রবি কিরণে “আদিত্য”

সূর্য এবং পৃথিবীর একটি তুলনামূলক ছবি। সূর্য পৃথিবীর থেকে ১০৯ গুন বড় ব্যাসের দিক থেকে। ছবিটি Aditya L-1 এর X-একাউন্ট থেকে গৃহীত

ড. সায়ন বসুঃ বীর “বিক্রমে” চাঁদের মাটিতে পা রাখার পর এবার ভারতীয় মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র (ISRO)-এর লক্ষ্য সূর্য । আমাদের ৮টি গ্রহ (প্লুটো এখন বামন গ্রহের তালিকায়) যাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সেই সূর্যের দিকে পাড়ি দিয়েছে “আদিত্য” ২রা সেপ্টেম্বর । চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণের ১০ দিনের মাথায় আদিত্যকে সূর্যের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিয়ে ISRO বাকি বিশ্বের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রগুলির কাছে যে একটি শক্তিশালী বার্তা পৌঁছে দিতে পেরেছে তা বলাই বাহুল্য।

আদিত্য মিশনের সূচনা ২০০৮ সালের জানুয়ারী মাসে মহাকাশ বিজ্ঞান সম্পর্কিত একটি উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে । প্রাথমিকভাবে ঠিক করা হয় যে একটি ছোট এবং কম ওজনের (৪০০ কেজি) কৃত্রিম উপগ্রহকে low Earth orbit (LEO ;লিও) যে কক্ষপথের উচ্চতা ১,২০০ কিলোমিটারের থেকে কম সেখানে পাঠানো হবে এবং তার কাজ হবে সূর্যের একদম যে বাইরের স্তর যাকে আমরা সৌর-করোনা বলি তার সম্বন্ধে তথ্য পাঠানো। এই গোটা প্রজেক্টির জন্যে ২০১৬-২০১৭ অর্থনৈতিক বর্ষে বরাদ্দ করা হয় ৩ কোটি টাকা। যদিও পরবর্তীকালে ঠিক করা হয় যে এই কৃত্রিম উপগ্রহটিকে মহাকাশে অবস্থিত একটি অব্জারভেটরি (মানমন্দির) হিসেবে পাঠানো হবে । অবশেষে এই মিশনটির মোট খরচ দাঁড়ায় আনুমানিক ৩৭৮ কোটি টাকা ।

যদি খেয়াল করে থাকেন তাহলে দেখবেন যে এই মিশনটির নাম কিন্তু আদিত্য না, আদিত্য এল-১ (Aditya L-1)| এরকম নামকরণের মানে কি সেটা একটু জেনে নেওয়া যাক । L অক্ষরটি হলো ল্যাগরেঞ্জ (Lagrange) শব্দটির আদ্যক্ষর যেটি বিখ্যাত গণিতবিদ Joseph-Louis Lagrange এর পদবি| ল্যাগরেঞ্জ বিন্দু হলো আমাদের মহাবিশ্বের সেই সব স্থান যেখানে দুটি মহাজাগতিক বস্তুর আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ দুটিই সমানভাবে এতটাই প্রবল যে সেখানে কোনো বস্তুকে রেখে দিলে তা একদম স্থিরভাবে থাকে এবং ওই দুই মহাজাগতিক বস্তু যদি একে ওপরের চারিদিকে ঘূর্ণায়মান হয় তাহলে তার সাথেই ঘুরবে এবং নিজের কোনো বল লাগবে না। গণিতের ভাষায় এটিকে বলা হয় “General Three-Body Problem”। এরকম মোটামুটি ৫টি স্থান আছে যেগুলিকে L-1, L-2, L-3, L-4, L-5 নামকরণ করা হয়েছে । পৃথিবী-সূর্যের মাঝে L-1 স্থানটির বিশেষত্ব হলো এখন থেকে সূর্যকে একদম সামনাসামনি দেখা যায় মানে অনেকটা যে কোনো কন্সার্টের একদম সামনের সারিতে বসার মতো ! L-1 এর দূরত্ব পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ লক্ষ কিলোমিটার।  L-2 যে স্থানটি সেখানে বর্তমানে প্লান্ক উপগ্রহটি আছে সঙ্গে আছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ । L-2 স্থানটি যে সমস্ত কৃত্রিম উপগ্রহ জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণার জন্যে পাঠানো হয় তার জন্যে সব থেকে ভালো| কারণ এই স্থানটি থেকে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করা যায়, সৌরকিরণ পাওয়া যায় এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখন থেকে মহাকাশকে সব থেকে ভালো দেখা যায় যা কিনা L-1 থেকে সম্ভব না কারণ সেখান থেকে শুধুমাত্র সূর্যকেই সারাক্ষন সামনে দেখা যাবে। L-3 স্থানটি কোনোভাবেই ব্যবহারযোগ্য নয় কারণ এটির অবস্থান সূর্যের পিছনের অংশে এবং L-4 এবং L-5 এই দুই স্থানে বেশ বড় বড় কিছু গ্রহাণু আছে যাদের নাম আগামেমনন, আচিলেস এবং হেক্টর । বলে রাখা ভালো শেষোক্ত দুটি L নামাঙ্কিত স্থান হলো বৃহস্পতি-সূর্য এই system এর অন্তর্গত ।

