

নাচনি শিল্পী Chandrrabati Gorai
ড. নিমাই কৃষ্ণ মাহাতঃ সামনেই শিক্ষক দিবস শিক্ষক। আজকের প্রতিবেদনে মানভূমের নাচনি শিল্পীদের জীবনে সেই সব শিক্ষাগুরুদের তথা রসিকদের কথা আলোচনা করা হবে যাঁরা সমাজে অন্যান্য শিক্ষাগুরুর মতো সম্মান ও স্বীকৃতি পাননি।
জল ছাড়া যেমন মীন কল্পনা করা যায় না, তেমনি রসিক ছাড়া নাচনির অস্তিত্ব ভাবা যায় না। উভয়ে উভয়ের পরিপূরক। মানভূমে নাচনির জীবনে রসিকের গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত রসিকের পরিচালনায় নাচনি নৃত্য পরিবেশন করেন। তিনি একাধারে নাচনির শিক্ষাগুরু, অভিভাবক, প্রতিপালক, পরিচালক, রক্ষক, দেহসঙ্গী আবার কোন কোন ক্ষেত্রে নাচনির প্রতি শোষক, ভক্ষক, নিষ্ঠুরের ভূমিকায় অবতীর্ণ। বর্তমান সমাজে দু ধরনের রসিকেরই সন্ধান পাওয়া যায়। অবশ্য নাচনি ও রসিক বাস্তবের প্রয়োজনেই বেশিরভাগ সময় একে অপরের পারস্পরিক সহযোগিতার হাত ধরে এগিয়ে চলেন।
‘রসিক‘ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল প্রেমরসের বৌদ্ধা, প্রেমিক, রঙ্গপ্রিয়, রঙ্গরসে পটু। এই অঞ্চলে প্রচলিত প্রবাদেও রসিক বলতে ‘প্রেম রসে বোদ্ধা’ রসিক নাগর এর কথা বলা হয়েছে। যেমন ‘তিনদিনকার রসিক নাগর আমার গলার কাঁটি‘ অথবা ‘শুনহে রসিকজন বুঝে নিলম তোমার মন‘। তবে মানভূমে ‘রসিক‘ বলতে বোঝায় নাচনি নাচের আসরে মূল গায়েন। রসিকই বাদ্য সহযোগে নাচনি নাচের আসরের সূচনা করেন।
আমরা প্রথমে রসিক প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লোকগবেষকদের মতামত তুলে ধরব এবং তারপর নিজস্ব মূল্যায়নে অগ্রসর হব।
লোকসংস্কৃতি গবেষক ডক্টর সুধীর কুমার করণ সাঁওতাল বাদকদের মধ্যে নাচনির রসিক-এর আদি রূপের ছায়া অনুভব করেছিলেন। কিন্তু কিছুটা সাংস্কৃতিক মিশ্রণ ঘটল ঝুমুর গান ও নাচনি নাচ – কোনোটাই আদিবাসী সংস্কৃতি নয়।
গবেষক ও অধ্যাপক ডক্টর প্রবীর সরকার তাঁর ‘মানভূমের নাচনি কথা’ প্রবন্ধে বলেছেন –


নাচনি শিল্পী চপলা গোস্বামী
‘ভাবনাকে উচ্চ গ্রামে নিয়ে গেলে নাচনি- রসিকের আবছা একটা অবয়ব যেন ফুটে ওঠে জয়দেব ও পরবর্তী লৌকিক রাধা কৃষ্ণের মধ্যে। পশ্চিম সীমান্ত রাঢ়ে যারা ‘ রসিক ‘ হয়ে উঠেছিলেন , তাদের অধিকাংশই ছোট ছোট সামন্ত প্রভু । অর্থ সামর্থের জোর আর কিশোরী- তরুণীর প্রতি জৈবিক আকর্ষণ এবং প্রদর্শনের মোহ থেকে অনেকে রসিক হয়েছিলেন । হয়তো নৃত্যগীতের প্রতিও কিছুটা টান ছিল , কিন্তু সেটা প্রধান নয়। তবে ঝুমুরিয়া বা ঝুমুর গায়ক-কবিরাও কেউ কেউ রসেক হিসেবে খ্যাত হয়েছিলেন । তাঁরা কেউবা নাচনির আকর্ষণে কেউবা নিছক আপন গৌরব প্রদর্শনের জন্যও। তবু নৃত্যগীতের জন্য নিখাদ ভালোবাসা এঁদেরই চূড়ান্ত অধঃপতনের হাত থেকে ও সংস্কৃতিকে এরাই অনেকটা রক্ষা করে চলেছেন। ‘১
