মানভূমের ধাঁধা

ড. নিমাইকৃষ্ণ মাহাত

ধাঁধা ‘ শব্দটির উৎস সংস্কৃত ‘ দ্বন্দ্ব ‘ থেকে । যে বাক্য বা বাক্যগুচ্ছ দ্বারা একটি ভাব বা বিষয়কে রূপকের আশ্রয়ে জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে প্রকাশ করা হয়, তাকে ধাঁধা বলে। ধাঁধা আমাদের মনে শুধু ধন্ধের সৃষ্টি করে না, তা জটিল, কৌতূহলোদ্দীপক ও রসসিক্ত  এক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। প্রকৃতপক্ষে, বিশৃংখলভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিষয়বস্তুর ভাবনাকে সংহত করে সংক্ষিপ্ত রূপে প্রকাশ করাকে ধাঁধা বলে। ধাঁধার মধ্যে প্রশ্ন কর্তা যা একত্রিত করে হেঁয়ালি পূর্ণ জট পাকান, উত্তরদাতা বিশ্লেষণের দ্বারা সেই জট ছাড়ান। সুতরাং ধাঁধার পূর্ণাঙ্গ পরিচয় প্রশ্ন ও উত্তর উভয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে।

মানভূম তথা বর্তমান পুরুলিয়া জেলা ও সংলগ্ন অঞ্চলে কৃষি বিষয়ক এমন অনেক ধাঁধার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় যার মধ্যে এই অঞ্চলের কৃষক সমাজে প্রচলিত কৃষিকেন্দ্রিক লোকবিশ্বাসের ধারা মহামান দেখা যায়। এরকম ধাঁধার কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া হল : 

মা , বিটির একই নাম ,

ডুমকা ছড়ার ভিনু নাম ।

উত্তর: মহুল (মহুয়া) গাছ , মহুল ফুল এবং ফল (কচড়া)।

এখানে  মা ও বিটি (মেয়ে ) বলতে মহুল গাছ  ও মহুল ফুলকে বোঝানো হয়েছে। ডুমকা ছড়া ( ছেলে  ) বলতে মহুল ফল অর্থাৎ কচড়া – কে বোঝানো হয়েছে।

দাঁত আছে, আঁত নাই 

খায় কিন্তু হাগে নাই।

উত্তর:  দা ( কাস্তে )।

এখানে গ্রামীণ কৃষিকেন্দ্রিক সমাজে সাধারণ মানুষের লোকযন্ত্র সম্পর্কিত লোকজ্ঞান  প্রকাশিত হয়েছে।

ঘুসুর ঘুসুর ঘুসকা ,

তিনমুড় ,  দশ পা ।

উত্তর : লাঙ্গলের একজোড়া বলদ ও চাষী।

লাঙ্গল চালোনার সময় লাঙ্গলের ফলা মাটির বুক চিরে এগিয়ে যাওয়া বোঝাতেই এখানে  ‘ঘুসুর ঘুসুর ঘুসকা’ এই অনুপ্রাস ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে ধ্বনি সুষমা ও কাব্যিক সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়েছে। লাঙ্গল চালানোর সময় দুই বলদ ও চাচিকে নিয়ে মোট তিনটি মাথা ও দশটি পা হয়। পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক অভিজ্ঞতা কৃষক সমাজে প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত হয়ে তৈরি হয় লোকবিশ্বাস। নব প্রজন্ম সে বিশ্বাসে ভর করে শিখে নেয় কেমন কৃষি প্রক্রিয়াটি।

 রাঁই রুঁই সটকা 

 তিন মুড় , দশ পা।

উত্তর : দুধ দোহনকারী , গাভী ও বাছুর।

দুধ দোহনের সময় গাভীর বাঁট থেকে দুধ বার হওয়ার আওয়াজকে ‘ রাঁই রুঁই ‘ শব্দ প্রয়োগে বোঝানো হয়েছে। দুগ্ধ দোহনকালে গো দুগ্ধের যথার্থ অধিকারী বাছুরটি যে অপরিহার্য অঙ্গ, সেই বিশ্বাসটি বাংলার কৃষক মনে প্রবেশ করতে সাহায্য করেছে আলোচ্য ধাঁধাটি। 

 তিন দিকে তিন খুরা

বসে আছে মহাজন বুড়া।

উত্তর: উনান । 

ভাত রান্না করার হাঁড়িটিকে এখানে ‘ মহাজন বুড়া ‘ বলা হয়েছে ‌‌ মহাজন সম্পর্কিত ভীতি এখানে প্রকাশিত হয়েছে। এটাকে সামাজিক লোকবিশ্বাস বলা যায়।

আমি থাকি জলে ,

তুমি থাকো ডালে ,

দেখা হবে দুজনারই ,

মরণের কালে। 

উত্তর:  মাছ ও লঙ্কা।

ছোট ছোট দৈনন্দিন বিষয়গুলিকে অদ্ভুত দার্শনিকতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। 

এই আন্তরিকতার স্পর্শে গ্রামীণ কৃষকসমাজে এই ধাঁধা গুলি কৃষকের নিজের অন্তরে স্থান করে নিয়েছে।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক

উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই  সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন

Fried rice syndrome: আগের দিনের রান্না করা ভাত খেলে হতে পারে এই বিশেষ অসুখটি

উত্তরাপথঃ আপনার কি বাসী ভাত বা পান্তা খাওয়ার অভ্যেস আছে? সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম (Fried rice syndrome) নিয়ে আমরা প্রায়ই অবশিষ্ট খাবার গরম করে আবার খাই। কিন্তু জানেন কি এই অভ্যাস আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। অনেক সময় পর আগের রান্না করা  ভাত খাওয়ার ফলে পেট সংক্রান্ত সমস্যা হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে খাবার পুনরায় গরম করলে এতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, কিন্তু তা নয়। যে খাবারেই স্টার্চ থাকে না কেন, এতে উপস্থিত টক্সিন তাপ প্রতিরোধী। অর্থাৎ খাবার গরম করার পরও ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয় না। ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম নামে এই সমস্যা সম্পর্কিত একটি অবস্থা রয়েছে। আজ আমরা এই ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম অবস্থার লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। ভাত রান্না করার পর, যখন অবশিষ্ট ভাত কয়েক ঘন্টা বা সারারাত ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয় এবং তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে শুরু করে, তখন এই অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম। .....বিস্তারিত পড়ুন

Bandna Festival: ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পাঁচ দিন বাঁদনার আমেজে মশগুল থাকে

বলরাম মাহাতোঃ চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী কার্তিক অমাবস্যার আগের দিন থেকে মোট পাঁচ দিন ব্যাপী বাঁদনার(Bandna Festival) আমেজে মশগুল থাকে ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অবশ্য, পরবের শুভ সূচনা হয় তারও কয়েকদিন আগে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক শাসন ব্যবস্থার চূড়ামণি হিসাবে গাঁয়ের মাহাতো, লায়া, দেহরি কিম্বা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি নির্ধারণ করেন- ৩, ৫, ৭ বা ৯ ক’দিন ধরে গবাদি পশুর শিং-এ তেল মাখাবে গৃহস্বামী! রুখামাটির দেশের লোকেরা কোনোকালেই মাছের তেলে মাছ ভাজা তত্ত্বের অনুসারী নয়। তাই তারা গোরুর শিং-এ অন্য তেলের পরিবর্তে কচড়া তেল মাখানোয় বিশ্বাসী। কারণ কচড়া তেল প্রস্তুত করতে গোধনকে খাটাতে হয় না যে! কচড়া তেলের অপ্রতুলতার কারণে বর্তমানে সরষের তেল ব্যবহৃত হলেও, কচড়া তেলের ধারণাটি যে কৃষিজীবী মানুষের গবাদি পশুর প্রতি প্রেমের দ্যোতক, তা বলাই বাহুল্য! এভাবেই রাঢ বঙ্গে গোবর নিকানো উঠোনে হাজির হয়- ঘাওয়া, অমাবস্যা, গরইয়া, বুঢ়ি বাঁদনা ও গুঁড়ি বাঁদনার উৎসবমুখর দিনগুলি। পঞ্চদিবসে তেল দেওয়া, গঠ পূজা, কাঁচি দুয়ারি, জাগান, গহাইল পূজা, চুমান, চউক পুরা, নিমছান, গোরু খুঁটা, কাঁটা কাঢ়া প্রভৃতি ১১টি প্রধান পর্ব সহ মোট ১৬টি লোকাচারের মাধ্যমে উদযাপিত হয় বাঁদনা পরব(Bandna Festival )। .....বিস্তারিত পড়ুন

PAN-Aadhar link: কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে নিষ্ক্রিয় করেছে

উত্তরাপথ : আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link)করার সময়সীমা শেষ হওয়ার পরে কেন্দ্রীয় সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ড নিষ্ক্রিয় করেছে৷ আপনি যদি এখনও প্যান কার্ডের সাথে আধার কার্ড লিঙ্ক না করে থাকেন, তাহলে আপনি সরকারের এই কঠোর পদক্ষেপের আওতায় এসেছেন। আপনি যদি আপনার আধার কার্ডকে প্যানের সাথে লিঙ্ক করতে চান তবে আপনি জরিমানা দিয়ে এটি সক্রিয় করতে পারেন। কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে আধারের সাথে লিঙ্ক না করার কারণে নিষ্ক্রিয় করেছে। একটি আরটিআই-এর জবাবে, সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস জানিয়েছে যে আধার কার্ডের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link) করার সময়সীমা ৩০ জুন শেষ হয়েছে। যারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আধার কার্ড এবং প্যান কার্ড লিঙ্ক করেননি তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দেশে ৭০ কোটি প্যান কার্ড বর্তমানে ভারতে প্যান কার্ডের সংখ্যা ৭০.২ কোটিতে পৌঁছেছে। এর মধ্যে প্রায় ৫৭.২৫ কোটি মানুষ আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক করেছেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top