এবার ফেরা যাক আদিত্যর কথায়| ১,৫০০ কেজির এই কৃত্রিম উপগ্রহ যেটি কিনা একটি অব্জারভেটরির কাজ করবে, তা L-1 বিন্দুতে পৌঁছাবে উৎক্ষেপণের প্রায় ১২৭ দিন পরে । উৎক্ষেপণের পরবর্তী ১৬ দিন কৃত্রিম উপগ্রহটি পৃথিবীর চারিদিকে ৫বার ঘুরপাক খাবে এবং প্রতিবার নিজের গতি একটু একটু করে বাড়িয়ে নেবে। এই প্রক্রিয়াকে বলে Earth-bound maneuver। একদম শেষ পাকের পর এটি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়ে পাড়ি দেবে L-1 এর দিকে । পরবর্তী কক্ষপথ পরিবর্তন সম্পূর্ণ হবে ১৫ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সময় রাত ২টায়| বর্তমানে কৃত্রিম উপগ্রহটিকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে মরিশাস, বেঙ্গালুরু এবং আন্দামানের পোর্ট-ব্লেয়ার থেকে এবং এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বেঙ্গালুরুর কার্যালয় থেকে ।

সূর্য এবং পৃথিবীর একটি তুলনামূলক ছবি । Aditya L-1 এর X-একাউন্ট থেকে গৃহীত

সৌরবিজ্ঞানের কিছু চিত্তাকর্ষক প্রশ্নের সমাধান খোঁজার চেষ্টা করবে আদিত্য| যেমন, সূর্যের উপরিপৃষ্ঠের তাপমাত্রা যেখানে প্রায় ১০ লক্ষ ডিগ্রি সেলসিয়াস সেখানে নিচের যে বায়ুমণ্ডল তার তাপমাত্রা প্রায় ৫,৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ! এছাড়াও সূর্যের বিকিরণ তার প্রভাব আমাদের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ওপর কেমন তাও জানার চেষ্টা করবে আদিত্য| সঙ্গে এটি সূর্যের বায়ুমণ্ডলের যে বিভিন্ন স্তর আছে সেগুলির ছবি তুলেও পাঠাবে । 

চন্দ্রযানের সাফল্যের পর সূর্যের দিকেও আদিত্য যে গতিতে ছুটে চলেছে তাতে করে আরোও একটি সুখবর বোধ হয় শুধু সময়ের অপেক্ষা যেদিন আদিত্য পৌঁছে যাবে L-1 এ । ভারত তো বটেই গোটা বিশ্বের তাবড় তাবড় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রগুলিও উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে রয়েছে ইসরোর “ব্যোমকেশ-ফেলুদাদের” দিকে “সৌর-রহস্য” জানতে ।

*আদিত্য মিশনের সম্বন্ধে বিশদে জানতে নিচের লিংকটি ব্যবহার করতে পারেন- https://www.isro.gov.in/Aditya_L1-MissionDetails.html

** লেখক বর্তমানে University of Witwatersrand-এর Centre for Astrophysics-এ কর্মরত রেডিও অ্যাস্ট্রোনমির গবেষক । 

যোগাযোগ- sayan.basu@wits.ac.za

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


PAN-Aadhar link: কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে নিষ্ক্রিয় করেছে

উত্তরাপথ : আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link)করার সময়সীমা শেষ হওয়ার পরে কেন্দ্রীয় সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ড নিষ্ক্রিয় করেছে৷ আপনি যদি এখনও প্যান কার্ডের সাথে আধার কার্ড লিঙ্ক না করে থাকেন, তাহলে আপনি সরকারের এই কঠোর পদক্ষেপের আওতায় এসেছেন। আপনি যদি আপনার আধার কার্ডকে প্যানের সাথে লিঙ্ক করতে চান তবে আপনি জরিমানা দিয়ে এটি সক্রিয় করতে পারেন। কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে আধারের সাথে লিঙ্ক না করার কারণে নিষ্ক্রিয় করেছে। একটি আরটিআই-এর জবাবে, সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস জানিয়েছে যে আধার কার্ডের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link) করার সময়সীমা ৩০ জুন শেষ হয়েছে। যারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আধার কার্ড এবং প্যান কার্ড লিঙ্ক করেননি তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দেশে ৭০ কোটি প্যান কার্ড বর্তমানে ভারতে প্যান কার্ডের সংখ্যা ৭০.২ কোটিতে পৌঁছেছে। এর মধ্যে প্রায় ৫৭.২৫ কোটি মানুষ আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক করেছেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Electoral Bond এর গোপনীয়তা সরিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে, জানাতে হবে প্রাপ্ত অনুদানের পরিমাণ

