আমার সঙ্গী। অনেকে অন্যান্য বিখ্যাত বিখ্যাত গবেষকের বইয়ের কথা বললেও ঐ নীল মলাটের বইটির সাথে আমার সম্পর্ক থেকেই গেছে। অধ্যাপক নারলিকারের মৃত্যু সংবাদটি যখন পড়লাম তখনও আশ্চর্যজনকভাবে তাঁরই একটি গবেষণাপত্র পড়ছিলাম যেটি ২০১৫ সালে প্রকাশিত।

জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার এর জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৯ জুলাই মহারাষ্ট্রের কোলহাপুরে। তাঁর বাবা ভি.ভি. নারলিকার ছিলেন বেনারাস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের বিশিষ্ট অধ্যাপক এবং মা সুমতি নারলিকার ছিলেন সংস্কৃত ভাষার বিশিষ্ট পণ্ডিত। বাবার কাছ থেকেই তিনি পান বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা। বেনারসের Central Hindu Boys স্কুল থেকে পাশ করে স্নাতকে ভর্তি হন বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৭ সালে স্নাতক ডিগ্রী পাওয়ার পর নারলিকার পাড়ি দেন ইংল্যান্ড। সেখানে তিনি ভর্তি হন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন Fitzwilliam কলেজে। ১৯৫৯ সালে তিনি B.A (Tripos) ডিগ্রী অর্জন করেন গণিতে। ১৯৬০ সালে তিনি অর্জন করেন টাইসন মেডেল যা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান শাখায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট ডিগ্রীর সময় তিনি পান Smith প্রাইজ। তিনি গবেষণা করেন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রেড হোয়েলের কাছে। ১৯৬৩ সালে তিনি Ph.D. ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৬৩ সালে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করার পর তিনি কিংস কলেজে Berry Ramsey Fellow হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৬৪ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি কিংস কলেজে কাজ করেন। ১৯৬৬ সালে অধ্যাপক হোয়েল কেমব্রিজে Institute of Theoretical Astronomy প্রতিষ্ঠা করলে পর, নারলিকার সেখানে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে কাজ করেন। এরপর তিনি ভারতে ফেরেন এবং ১৯৭২ সালেই Tata Institute of Fundamental Research (TIFR)-এ অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। TIFR-এ তিনি Theoretical Astrophysics Group-এর প্রধান হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৮ সালে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (UGC) পুনেতে Inter-University Centre for Astronomy and Astrophysics (IUCAA) প্রতিষ্ঠা করে এবং অধ্যাপক নারলিকার প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। TIFR এবং IUCAA এই দুই প্রতিষ্ঠানে যোগদানের অন্যতম কারণ ছিল, অধ্যাপক নারলিকার চেয়েছিলেন তরুণ ভারতীয় গবেষকদের জন্যে একটি বিশ্বমানের জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র গড়ে উঠুক। তাঁরই উদ্যোগে IUCAA-এ গবেষণার পাশাপাশি বিজ্ঞান-প্রচারের কাজও সমানভাবে গুরুত্ব পায়। জনসাধারণের মধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও মহাকাশবিজ্ঞান বিষয়ে কৌতূহল জাগানোর জন্যে তিনি বহু পাঠ্যবই, প্রবন্ধ লিখেছেন।

জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণায় অধ্যাপক নারলিকারের উল্লেখযোগ্য অবদানগুলির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ফ্রেড হোয়েলের সঙ্গে যৌথভাবে নির্মিত হোয়েল-নারলিকার মহাজাগতিক মডেল। এই মডেলটি বিগ-ব্যাং তত্ত্বের একটি বিকল্প হিসেবে প্রস্তাবিত হয়| যদিও ১৯৬৫ সালে Cosmic Microwave Background (CMB) বিকিরণ আবিষ্কার হওয়ার পর বিগ-ব্যাং তত্ত্বের পক্ষে জোরালো প্রমাণ মেলে, কিন্তু হোয়েল-নারলিকার তত্ত্ব মহাবিশ্বের গঠন ও বিকাশ সম্পর্কে বিকল্প চিন্তাভাবনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়াও তিনি সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ, মহাজাগতিক প্রসারণ, কোয়ান্টাম কসমোলজি এবং মহাবিশ্বের গঠন সংক্রান্ত তত্ত্ব নিয়ে গভীরভাবে কাজ করেছেন।

