

উত্তরাপথ; জালেবি, যা জিলাবি নামেও পরিচিত, আবার আবার কোথাও এটি অমৃতি নামেও পরিচিত। এটি ভারতের একটি জনপ্রিয় এবং প্রিয় মিষ্টি ।এটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রূপে পাওয়া যায়।তবে এটা জেনে অনেকেই আশ্চর্য হবে যে, জিলেবি মোটেও ভারতীয় মিষ্টি নয়। জালেবির সঠিক উৎপত্তি যদিও অস্পষ্ট,তবে এর সৃষ্টিকে ঘিরে বিভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে। একটি তত্ত্ব থেকে জানা যায় যে মধ্যযুগীয় সময়ে ফার্সি বা আরব ব্যবসায়ীরা ভারতে জালেবি প্রবর্তন করেছিল। এই ব্যবসায়ীরা তাদের সাথে “জালবিয়া” বা “জালিবিয়া” নামে পরিচিত একটি মিষ্টি খাবার নিয়ে আসেন, যা জালেবির পূর্বসূরী বলে মনে করা হয়। সময়ের সাথে সাথে, রেসিপি এবং প্রস্তুতির পদ্ধতিগুলি স্থানীয় স্বাদ এবং উপাদানগুলির সাথে খাপ খাইয়ে জিলেবির নতুন নতুন ভারতীয় সংস্করণের জন্ম দিয়েছে।
বর্তমানে ভারতে মূলত পাঁচ ধরনের জিলাবির প্রচলন রয়েছে। এছাড়া স্থানীয় স্তরে জিলাবির আরও বহু রকম ভেদ দেখতে পাওয়া যায়।
উত্তর ভারতীয় জিলাবি,এটি জালেবির সবচেয়ে সাধারণ এবং ব্যাপকভাবে স্বীকৃত রূপ। এটি ময়দা এবং দই দিয়ে তৈরি করা হয়, যা পরে বৃত্তাকার আকারে ভাজা হয়।ভাজা জলেবিগুলি এলাচ বা জাফরানের স্বাদযুক্ত একটি চিনির সিরায় ভিজিয়ে রাখা হয়, যার ফলে একটি খাস্তা বাহ্যিক এবং সিরাপী অভ্যন্তর হয়। উত্তর ভারতে, জলেবিগুলি প্রায়শই ক্রিমি রাবড়ি (ঘন দুধ) এর সাথে একটি সমৃদ্ধ এবং আনন্দদায়ক খাবার হিসাবে পরিবেশন করা হয়।
দক্ষিণ ভারতের জিলেবি উত্তর ভারতীয় সংস্করণ থেকে কিছুটা আলাদা। এতে ময়দার পরিবর্তে একটি গাঁজানো চালের বাটা ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। ব্যাটারটি সর্পিল আকারে গরম তেলে খাস্তা না হওয়া পর্যন্ত ভাজা হয়। তারপর জিলেবিগুলিকে চিনির সিরাপে ভিজিয়ে রাখা হয়, যার ফলে উত্তর ভারতীয় জলেবির তুলনায় এটি কিছুটা অম্ল এবং কম মিষ্টি স্বাদ যুক্ত হয়।
রাজস্থানী জালেবি তার অনন্য আকারের জন্য পরিচিত।গরম তেলে ব্যাটারকে এককেন্দ্রিক বৃত্তে চেপে এটি তৈরি করা হয়, ফলে একটি বড় এবং ঘন জালেবি তৈরি হয়। জলেবিগুলি সোনালি বাদামী হওয়া পর্যন্ত ভাজা হয় এবং জাফরান বা গোলাপ জল দিয়ে তৈরি চিনির সিরাপে ভিজিয়ে রাখা হয়। রাজস্থানী জলেবি প্রায়শই এক গ্লাস দুধের সাথে উপভোগ করা হয় বা ঐতিহ্যবাহী রাজস্থানী খাবারের মিষ্টি অনুষঙ্গ হিসাবে পরিবেশন করা হয়।
পাঞ্জাবি জালেবি, স্বাদের দিক থেকে অনেকটা উত্তর ভারতীয় জিলাবির মতোই। যাইহোক, এটি কিছুটা ঘন মিষ্টি এবং খাস্তা স্বাদের হয়।পাঞ্জাবের লোকেরা এটিকে বিশেষ কোনও অনুষ্ঠানে সাধারণত একটি ডেজার্ট বা প্রাতঃরাশের আইটেম হিসাবে উপভোগ করে।
বাংলা জালেবি, এই জালেবি পশ্চিমবঙ্গে খুব জনপ্রিয়। এটি ঐতিহ্যবাহী জালেবি থেকে ভিন্ন,বাঙালি জিলেবি তৈরি করা হয় বেসন (বেসন) এবং জল দিয়ে তৈরি একটি ব্যাটার ব্যবহার করে। ব্যাটারটি গরম তেলে খাস্তা না হওয়া পর্যন্ত ভাজা হয়। ভাজা জলেবিগুলিকে চিনির সিরাপে ভিজিয়ে রাখা হয়, যার ফলে অন্যান্য জালেবির তুলনায় নরম এবং কম মিষ্টি যুক্ত হয়।
