এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনায়

  অসীম পাঠক

রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকাল, নববর্ষের উন্মাদনা গঙ্গার ঘাটে। মা গতকাল সন্ধ্যায় অরিন্দম কে পই পই করে বলে দিয়েছিলেন, নবর্ষের সকালে গঙ্গাস্নান করে দক্ষিনেশ্বরে পূজো দিয়ে আসতে। রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র অরিন্দমের লক্ষ্য একজন ভালো ল ইয়ার  হওয়া। তার বাবাও কোলকাতা হাইকোর্টের নাম করা ঊকীল।  বাবা মা দুজনেই ধর্ম আর ঐতিহ্যর পরম্পরা কে গভীর বিশ্বাসে সযত্নে লালন পালন করেন।

বাবুঘাটে গঙ্গা স্নান সেরেই একটা চলন্ত এ সি  বাসে উঠে পড়লো। বাবা অবশ্য বলেছিলেন গাড়ি নিয়ে বেরুতে, কিন্তু না অরিন্দম সহজ সরল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত, তাই বলেছিলো  বাপী আমি বাসেই যাবো। বাসে ট্রাভেল টা বেশ এনজয় করে অরিন্দম।

বাসে উঠে টিকিট কাটতেই মাঝ বরাবর একটা সিট পেয়ে গেলো সে। পাশেই  ট্যাবে মুখ রেখে একটি মেয়ে টাইপ করে চলেছে নিঃশব্দে। অরিন্দম আড়চোখে দেখে নেয় একবার, ফর্সা সুশ্রী, কপালে তোলা সানগ্লাস, প্রসাধনের চিহ্ন মাত্র নেই। হাতে গোলাপি রিস্ট ওয়াচ, সাদা র উপরে ছোট ছোট জুঁই ফুল কালো রঙে আঁকা একটা  টপ আর ডেনিম জিন্স …  অরিন্দম যেনো চোখ ফেরাতে পারে না। মনের অবচেতনে যেনো এরই ছবি আঁকা …. বাবুঘাট থেকে দক্ষিনেশ্বর  পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ। বাসে রবীন্দ্রসংগীত বাজছে , এসো এসো হে বৈশাখ …. অরিন্দম অস্থির হয়ে ওঠে , মেয়েটার দিকে বারবার চোখ যায়।  একসময় মেয়েটি বলে ওঠে, এই যে হ্যালো মিষ্টার, কি এতো দেখছেন?  অরিন্দম আমতা আমতা করে না মানে …. সাদা শার্টে অরিন্দম কে বেশ আ্যাট্রাক্টিভ লাগে। কালো সানগ্লাসের আড়ালে দুটো উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। হাতে মা কালীর পূজোর জন্য ফুল ফলে ভর্তি একটা প্যাকেট, আর একটা ব্যাগে  বাবুঘাটে স্নান করা তোয়ালে টা রাখা।  মেয়েটি ইতিমধ্যে ট্যাবটাকে তার সাইডব্যাগে রেখে  অরিন্দমের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি ময়না  আপনি? অরিন্দম দেরী না করে উত্তর দেয় আমি অরিন্দম মুখার্জি , ল নিয়ে পড়াশোনা করছি। ফাইনাল ইয়ার চলছে।  ময়না বলে সে একটি নিউজ চ্যানেলের জন্য সাংবাদিকের কাজ করে। বালিতে থাকে।  বাবা ডাক্তার, মা নেই , এক ভাই।  এভাবেই পরিচয় পর্ব শেষ হয়। ভালোলাগে অরিন্দমের  ময়নার প্রতিটি কথা, ফাইবারে মোড়া জানালার পাশ থেকে কল্লোলিনী তিলোত্তমা কে কি অপরূপ লাগে অরিন্দমের। একসময় ময়না বলে ওঠে চুপিচুপি, আমার ই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ চুনী উঠলো রাঙা হয়ে। অরিন্দম গলা মেলায় , আমি গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম সুন্দর, সুন্দর হলো সে।  ময়না তাকিয়ে থাকে অরিন্দমের দিকে, যেনো বড্ড চেনা। ভালোলাগা র আবেশ। অরিন্দমের ও মনে হয়, আচ্ছা কোথাওকি সে ময়নাকে দেখেছে …?  ব্যাস্ততম নগরীর কোনো নির্জন সন্ধ্যায় অথবা শপিং মলে  নয়তো বা  কোথায় নয়। সব ভ্রান্তি। কিন্তু তা কি করে হয় …. স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি সব দুজনের আলাদা। কথায় কথায় বেরিয়ে আসে দুজনে অনেক সাংস্কৃতিক মঞ্চে আবৃত্তি করেছে কিন্তু কেও কাওকে দেখেনি, অথচ ….. হঠাৎ ময়না বলে ওঠে,  আচ্ছা আমি যা ভাবছি তুমিও কি তাই? ততক্ষণে দুজনেই আপনি থেকে তুমিতে এসেছে।  অরিন্দম ময়না দুজনেই সমস্বরে বলে ওঠে  “জন্মান্তর”।  তারপর হাসি হাসি মুখে একজন আর একজনের দিকে তাকিয়ে।  হঠাৎই অরিন্দমের স্মার্টফোন টা বেজে ওঠে। মা কালী র পূজার জন্য ফুল ফল মিষ্টির প্যাকেট টা  ময়নার কোলে বসিয়ে  ফোন টা ধরে, কথা শেষ করে ময়নার নাম্বার নিয়ে একটা মিস কল করে, বলে সেভ করে নাও। ময়না বলে হ্যাঁ মিষ্টার অরিন্দম মুখার্জি, আমি নাড়ুগোপাল বলে সেভ করলাম ঐ নামটা তোমাকেই মানায়। আর তুমি আমার নাম ময়না শুনেছো, এতোই মশগুল যে পুরোটা জানতে চাওনি। তা কি নামে সেভ করলে শুনি। অরিন্দম হাসতে হাসতে বলে  পেত্নী । আর পাঁচ মিনিট তারপর দুজনেই নামবে,  নামার আগেটাতে ময়না বলে আমার পুরো নাম  ময়না খাতুন।