বিশিষ্ট লোকগবেষক শ্রমিক সেন তাঁর ‘ ঝুমুরবালা ‘ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন-
‘ নাচনী শব্দটা অপাংক্তেয় হলেও নাচনী রাখাটাও মানভূমের একটা স্ট্যাটাস । এক একজন রসিক একাধিক নাচনী রাখেন । নাচনী যেন রসিক-এর সম্পত্তি । তবে এ সম্পত্তি হস্তান্তর হয় । হস্তান্তরের কোন বিনিময় মূল্য থাকে না। থাকে নিহিত সম্ভ্রমবোধ । তার খর্ব হওয়া অপমানজনক। ‘ ২
শ্রমিক সেনের মতে- ‘এদের (নাচনিদের) মালিক রসিক। এরা রসিকের রাখেল। নাচনীর যতদিন যৌবন ততদিন কদর। তারপর যেন এদের প্রদীপ আলোহীন হয়ে যায়। এমনকি রসিকের কাছেও । যদিও রসিকের সংসার চলে নাচনীর টাকায়, তবুও রসিকের সংসার প্রাঙ্গনে ঠাঁই নেই। সমাজজীবনে রসিক এর সংসার আলাদা।সেখানে থাকবে তার বউ -ছেলে। নাচনীর জন্যে রইবে আলাদা ঘর । যা গ্রামের প্রান্তে , একান্তে।’ ৩
তিনি আরো বলেছেন – ‘ সমাজে নাচনীর উপার্জিত অর্থের রসিকের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত থাকলেও রসিকের বাড়িতে নাচনীর অবাধ যাতায়াত থাকে না। ‘ ৪
এবার আমরা মানভূমের রসিকদের যে বিভিন্ন প্রকারভেদ আছে , তার আলোচনায় অগ্রসর হব।
মানভূমের রসিক
১ ) ছোট জমিদার বা সামন্ত প্রভু ( যেমন- শ্যামলাল সিং, গৌরাঙ্গ সিং, অনন্তনারায়ণ সিংহ মানকি , কালী সিং সর্দার, বিনন্দিয়া সিং প্রমূখ ),
দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তবঙ্গে এমন অনেক ছোটো জমিদার বা সামন্ত প্রভু ছিলেন যাঁরা এক বা একাধিক নাচনি রেখে নিজ আভিজাত্যের পরিচয় দিতেন । কথিত আছে , ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের রাস উৎসবে একটানা ১৪ দিন ঝুমুর ও নাচনি নাচের আসর বসিয়ে বাগমুন্ডির রাজা মদনমোহন সিংহদেব রাজকোষের বিপুল অর্থ খরচ করে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন । এছাড়া, পাতকুমের রাজার সঙ্গে বাগমুন্ডির রাজার ঝুমুর গানের প্রতিযোগিতা কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে । কাশীপুরের পঞ্চকোট রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন প্রখ্যাত নাচনি শিল্পী সিন্ধুবালাদেবী।
২ ) ঝুমুরিয়া বা ঝুমুর কবি ( যেমন- রামকৃষ্ণ গাঙ্গুলি, চামু কর্মকার , নরোত্তম সিংহ , দ্বিজ টিমা, দীনবন্ধু তন্তুবায় ওরফে দীনা তাঁতি প্রমূখ) ।
মানভূমে এমন অনেক ঝুমুরিয়া বা ঝুমুর কবি ছিলেন যাঁরা রসিক হিসেবেও বিখ্যাত ছিলেন এবং নিজেরা নাচনি রাখতেন । এ প্রসঙ্গে প্রথমেই যাঁর নাম করতে হয় তিনি হলেন বিখ্যাত ঝুমুর কবি রামকৃষ্ণ গাঙ্গুলি।
