জন্মদিনে গুগলের অন্দরে 

প্রিয়াঙ্কা দত্তঃ তথ্য প্রযুক্তির এই ফাস্ট ফরওয়ার্ড যুগে গুরু হিসাবে আমরা প্রায় সবাই গুগলকে মেনে নিয়েছি। যদিও সে সদ্য ২৫ পেরোনো তরুণ। গত ২৭শে সেপ্টেম্বর ছিল তার ২৫ তম জন্মদিন। থুরি, তার আবার নাকি ছয় ছয়টা জন্ম দিনের মধ্যে এটাই প্রিয়তম। কারণ এই দিনটিতেই প্রথমবার সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় সার্চ করা হয়েছিল গুগল পেজ টি। যদিও তার প্রকৃত জন্মদিন ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ ।

সারাদিনে এক বার না একবার যার স্মরণাপন্ন আমাদের হতে হয় সেই গুগল এর জন্মের ইতিহাস আর নামকরণ কিন্তু বেশ চমকপ্রদ। ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণারত দুই ছাত্র সেরগেই বিন ও ল্যারি পেজ তাদের ডরমেটরি রুমের কোণায় বসেই তৈরী করে ফেললেন বিশ্বের বৃহত্তম সার্চ ইঞ্জিনের নক্সা। যদিও শোনা যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁদের দুজনের মতের মিল থেকে অমিলই বেশি ছিল। তবু কিছু দিনের মধ্যেই তাঁরা বুঝতে পারলেন যে তাঁদের তৈরী এই সার্চ অ্যালগরিদম টি হয়ে উঠতে পারে অনন্য। ‘ ব্যাক রাব ‘ নাম নিয়ে বন্ধু সুসান এর গ্যারেজে কাঠের খেলনা ব্লকের কিউবিকলে মাত্র ১০০০০০ মার্কিন ডলার দিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁদের ব্যবসা। বর্তমানে যার সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তাদের ব্যবসার ক্ষেত্র। প্রয়োজন হয় নতুন নাম, লোগো, অফিস ইত্যাদির।

গুগল এর দুই আবিষ্কর্তার উদ্দেশ্য ছিল ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (www) কে সারা বিশ্বে আরও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে দেওয়া ও সাধারণ মানুষের কাছে বিভিন্ন তথ্য প্রযুক্তিকে আরও সহজলভ্য করে তোলা। তথ্যের ভান্ডারের এই ব্যাপকতা অর্থে গণিতের Googol শব্দটি তাঁরা বেছে নেন যার অর্থ একের পিছনে একশ টা শূন্য (10^10) । যদিও দুটি নামের বানানে আবার অনেকটা পার্থক্য। Googol আর Google। কেউ বলেন ভুলবশত আবার কারও মতে ইচ্ছাকৃত।

কোম্পানির নামের এই লোগো ১৯৯৮ থেকে ২০১৫ এর মধ্যে অনেকবারই রূপ বদলেছে। বর্তমানের লোগোটির স্রষ্টা গ্রাফিক ডিজাইনার রুথ কেদার।লোগোটি বেশ রঙচঙে ও আকর্ষণীয় তো বটেই , তার সঙ্গে আবার জুড়ে রয়েছে বেশ কিছু বিষয়। যেমন লোগোতে ব্যবহৃত হয়েছে লাল, নীল ও হলুদ রঙ যা হলো প্রাথমিক তিনটি রঙ। অর্থাৎ যার থেকে বাকী সব রঙ সৃষ্টি করা যায়। আর রয়েছে সবুজ যা নির্মলতা,সুস্বাস্থ্য ও বৃদ্ধির প্রতীক। নীল রঙ বিশ্বাস, শক্তি ও নির্ভরতা কে উপস্থাপন করে। লাল ব্যবহৃত হয়েছে আবেগ, তারুণ্য ও সাহসিকতার এর প্রতীক হিসাবে। হলুদ প্রতিনিধিত্ব করে আশাবাদ, উষ্ণতা ও স্পষ্ট সত্তাকে। গুগল এর এই লোগো আর তার ফ্যাভিকন (বর্ণিল G) খুব সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ২০০০ সাল থেকে গুগলের হোম পেজে শুরু হয় গুগল ডুডুল। বিশ্বের বিখ্যাত দিন বা মনীষীদের কর্মকাণ্ডের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বিশেষ বিশেষ দিনে প্রদর্শিত হয় গুগল ডুডুল। এর স্রষ্টা ডেনিস হোয়াং। বাস্তিল দূর্গের পতনের দিনটিকে স্মরণ করে প্রথম ডুডুলটি প্রকাশিত হয়। এখন তো স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে Doodle 4 Google প্রতিযোগিতার আয়োজনও করা হয়।

