গঙ্গার কি সত্যিই নিজেকে পরিষ্কার করার অনন্য ক্ষমতা আছে?

উত্তরাপথঃ ২০২৫ সালের মহাকুম্ভ মেলার সময়, গঙ্গা নদীর দূষণ নিয়ে বিতর্ক আবারও আলোচনায় এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে, গঙ্গা নদীর কি নিজেকে পরিষ্কার করার কোনো বিশেষ ক্ষমতা আছে?

উত্তরপ্রদেশ সরকার ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ তারিখে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানায় যে গঙ্গার পবিত্রতা এখনও অটুট আছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পদ্মশ্রী ডঃ অজয় কুমার সোনকার গঙ্গার পাঁচটি প্রধান ঘাট থেকে জল সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছেন। এই ঘাটগুলির মধ্যে রয়েছে সঙ্গম এবং আরাইল (মহাকুম্ভ নগর)। পরীক্ষায় দেখা গেছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ স্নান করার পরেও গঙ্গার জলে কোনো ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি বা pH মাত্রার পরিবর্তন হয়নি।

তবে, এর আগে  উত্তরপ্রদেশ সরকারের এই দাবির বিপরীতে, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ তারিখে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (সিপিসিবি) জাতীয় সবুজ ট্রাইব্যুনালে (এনজিটি) একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। সেখানে বলা হয়, মহাকুম্ভের বিশেষ স্নানের দিনগুলিতেও সঙ্গম এবং অন্যান্য ছয়টি স্থানের জলে উচ্চ মাত্রার জৈব রাসায়নিক চাহিদা (BOD) এবং মল কলিফর্ম পাওয়া গেছে, যা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।

উত্তরপ্রদেশ সরকারের দাবি অনুযায়ী, ডঃ সোনকারের গবেষণায় দেখা গেছে, গঙ্গার জলে ১,১০০ ধরনের ব্যাকটেরিওফেজ রয়েছে, যা ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াগুলোকে ধ্বংস করে। এই কারণে, ৫৭ কোটি মানুষ স্নান করার পরেও গঙ্গার জল দূষিত হয়নি। ব্যাকটেরিওফেজ হলো এক ধরনের ভাইরাস, যা ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ করে এবং ধ্বংস করে। এগুলোকে “ব্যাকটেরিয়া খেকো” ভাইরাসও বলা হয়।

গঙ্গার এই স্ব-শুদ্ধিকরণ ক্ষমতা নিয়ে বহু বছর ধরে আলোচনা চলছে। ২০১৭ সালে জাতীয় সবুজ ট্রাইব্যুনাল (এনজিটি) গঙ্গা নদী নিয়ে একটি রায় দেয়, যেখানে গঙ্গার বিশেষ ক্ষমতার কথা উল্লেখ করা হয়। রায়ে বলা হয়, গঙ্গার জলে এমন কিছু উপাদান আছে, যা জৈব বর্জ্য এবং ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে। এ কারণে গঙ্গার জলে অক্সিজেনের মাত্রা অন্যান্য নদীর তুলনায় ২৫ গুণ বেশি।

এনজিটি রায়ে আরও বলা হয়, গঙ্গার জলে উচ্চ মাত্রার দ্রবীভূত অক্সিজেন (DO) রয়েছে, যা গঙ্গাকে অন্যান্য নদীর চেয়ে আলাদা করে তোলে। গঙ্গার জল বছরের পর বছর সংরক্ষণ করলেও তা দূষিত হয় না। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্নেস্ট হ্যানকিন ১৮৯৬ সালে তার গবেষণায় গঙ্গার জলে কলেরা সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসের ক্ষমতা দেখিয়েছিলেন।

লখনউয়ের জাতীয় উদ্ভিদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (এনবিআরআই) গঙ্গার জলের অ্যান্টিবায়োটিক প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গঙ্গার জল ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়াকে কার্যকরভাবে ধ্বংস করতে পারে। এমনকি ১৬ বছর পুরনো গঙ্গার জলও এই ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলতে সক্ষম।