অরিন্দমের মেরুদন্ড দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়। অপলক তাকিয়ে সে। ঠোঁটের কোনে একচিলতে হাসি নিয়ে ময়না বলে কি হলো, তোমার পূজোর জিনিস কি অশুদ্ধ হয়ে গেলো। অরিন্দম বলে, না আরও পরিশুদ্ধ হলো । অবেশষে ক্ষনিকের  যাত্রা পথ শেষ হয়, ঘড়ির কাঁটা টা যেনো দ্রুত ঘুরতে থাকে। নিরলস গতিতে সময় পেরিয়ে যায়।  দুজনেই নেমে পড়ে।

 অরিন্দম বলে একটা কথা বলবো, রাখবে?  ময়না বলে অবশ্যই  বলো। অরিন্দম বলে চলো না আজ নববর্ষের দিন, একসাথে মায়ের মন্দিরে পূজো দিই ….  ময়না বলে হ্যাঁ চলো। আমাদের পবিত্র রমজান মাস, রোজা চলছে। মন্দির চত্বরে গিয়ে ময়না বলে আচ্ছা তোমাকে যদি বলি কখনও আমাদের মসজিদে আসতে, আসবে ? অরিন্দম বলে কেনো আসবো না। আমার হবু বৌ এর জন্য তো এটুকু করাই যায়। ময়না চমকে ওঠে বলে এও কি সম্ভব?  অরিন্দম বলে সময় সব কথা বলবে।  মন্দির আর  মসজিদ সব জায়গাতেই শুধু  ভালোবাসার বিকাশ। কি মাঝরাত  কি দুপুর দুটো  কি শীত কি বৃষ্টি আমি শুধু ভালোবাসা বুঝি।

ভালোবাসি । ময়না সুর মেলায়  ভালোবাসি  ভালোবাসি ….   পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ যেনো ভালোবাসার সুনামি তে ঢেকে দিলো দুটি তরুণ প্রানকে। অসম্ভব সম্ভবের চৌকাঠ ডিঙিয়ে ভালোবাসার স্বপ্নালু চেতনায় দেশে  আমন্ত্রণ জানায় যেনো। আলোয় আলোময় হৃদয়ের প্রতিটি প্রকোষ্ঠ , তাদের মনের গহন গভীরে প্রেমের আশাবরী যেনো শান্ত সাধনার সুর তুলেছে।