৩ ) সাধারণ রসিক ( যেমন- মহেশ্বর মাহাত ওরফে চ্যাপা মাহাত , সিন্ধুবালাদেবীর রসিক ; বিজয় কর্মকার, পস্তুবালাদেবীর রসিক ; জগদীশ মাহাত , তারা দেবীর রসিক ; খেপু সিং পাতর , সরস্বতীদেবীর রসিক প্রমুখ ) ।
মানভূমের গ্রামে-গঞ্জে এরকম অনেক সাধারণ রসিক রয়েছেন । মূলত তারাই নাচনিদের শিক্ষাগুরু ও অভিভাবক রূপে নাচনি-রসিক পরম্পরাকে এখনো ধরে রেখেছেন।
নাচনি নাচের আলোচনা প্রসঙ্গে নাচনিদের দুঃখ -বেদনা তথা তাঁদের জীবন সংগ্রামই বেশি আলোচিত হয় । তাঁদের আড়ালেই থেকে যান নায়ক বা খলনায়ক রসিকেরা । রসিকদের স্বপ্নভঙ্গের কথা সেভাবে আলোচিত হয় না । অথচ নাচনি ও রসিক – একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ । এ কথা সত্য যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নাচনির রোজগারের অর্থ রসিক ভোগ করেন। রসিকের যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আছে, নাচনির তা নেই । আবার একজন রসিক এক বা একাধিক নাচনি রাখতে পারেন। কিন্তু উল্টোটা হয় না । একই সঙ্গে একজন নাচনির একাধিক রসিক দেখা যায় না। হয়তো নাচনির হাত বদল ঘটে বা রসিক পাল্টাতে পারে কিন্তু একই সঙ্গে একজন নাচনির একাধিক রসিক বিদ্যমান – তা দেখা যায় না।
যাইহোক, মানভূমে যে প্রায় ৭০ জন নাচনি শিল্পী রয়েছেন তাঁদের রসিকেরা অধিকাংশই তাঁদের মতো ভাগ্যবিড়ম্বিত, গরিব ও জীবনসংগ্রামী। এমন অনেক রসিক আছেন যাঁরা নাচনির জন্য নাচনির মতোই ঘর-সংসার সব ছেড়েছেন ।নাচনি শিল্পী পস্তবালাদেবীর রসিক বিজয় কর্মকার তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
নাচনি যেমন আর বাপের বাড়িতে ফিরে আসেন না , তেমনি অনেক রসিকও নাচনির সঙ্গে সারা জীবন কাটান । আর স্ত্রী- সন্তানের কাছে ফিরে আসেন না । কেউ কেউ স্ত্রী- সন্তানের কাছে ফিরে এলেও কোথাও যেন উভয়ের মাঝে অদৃশ্য দেওয়াল থেকেই যায়। সম্পূর্ণ সাংসারিক সুখভোগ আর হয় না।
তাই ,আমরা নাচনির প্রতি যতটা সহানুভূতি প্রদর্শন করি , তার কিছুটা যেন নাচনির শিক্ষাগুরু ও অভিভাবক তথা রসিকের ভাগ্যেও জোটে – এ প্রার্থনা করা যেতেই পারে ।মানভূমের নাচনি-আকাশে তাঁরা যে সূর্যস্বরূপ – তাদেরকে কেন্দ্র করেই নাচনিরা আবর্তিত।
মূল তথ্যসূত্র :
১) মানভূমের নাচনি কথা : প্রবীর সরকার , পুরুলিয়া দর্পণ , পূজা বার্ষিকী ১৪২৪ , পৃষ্ঠা ১৭৫ ।
২ ) ঝুমুর বালা : শ্রমিক সেন , প্রথম প্রকাশ, বইমেলা ২০০৩ , অন্তরাল প্রকাশনী কলকাতা ৭০০০৯১, পৃষ্ঠা ৮ ।
৩) লোকায়ত মানভূম (প্রথম খন্ড) : সম্পাদনা শক্তি সেনগুপ্ত , শ্রমিক সেন, অন্তরাল , বি জি – ১১৮ , বিধাননগর , কলকাতা ৭০০০৯১ ।
আরও পড়ুন