তবে, গঙ্গার এই বিশেষ ক্ষমতা এখন হ্রাস পাচ্ছে। নদীর প্রবাহ কমে যাওয়া, অতিরিক্ত জল উত্তোলন, শিল্প ও পয়ঃনিষ্কাশনের বর্জ্য গঙ্গাকে দূষিত করছে। এনজিটি রায়ে বলা হয়েছে, গঙ্গার স্ব-শুদ্ধিকরণ ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করতে হলে নদীর প্রবাহ বজায় রাখা এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।

কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রকের প্রাক্তন সচিব শশী শেখর বলেছেন, “গঙ্গা যদি তার স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরে পায় এবং এর বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা হয়, তাহলে এটি আবার নিজেকে পরিষ্কার করতে সক্ষম হবে।” তবে সর্বোপরি, গঙ্গা নদীর পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা রক্ষায় সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Electoral Bond এর গোপনীয়তা সরিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে, জানাতে হবে প্রাপ্ত অনুদানের পরিমাণ

উত্তরাপথঃ বুধবার, নির্বাচনী বন্ড (Electoral Bond)প্রকল্পের আইনি বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের শুনানি হয়। শীর্ষ আদালত তার মন্তব্যে বলেছে, 'নির্বাচনী বন্ডগুলি রাজনৈতিক দলগুলিকে বেনামী অর্থ প্রদান করে, কারণ তাদের কেনাকাটা সম্পর্কিত রেকর্ডগুলি স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কাছে উপলব্ধ যা শুধুমাত্র তদন্তকারী সংস্থাগুলি অ্যাক্সেস করতে পারে৷ এর আগে নির্বাচনী বন্ড’ (Electoral Bond) সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টে (Supreme Court) কেন্দ্র দাবি করেছিল, রাজনৈতিক দলগুলির আয়ের উৎস জানার অধিকার নেই জনতার।এবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তৎপর হল নির্বাচন কমিশন (Election Commission of India)।বুধবার বিকেল ৫টার মধ্যে যাবতীয় হিসেব জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কমিশনের তরফে।নির্বাচনী বন্ডের (Electoral Bond)মামলায় কেন্দ্রের আর্জি সত্বেও সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক দলগুলিকে আয়ের উৎস জানাতে বলেছিল। আদলত নির্দেশ দিয়েছিল, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক দল কত অনুদান মিলেছে, সেই তথ্য বন্ধ খামে জানাতে হবে।এর আগেও নির্বাচনী বন্ডের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একাধিক মামলা হয়েছে শীর্ষ আদালতে। মামলাকারীরা অভিযোগ করেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলি এই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ বিদেশ থেকে পেতে পারে এর ফলে গণতন্ত্র ধ্বংস হবে। যদিও কোনও রাজনৈতিক দলই এই দাবি মানতে চায়নি। ৩ অক্টোবর মামলার শুনানিতে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সব তথ্য দিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এই রায়ের পরেই তৎপর হল কমিশন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Bandna Festival: ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পাঁচ দিন বাঁদনার আমেজে মশগুল থাকে

বলরাম মাহাতোঃ চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী কার্তিক অমাবস্যার আগের দিন থেকে মোট পাঁচ দিন ব্যাপী বাঁদনার(Bandna Festival) আমেজে মশগুল থাকে ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অবশ্য, পরবের শুভ সূচনা হয় তারও কয়েকদিন আগে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক শাসন ব্যবস্থার চূড়ামণি হিসাবে গাঁয়ের মাহাতো, লায়া, দেহরি কিম্বা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি নির্ধারণ করেন- ৩, ৫, ৭ বা ৯ ক’দিন ধরে গবাদি পশুর শিং-এ তেল মাখাবে গৃহস্বামী! রুখামাটির দেশের লোকেরা কোনোকালেই মাছের তেলে মাছ ভাজা তত্ত্বের অনুসারী নয়। তাই তারা গোরুর শিং-এ অন্য তেলের পরিবর্তে কচড়া তেল মাখানোয় বিশ্বাসী। কারণ কচড়া তেল প্রস্তুত করতে গোধনকে খাটাতে হয় না যে! কচড়া তেলের অপ্রতুলতার কারণে বর্তমানে সরষের তেল ব্যবহৃত হলেও, কচড়া তেলের ধারণাটি যে কৃষিজীবী মানুষের গবাদি পশুর প্রতি প্রেমের দ্যোতক, তা বলাই বাহুল্য! এভাবেই রাঢ বঙ্গে গোবর নিকানো উঠোনে হাজির হয়- ঘাওয়া, অমাবস্যা, গরইয়া, বুঢ়ি বাঁদনা ও গুঁড়ি বাঁদনার উৎসবমুখর দিনগুলি। পঞ্চদিবসে তেল দেওয়া, গঠ পূজা, কাঁচি দুয়ারি, জাগান, গহাইল পূজা, চুমান, চউক পুরা, নিমছান, গোরু খুঁটা, কাঁটা কাঢ়া প্রভৃতি ১১টি প্রধান পর্ব সহ মোট ১৬টি লোকাচারের মাধ্যমে উদযাপিত হয় বাঁদনা পরব(Bandna Festival )। .....বিস্তারিত পড়ুন