উত্তরাপথঃ বুধবার, নির্বাচনী বন্ড (Electoral Bond)প্রকল্পের আইনি বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের শুনানি হয়। শীর্ষ আদালত তার মন্তব্যে বলেছে, 'নির্বাচনী বন্ডগুলি রাজনৈতিক দলগুলিকে বেনামী অর্থ প্রদান করে, কারণ তাদের কেনাকাটা সম্পর্কিত রেকর্ডগুলি স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কাছে উপলব্ধ যা শুধুমাত্র তদন্তকারী সংস্থাগুলি অ্যাক্সেস করতে পারে৷ এর আগে নির্বাচনী বন্ড’ (Electoral Bond) সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টে (Supreme Court) কেন্দ্র দাবি করেছিল, রাজনৈতিক দলগুলির আয়ের উৎস জানার অধিকার নেই জনতার।এবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তৎপর হল নির্বাচন কমিশন (Election Commission of India)।বুধবার বিকেল ৫টার মধ্যে যাবতীয় হিসেব জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কমিশনের তরফে।নির্বাচনী বন্ডের (Electoral Bond)মামলায় কেন্দ্রের আর্জি সত্বেও সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক দলগুলিকে আয়ের উৎস জানাতে বলেছিল। আদলত নির্দেশ দিয়েছিল, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক দল কত অনুদান মিলেছে, সেই তথ্য বন্ধ খামে জানাতে হবে।এর আগেও নির্বাচনী বন্ডের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একাধিক মামলা হয়েছে শীর্ষ আদালতে। মামলাকারীরা অভিযোগ করেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলি এই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ বিদেশ থেকে পেতে পারে এর ফলে গণতন্ত্র ধ্বংস হবে। যদিও কোনও রাজনৈতিক দলই এই দাবি মানতে চায়নি। ৩ অক্টোবর মামলার শুনানিতে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সব তথ্য দিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এই রায়ের পরেই তৎপর হল কমিশন। .....বিস্তারিত পড়ুন

বিশ্বকাপ ২০২৩: পাকিস্তানকে হারিয়ে Afghanistan এ ঈদের মতো পরিস্থিতি

আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০২৩-এর ২২ তম ম্যাচে আফগানিস্তান পাকিস্তানকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছে। সেই ম্যাচে পাকিস্তানকে ৮ উইকেটে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে আফগানিস্তান। এই প্রথম ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে হারাল আফগানিস্তান আর এই পাকিস্তানকে হারিয়ে আফগানিস্থানে(Afghanistan)এখন ঈদের মতো পরিস্থিতি।এক আফগানিস্থানি সমর্থকের মতে এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এবং নিজেদের মত করে তারা তাদের এই খুশী উদযাপন করেছেন। এক্স হ্যান্ডেলে এক সমর্থকের মতে, সেদিন উদযাপন ছিল, পার্টি ছিল। এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এছাড়াও, এটি ছিল ২০২৩ বিশ্বকাপের তৃতীয় বড় আপসেট । টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় বাবর আজমের দল। প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান দল ২৮২ রান করে। জবাবে আফগানিস্তান দল ২৮৩ রান তাড়া করে ৪৯ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্য অর্জন করে। এই ম্যাচে হারের পর বেশ ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল অধিনায়ক বাবর আজমকে। ম্যাচ-পরবর্তী উপস্থাপনার সময়, তিনি দলের ত্রুটিগুলি তালিকাভুক্ত করেছিলেন এবং পরাজয়ের জন্য নিজেদের দায়ী করেছিলেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

ফ্লিম রিভিউ -ওপেনহাইমার

উত্তরাপথ: বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান দ্বারা পরিচালিত”ওপেনহাইমার” একটি মাস্টারপিস মুভি। ছবিতে জে. রবার্ট ওপেনহেইমার, এক নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পারমাণবিক বোমার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।এই সিনেমায় ওপেনহাইমার এর জটিল জীবনকে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই হিসেবে 'ওপেনহাইমার'কে বায়োপিক বলা যেতে পারে।  কারণ এটি একজন মানুষের গল্প। এই ছবির গল্প তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত।ছবির শুরুতে পারমাণবিক বোমা তৈরির আবেগের কথা বলা হয়েছে।  যেখানে নায়ক কিছু না ভেবে নিবেদিতপ্রাণভাবে এমন একটি অস্ত্র তৈরিতে নিয়োজিত থাকে যা বিশ্বকে ধ্বংস করতে পারে।  অস্ত্র তৈরি হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে নায়ক তার কাজের ফলাফল দেখে অপরাধবোধে পূর্ণ হয়।  এবং তৃতীয় পর্যায়টি হল রাজনীতি  যা ওপেনহাইমারকে মোকাবেলা করতে হয়েছে।  পুরো সিনেমাটি রঙিন হলেও রাজনৈতিক অংশ সাদা-কালো রাখা হয়েছে।  এই তিনটি সময়কালে যা কিছু ঘটছে, তা সবই একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top