অধ্যাপক নারলিকার বিশিষ্ট গবেষণা ও বিজ্ঞানচর্চার জন্যে বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন| এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- পদ্মভূষণ (১৯৬৫), পদ্মবিভূষণ (২০০৪), শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার, UNESCO Kalinga Prize for Popularization of Science (১৯৯৬), ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংস্থার ফেলোশিপ। তিনি বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছেন এবং কেমব্রিজ, হার্ভার্ডসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবেও বক্তৃতা করেছেন।

অধ্যাপক জয়ন্ত নারলিকার| ছবিটি IUCAA-র X-handle থেকে সংগৃহীত।

গবেষণার পাশাপাশি অধ্যাপক নারলিকার সবসময় বিজ্ঞানকে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস এবং ভ্রান্ত ধারনার বিরুদ্ধে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহার করেছেন| তাঁর মতে, “বিজ্ঞানের আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে প্রশ্ন করায়, বিশ্লেষণে, এবং নতুন ভাবনার সাহসিকতায়”। তিনি আজীবন ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তির পক্ষে সবসময় দৃঢ় অবস্থান নিয়ে চলেছেন। তাঁর লেখা বই এবং প্রবন্ধ – চমৎকারভাবে বিজ্ঞানের কঠিন বিষয়গুলিকে সাধারণ ভাষায় উপস্থাপন করে। তাঁর জনপ্রিয় কল্পবিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানভিত্তিক গল্পগুলি শিশু-কিশোর পাঠকদের কাছেও সমাদৃত। তাঁর চিন্তাভাবনা ছিল মুক্ত এবং যুক্তিনিষ্ঠ এবং তিনি ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ছিলেন দৃঢ় কণ্ঠ। 

আজকের তরুণ প্রজন্মের কাছে ড. নারলিকার একটি আলোকবর্তিকা — যাঁর জীবন ও কাজ বিজ্ঞানকে ভালোবাসার, প্রশ্ন করার, যুক্তিকে গুরুত্ব দেওয়ার শিক্ষা দেয়। তাঁর মতো মনীষীদের জীবন থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আমরা এক যুক্তিনিষ্ঠ, অনুসন্ধিৎসু সমাজ গড়ে তুলতে পারি সামনের দিনে।

*লেখক বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার University of Witwatersrand-এ গবেষক হিসেবে কর্মরত।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Vijay Stambh : চিতোরগড় দুর্গে বিজয় স্তম্ভ হিন্দু – মুসলিম সহাবস্থানের প্রতীক

উত্তরাপথঃ খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে মৌর্য রাজবংশ কর্তৃক স্থাপিত চিতোরগড় দুর্গ সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গ তার বিশাল কাঠামো, রাজপ্রাসাদ, একাধিক  সুদৃশ্য মন্দির সহ সুন্দর জলাশয়ের জন্য বিখ্যাত।৭০০-একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এই দুর্গটিতে প্রায় ৬৫টি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে যা রাজপুত এবং ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীর সূক্ষ্মতার প্রমান দেয়। বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh)) হল এই দুর্গে অবস্থিত,সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কাঠামো।এই আশ্চর্য-অনুপ্রেরণামূলক স্তম্ভটি কেবল তার উচ্চতার জন্য বিখ্যাত নয়,এটি রাজপুতদের অদম্য সাহস এবং অধ্যবসায়ের গল্পও বলে যা চিতোরগড় দুর্গেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে।বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh), নাম থেকে বোঝা যায়, বিজয়ের প্রতীক।  প্রাচীনকালে যে কোনো যুদ্ধ অভিযানের সাফল্যের পর সেই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে রাজারা মন্দির, স্তূপ, স্মৃতিস্তম্ভ ও স্তম্ভ নির্মাণ করতেন।  ৯ তলা এই বিজয় স্তম্ভটি ১৯৪০ থেকে ১৪৪৮ সালের মধ্যে মহারানা কুম্ভ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