Vijay Stambh : চিতোরগড় দুর্গে বিজয় স্তম্ভ হিন্দু – মুসলিম সহাবস্থানের প্রতীক

উত্তরাপথঃ খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে মৌর্য রাজবংশ কর্তৃক স্থাপিত চিতোরগড় দুর্গ সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গ তার বিশাল কাঠামো, রাজপ্রাসাদ, একাধিক  সুদৃশ্য মন্দির সহ সুন্দর জলাশয়ের জন্য বিখ্যাত।৭০০-একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এই দুর্গটিতে প্রায় ৬৫টি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে যা রাজপুত এবং ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীর সূক্ষ্মতার প্রমান দেয়। বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh)) হল এই দুর্গে অবস্থিত,সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কাঠামো।এই আশ্চর্য-অনুপ্রেরণামূলক স্তম্ভটি কেবল তার উচ্চতার জন্য বিখ্যাত নয়,এটি রাজপুতদের অদম্য সাহস এবং অধ্যবসায়ের গল্পও বলে যা চিতোরগড় দুর্গেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে।বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh), নাম থেকে বোঝা যায়, বিজয়ের প্রতীক।  প্রাচীনকালে যে কোনো যুদ্ধ অভিযানের সাফল্যের পর সেই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে রাজারা মন্দির, স্তূপ, স্মৃতিস্তম্ভ ও স্তম্ভ নির্মাণ করতেন।  ৯ তলা এই বিজয় স্তম্ভটি ১৯৪০ থেকে ১৪৪৮ সালের মধ্যে মহারানা কুম্ভ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

Roop Kishor Soni: একটি আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য তুলে ধরেছেন

উত্তরাপথঃ রাজস্থান মানেই ওজনদার রূপার গহনা ,আর তার উপর কারুকাজ। প্রচলিত এই ধারনা ভেঙ্গে আজ রূপোর গহনাকে আধুনিকতার সাথে শিল্পের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন যে ব্যক্তি তিনি হলেন রূপ কিশোরী সোনী(Roop Kishor Soni)।তিনি ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে তার অসাধারণ শিল্প কর্মের জন্য জাতীয় পুরুস্কার পান। রাজস্থানের জয়সলমেরের শহরের এই শিল্পী ৩.৮ গ্রাম ওজনের ০.৯ সেমি চওড়া রৌপ্য আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য খোদাই করেছেন।এই ছোট রূপার আংটিতে শিল্পী তাজমহল, সিডনি অপেরা হাউস, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, চীনের গ্রেট ওয়াল, আইফেল টাওয়ার, বিগ বেন, পিসার হেলানো টাওয়ার এবং মিশরীয় পিরামিডের চিত্র এক সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন।এছাড়াও তিনি আরও দুটি পৃথক ডিজাইনের অত্যাশ্চর্য আংটি  তৈরি করেছেন।৮.৬ গ্রাম ওজনের একটি রিংয়ে তিনি সূর্যাস্তের সময় ভারতীয় উট সাফারি সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভারতীয় বিশেষত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন,এবং অন্যটিতে বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবী ছবি এবং মন্দির খোদাই করেছিলেন। শিল্পী বলেছেন যে তিনি তার বাবার কাছ থেকে তার শৈল্পিক দক্ষতা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সেই সাথে তিনি বলেন "আমার বাবাও একজন জাতীয় পুরুস্কার প্রাপ্ত শিল্পী ছিলেন। তিনি আমাকে শিল্পের এই দক্ষতা শিখিয়েছিলেন কারণ তিনি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে শিল্পের ফর্মটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।" .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top