যদিও আমরা নিশ্চিত যে আপনি বাংলা জালেবি বলতে এখনও শুধুমাত্র ছোট আকারের জলেবির কথা ভাবছেন। বাংলা আর এক বিশেষ ধরনের জিলেপির জন্য বিখ্যাত তাহল বাঁকুড়ার কেঞ্জাকুড়ার বিখ্যাত জাম্বো জালেবি।এই জাম্বো-সাইজ জালেবির স্বাদ নিতে, আপনাকে বাঁকুড়া শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কেঞ্জাকুড়া গ্রামে যেতে হবে। এই জিলেবি আকারে ২ কেজি থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত ওজনের হয় ।
এলাকার বাসীন্দাদের মতে ঠিক কবে থেকে এই অঞ্চলে জাম্বো জিলাবি তৈরি করা হচ্ছে সেই ব্যাপারে সঠিক সাল তারিখ জানা না থাকলেও তাদের মতে বহু প্রাচীনকাল থেকে,আবার কারও মতে স্বাধীনতার পর থেকেই এই অঞ্চলে এই জিলেবির সূত্রপাত।এই এলাকার বিশ্বকর্মা ও ভাদুপূজা বিখ্যাত , আর এই পূজা উপলক্ষ্যে এখানে মেলা বসে সেই মেলায় কেঞ্জাকুড়ার মিষ্টি বিক্রেতারা বছরের পর বছর ধরে পুরুষানুক্রমে বিশাল বিশাল আকারের জাম্বো জালেবি তৈরি করে। তারা এই জাম্বো জালেবি মূলত ভাদ্র মাসের ২৭ তারিখ থেকে আশ্বিন মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত তৈরি করেন।এখানকার জিলেবির বিশেষত্ব হল এক একটি জিলেবি বিক্রি হয় ওজন হিসেবে ,প্রতি কেজি ১৫০ টাকা দামে।
এই সময় কেঞ্জাকুড়া গ্রামের মিষ্টি বিক্রেতাদের মধ্যে কে সবচেয়ে বড় জিলাবি বানাতে পারে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়। সময় বদলেছে, কিন্তু জালেবি নিয়ে আবেগ স্থানীয় বাসীন্দাদের মধ্যে একটুও কমেনি ।এখনও বিশ্বকর্মা ও ভাদু পুজোর দিন এই এলাকার মানুষ ভীড় জমায় এই জাম্বো জালেবি কেনার জন্য । স্থানীয়রা এই জিলাবির স্বতন্ত্র স্বাদ গ্রহণ করে বড় হয়েছে, সেই সাথে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই মিষ্টির প্রতি তারা তাদের ভালবাসা ও আবেগ ছড়িয়ে দিয়েছে।এই আবেগের কারণে এলাকার অনেকে আবার এই জাম্বো জালেবি কিনে নিয়ে যায় তাদের আত্মীয়-স্বজনকে উপহার দেওয়ার জন্য।
তবে কেঞ্জাকুড়ার জিলাবির বিশেষত্ব হল এটি শুধুমাত্র একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রামীন মিষ্টি নয় যা বংশ পরম্পরায় স্থানীয় দক্ষ কারিগরদের দ্বারা তৈরি হচ্ছে,বরং বলা উচিত এটি একটি শিল্প। বাকলাভা(Baklava) বা ম্যাকারনের(Macaron)মত মতো বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত মিষ্টির বিপরীতে, কেঞ্জাকুড়ার জিলেবির পরিচিতি এখনও স্থানীয় স্তরে,শুধুমাত্র প্রচারের অভাবে এর অনন্য আকৃতি এবং স্বাদ সত্বেও এটি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি লাভ করতে পারেনি ।
তবে কেঞ্জাকুড়ার জিলাবিকে সঠিক ভাবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরা সম্ভব হলে একদিন এটিও আঞ্চলিকতার তকমা সরিয়ে বাকলাভা বা ম্যাকারনের মতো বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত একটি মিষ্টি হিসাবে নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম হবে।