Google এর অভিনবত্ব এখানেই যে তারা সময়ের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। দিনকে দিন এই মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিটির জনপ্রিয়তা এতই বেড়ে গেছে যে গুগল অনুসন্ধানকারীরা নিজেদেরকে ‘ গুগলিস্ট ‘ নামে ডাকা শুরু করেছে ।এমনকি এরা  ‘গুগুলিজম’ নামে ভিন্ন ধর্ম গোষ্ঠীও গড়ে তুলে গুগল কে ভগবান রূপে আরাধনা করে। ভাবা যায়? এই বিপুল জনপ্রিয়তার নিরিখে ২০০৬ সালে মরিয়াম ওয়েবস্টার ডিকশনারিতে google কে ক্রিয়াপদ(verb) হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। যেমনটি আমরাও সুযোগ পেলে একটু Google করে নিই আর কি।

এই যে এত বড় সংস্থা, যা এখন সারা বিশ্বজুড়ে কুড়িটির বেশি ডাটা সেন্টারে কাজ করছে তাদের মূল অফিসটি অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট ভিউ তে , নাম ‘গুগলপ্লেক্স’ । এই গুগলপ্লেক্স নামটিও গণিতের এক থিওরি থেকে ধার করা। অফিসটির গঠন শৈলী এবং কর্মচারীদের প্রতি সংস্থার ব্যবহার সারা বিশ্বে নজরকারা। এখানে কাজ করা যে কারও  ক্ষেত্রে এক লোভনীয় প্রস্তাব। এখানে প্রত্যেক কর্মীর প্রতি বিশেষ ভাবে নজর দেওয়া হয়। অফিস চত্বরেই আছে বিনামূল্যে খাওয়ার জন্য ক্যাফে। একমাত্র এই অফিসেই কর্মীরা নিয়ে আসতে পারেন তাদের পোষ্য কুকুরদের । এমনকি মজার ব্যাপার হোলো সুস্থিত উন্নয়নের প্রতীক হিসাবে এখানে প্রায় ২০০ টি ভেড়া পালন করা হয় যাদের কাজ অফিস লনের ঘাস খেয়ে পরিষ্কার করা। হাস্যকর মনে হলেও শিক্ষণীয় বিষয়। পুরো অফিসের কর্ম সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্য আছে আলাদা বিভাগ। কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা ভেবে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার ব্যাবস্থা করা হয় এখানে। 

” কখনও দুষ্টুতে পরিণত হয়ো না ” ( Don’t be evil ) এই হোলো গুগলের মৌলিক আদর্শ।

Google এর এই জয়যাত্রা যদিও একেবারে নিষ্কণ্টক ছিলোনা। বহুবার এই সংস্থার বিরুদ্ধে নানা প্রতারণার মামলা হয়েছে। উঠেছে অনেক অনেক অভিযোগ। তবু সেসব কাটিয়ে Google এখন বিশ্বের বৃহত্তম সার্চ ইঞ্জিন থেকে, সামাজিক মাধ্যম গুলির অন্যতম ধারক ও বাহক। প্রতি সেকেন্ডে কোটি কোটি ব্যবহারকারী অনবরত ব্যাবহার করে চলেছেন গুগলের বিভিন্ন সাইট গুলো। তার ব্যবসার জাল ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। এমনকি মাঝে মাঝে মনে হয় গুগল বুঝি আমাদের মনের কথা জানে। ভুল টাইপ করলেও সঠিক অনুসন্ধানের লিংক গুলো সে চোখের সামনে পর পর তুলে ধরে। তার কারণ আর কিছুই নয় । ওই বিষয় সংক্রান্ত সকল ওয়েবসাইট তারা আগেই কিনে রেখেছে। এভাবেই গুগল মাত্র কয়েক বছরেই বদলে দিয়েছে মানুষের অনুসন্ধিৎসার সংজ্ঞা।

অ্যাপেল ১১ তে চড়ে চাঁদে মানুষ পাঠাতে যতটুকু কম্পিউটিং ক্ষমতা ব্যবহৃত হয়েছিল এখন মাত্র একটি গুগল সার্চে প্রায় একই পরিমাণ ক্ষমতা কাজে লাগানো হয়।বর্তমানে এ আই ও স্ট্রিমিং ভিডিও গেম এর দিকে তার নজর। গুগল যে শুধু নিজেদের ব্যবসা ক্ষেত্র বিস্তার করেছে তাই নয় কোটি কোটি মানুষের মুশকিল আসান করে সে এখন গুগল গুরু। এতো বছরে মাত্র একবার এই ইঞ্জিন ক্রাশ করেছিল তাও মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য আর তাতেই কোটি কোটি তথ্যের পাহাড় জমে উঠেছিল বিভিন্ন ওয়েবসাইট এ।

নিউটন যদি জ্ঞান সমুদ্রের ধারে নুড়ি কুড়াতে পারেন, আমরাও তাহলে গুগল কে দোসর করে তাঁর অনুগামী হওয়ার চেষ্টা করতে পারি। আশা করতে পারি অদূর ভবিষ্যতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে আরও বড় চমক  

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Scroll to Top