স্বপ্নপূরণ না হলেও জ্যাভিলিনে সোনা জিতলেন নীরজ
উত্তরাপথ: দোহায় ডায়মন্ড লিগে জ্যাভিলিনে সোনা জিতলেন নীরজ চোপড়া কিন্তু তার জ্যাবলিনে ৯০ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করার স্বপ্নপূরণ হল না । দোহায় তার জ্যাভিলিন থামল ৮৮.৬৭ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। গতবছরও এই লিগে প্রথম পদক জিতেছিলেন নীরজ। দোহার সুহেম বিন হামাদ স্টেডিয়ামে প্রথমবার জ্যাভলিন ছুড়েই চমক দেন নীরজ। প্রথমবারেই তার জ্যাভলিন চলে যায় ৮৮.৬৭ মিটার। ২০২২ সালে জুরিখের ডায়মন্ড লিগে সফলতা হয়েছিলেন নীরজ এবং টোকিও অলিম্পিকে সোনা জিতেছিলেন তিনি। তার লক্ষ্য ছিল ৯০ মিটারের গণ্ডি পেরনোর কিন্তুসেই লক্ষ্য .....বিস্তারিত পড়ুন
মানভূমে প্রচলিত রাত কহনি
ড. নিমাইকৃষ্ণ মাহাত: পুরুলিয়া জেলা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে (মানভূম ) সন্ধ্যার ঠিক কিছু পরেই ঠাকুমা , দিদিমা, পিসিমা , মাসিমারা ছোটদের নানা রূপকথা , উপকথা শোনায় যেগুলি ' রাত কহনি ' নামে পরিচিত।এরকম রাত কহনির দু একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন
হয়ে গেল পরিণীতি ও রাঘবের এনগেজমেন্টে
উত্তরাপথ: আংটি বদলের মাধ্যমে হয়ে গেল পরিণীতি চোপড়া ও রাঘব চাড্ডার এনগেজমেন্টে । পরিবার ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের উপস্থিতিতে একে-অপরকে আংটি পরিয়ে দিলেন রাঘব-পরিণীতি। শনিবারের মায়াবী সন্ধ্যায় রাঘব ও পরিণীতির জুটি থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না। এনগেজমেন্টে পরিণীতি পরেছিলেন ক্রিম রঙের সালোয়ার স্যুট। অপরদিকে রাঘব পরেছিলেন সাদা রঙের কুর্তা-পায়জামা। পরিণীতি ও রাঘবের এনগেজমেন্টে তাদের গোটা পরিবারকে দেখা গেল আনন্দ করতে। .....বিস্তারিত পড়ুন
কতো অজানা রে
মৈত্রেয়ী চৌধুরী: ইতিহাস বিষয়ে আলোচনা করতে গেলেই আমাদের মনে যে সব সৌধের প্রসঙ্গ মনে আসে তারমধ্যে পার্লামেন্ট ভবন একটা অবশ্য দ্রষ্টব্য স্থান। বহু পর্যটক এই ভবন দেখতে যান. কিন্তু জানেন কি, এই পার্লামেন্ট ভবনের ডিজাইন কে বানিয়েছিলেন ? 10 জনকে জিজ্ঞেস করলে 9 জনই বলতে পারবেন না। যাঁরা খুব ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন অথবা গুগুল সার্চ করে থাকেন, তাঁরা হয়তো উত্তরটা দিতে পারবেন। পার্লামেন্ট ভবনের ডিজাইন বানিয়েছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ স্থপতি এডুইন লুটিয়েন। তাঁর সহকারী ছিলেন আরেক ব্রিটিশ স্থপতি হার্বার্ট বেকার। 1927 খ্রিস্টাব্দে এই ভবনটির নির্মাণ সম্পূর্ণ হয় এবং ব্রিটিশ .....বিস্তারিত পড়ুন