আরও পড়ুন
Banarasi Saree: ভারতের হৃদয় থেকে একটি কালজয়ী ধন
গার্গী আগরওয়ালা মাহাতো: ভারত তার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত, এবং ভারতীয় কারুশিল্পের সবচেয়ে আইকনিক প্রতীকগুলির মধ্যে একটি হল বেনারসি শাড়ি। জটিল ডিজাইন এবং বিলাসবহুল কাপড় দিয়ে বোনা, বেনারসি শাড়ি ভারতীয় মহিলাদের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। এবার আসাযাক ভারতের প্রাচীন শহর বারাণসী থেকে ভারতীয় ফ্যাশনের একটি কালজয়ী ধন হয়ে ওঠার বেনারসির যাত্রা। বেনারসি শাড়ির উৎপত্তি উত্তর প্রদেশ রাজ্যের প্রাচীন শহর বারাণসী (পূর্বে বেনারস নামে পরিচিত) থেকে বলে .....বিস্তারিত পড়ুন
Rinku Singh: আন্তর্জাতিক ম্যাচের আগে বৃন্দাবনে গেলেন
উত্তরাপথ: উত্তর প্রদেশ ও কলকাতা নাইট রাইডার্সের ব্যাটার রিঙ্কু সিংকে (Rinku Singh)নিয়ে জল্পনা, খুব শীঘ্র তাকে দেশের জার্সি গায়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেখা যাবে। তার মাঝেই বৃন্দাবনে গেলেন রিঙ্কু। সেখানে বাঁকেবিহারীর মন্দিরে পুজোও দেন তিনি। সেখানে রিঙ্কুর সঙ্গে তাঁর কয়েক জন বন্ধুও ছিলেন। এবারের আইপিএলে কেকেআরের নায়ক হয়ে উঠেছিলেন রিঙ্কু। তাঁর খেলা নজর কেড়েছিল বর্তমান .....বিস্তারিত পড়ুন
Gond Tribe: মধ্য প্রদেশে গোন্ড উপজাতির সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ
গার্গী আগরওয়ালা মাহাতো: গোন্ড উপজাতি(Gond tribe) বিশ্বের বৃহত্তম উপজাতি গোষ্ঠীগুলির মধ্যে একটি। এটি ভারতের বৃহত্তম উপজাতি । এদের গায়ের রং কালো, চুল কালো, ঠোঁট মোটা, নাক বড় ও ছড়ানো। তারা অলিখিত ভাষা গোন্ডি ভাষাতে কথা বলে, যা দ্রাবিড় ভাষার সাথে সম্পর্কিত। গোন্ড উপজাতির একটি দীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে, বিশ্বাস করা হয় যে তাদের শিকড় প্রাক-আর্য যুগে্র । গোন্ডদের সবচেয়ে গৌরবময় রাজা ছিলেন সংগ্রাম শাহ এবং দলগত শাহ, যারা ম্ধ্যপ্রদেশের গন্ডয়ানা রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকায় অনেকগুলি দুর্গ তৈরি করেছিলেন। মাত্র ৩০ বছর বয়সে দলগত .....বিস্তারিত পড়ুন
আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে ভারত নবম স্থান অর্জন করেছে
উত্তরাপথ: ৬৪ তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে ভারতীয় দল একটি ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়ে, সামগ্রিকভাবে নবম স্থানটি অধিকার করে নিয়েছে। দলটি সাথে দুটি স্বর্ণ, দুটি রৌপ্য এবং তিনটি ব্রোঞ্জ পদক জিতেছে ৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডটি ১৩ জুলাই জাপানের চিবাতে অনুষ্ঠত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অতুল শতবর্ত নাদিগ এবং অর্জুন গুপ্ত স্বর্ণপদক জিতেছেন, তারপরে আনন্দ ভাদুড়ি এবং সিদ্ধার্থ চোপরা .....বিস্তারিত পড়ুন