সম্পাদকীয়-  রাজনৈতিক সহিংসতা ও আমাদের গণতন্ত্র

সেই দিনগুলো চলে গেছে যখন নেতারা তাদের প্রতিপক্ষকেও সম্মান করতেন। শাসক দলের নেতারা তাদের বিরোধী দলের নেতাদের কথা ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন।  আজ রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে।  কেউ কারো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়।  আগ্রাসন যেন রাজনীতির অঙ্গ হয়ে গেছে।  রাজনৈতিক কর্মীরা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খুন বা মানুষ মারার মত অবস্থার দিকে ঝুঁকছে। আমাদের দেশে যেন রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না।আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে বেশি মানুষ নিহত হচ্ছেন।  ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) অনুসারে, ২০১৪ সালে, রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৪০০ জন প্রাণ হারিয়েছিল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২০০০ জন মারা গিয়েছিল।  আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য গর্বিত হতে পারি, কিন্তু এটা সত্য যে আমাদের সিস্টেমে অনেক মৌলিক সমস্যা রয়েছে যা আমাদের গণতন্ত্রের শিকড়কে গ্রাস করছে, যার জন্য সময়মতো সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। .....বিস্তারিত পড়ুন

ওজন হ্রাস (weight loss) মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে

উত্তরাপথঃ এপ্রিলে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, শাকসবজি, সামুদ্রিক খাবার এবং গোটা শস্য সমৃদ্ধ একটি ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য খাওয়া - এমনকি শুধুমাত্র খাদ্যের নির্দেশিকা অনুসরণ করে   ওজন হ্রাস (weight loss)মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে বলে মনে করা হয়।সাম্প্রতি ডিউক ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত, একটি  গবেষণায় দেখা গেছে যে ওজন হ্রাস মস্তিষ্কে বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ৯ মাস পর্যন্ত ধীর করে (aging process) দিতে পারে। গবেষণায় ৬০ থেকে ৭৮ বছর বয়সের মধ্যে ৪৭ জন অংশগ্রহণকারীকে জড়িত করা হয়েছিল, যাদের প্রত্যেকেরই ওজন বেশি বা স্থূল ছিল এবং তাদের অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যগ্রহণ  ছিল। তাদের এলোমেলোভাবে একটি ক্যালোরি-সীমাবদ্ধ গ্রুপ বা একটি নিয়ন্ত্রণ গ্রুপে বরাদ্দ করা হয়েছিল।ক্যালোরি-সীমাবদ্ধতা গোষ্ঠীর সদস্যদের একটি খাদ্য পরিকল্পনা অনুসরণ করে, যার লক্ষ্য ছিল তাদের আনুমানিক প্রয়োজনের চেয়ে ১০ – ১৫% কম ক্যালোরি গ্রহণ করা। অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রণ গ্রুপ তাদের খাদ্য পরিবর্তন করেনি .....বিস্তারিত পড়ুন

ফ্লিম রিভিউ -ওপেনহাইমার

উত্তরাপথ: বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান দ্বারা পরিচালিত”ওপেনহাইমার” একটি মাস্টারপিস মুভি। ছবিতে জে. রবার্ট ওপেনহেইমার, এক নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পারমাণবিক বোমার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।এই সিনেমায় ওপেনহাইমার এর জটিল জীবনকে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই হিসেবে 'ওপেনহাইমার'কে বায়োপিক বলা যেতে পারে।  কারণ এটি একজন মানুষের গল্প। এই ছবির গল্প তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত।ছবির শুরুতে পারমাণবিক বোমা তৈরির আবেগের কথা বলা হয়েছে।  যেখানে নায়ক কিছু না ভেবে নিবেদিতপ্রাণভাবে এমন একটি অস্ত্র তৈরিতে নিয়োজিত থাকে যা বিশ্বকে ধ্বংস করতে পারে।  অস্ত্র তৈরি হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে নায়ক তার কাজের ফলাফল দেখে অপরাধবোধে পূর্ণ হয়।  এবং তৃতীয় পর্যায়টি হল রাজনীতি  যা ওপেনহাইমারকে মোকাবেলা করতে হয়েছে।  পুরো সিনেমাটি রঙিন হলেও রাজনৈতিক অংশ সাদা-কালো রাখা হয়েছে।  এই তিনটি সময়কালে যা কিছু ঘটছে, তা সবই একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top