দক্ষিনেশ্বর মন্দির চত্বরে এই মুহূর্তে এক অপার্থিব পবিত্রতা স্নিগ্ধতা … বৈশাখের প্রথম দিনেই  দীর্ঘ পথ চলার বার্তা। মানবতার অমল আলোয় প্রেমের পূজারী দুটি  সবুজ প্রান  তখনো মনের আনন্দ আবৃত্তি করে চলেছে রবি ঠাকুরের কবিতা ,,,,

পথ বেঁধে দিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি , আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।।

খবরটি শেয়ার করুণ

1 thought on “এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনায়”

  1. Pingback: তীর ভাঙ্গা ঢেউ - উত্তরাপথ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


রাতের ঘামের সমস্যা এবং এ সম্পর্কে আপনি কি করতে পারেন  

উত্তরাপথঃ রাতের ঘামের সমস্যা শরীরের কুলিং সিস্টেমের একটি স্বাভাবিক অংশ, তাপ মুক্তি এবং সর্বোত্তম শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে।তবে রাতের ঘাম একটি সাধারণ সমস্যা যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে।এর  অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্য ঘুম ব্যাহত হতে পারে, যার ফলে ক্লান্তি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। আপনি যদি রাতে অতিরিক্ত ঘাম অনুভব করেন, তাহলে তার অন্তর্নিহিত কারণটি চিহ্নিত করা এবং এটি মোকাবেলার জন্য কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রাতের ঘামের কিছু সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করা হল।মেনোপজ: যে কেউ, বয়স বা লিঙ্গ নির্বিশেষে, রাতের ঘাম অনুভব করতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন

ওজন হ্রাস (weight loss) মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে

উত্তরাপথঃ এপ্রিলে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, শাকসবজি, সামুদ্রিক খাবার এবং গোটা শস্য সমৃদ্ধ একটি ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য খাওয়া - এমনকি শুধুমাত্র খাদ্যের নির্দেশিকা অনুসরণ করে   ওজন হ্রাস (weight loss)মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে বলে মনে করা হয়।সাম্প্রতি ডিউক ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত, একটি  গবেষণায় দেখা গেছে যে ওজন হ্রাস মস্তিষ্কে বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ৯ মাস পর্যন্ত ধীর করে (aging process) দিতে পারে। গবেষণায় ৬০ থেকে ৭৮ বছর বয়সের মধ্যে ৪৭ জন অংশগ্রহণকারীকে জড়িত করা হয়েছিল, যাদের প্রত্যেকেরই ওজন বেশি বা স্থূল ছিল এবং তাদের অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যগ্রহণ  ছিল। তাদের এলোমেলোভাবে একটি ক্যালোরি-সীমাবদ্ধ গ্রুপ বা একটি নিয়ন্ত্রণ গ্রুপে বরাদ্দ করা হয়েছিল।ক্যালোরি-সীমাবদ্ধতা গোষ্ঠীর সদস্যদের একটি খাদ্য পরিকল্পনা অনুসরণ করে, যার লক্ষ্য ছিল তাদের আনুমানিক প্রয়োজনের চেয়ে ১০ – ১৫% কম ক্যালোরি গ্রহণ করা। অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রণ গ্রুপ তাদের খাদ্য পরিবর্তন করেনি .....বিস্তারিত পড়ুন

সেলফির উচ্চ রেটিং কি আপনাকে আরওপাতলা হতে উৎসাহিত করছে ?

উত্তরাপথঃ সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে সেলফি তোলা এবং নিজেকে পাতলা হিসাবে দেখানোর মধ্যে একটি সম্পর্ক থাকতে পারে। যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক সেন্ট জন ইউনিভার্সিটির রুথ নাইট এবং ইউনিভার্সিটি অফ ইয়র্কের ক্যাথরিন প্রেস্টন সম্প্রতি PLOS ONE জার্নালে তাদের ফলাফল প্রকাশ করেছেন।সেখানে সেলফির উচ্চ রেটিং এবং আমাদের শরীরের গঠনের মধ্যে যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।    বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ায় সেলফি হল এক জনপ্রিয় ছবি দেওয়ার ধরন। যিনি সেলফি তোলেন তিনি ক্যামেরাকে তাদের শরীর থেকে দূরে রেখে নিজেই নিজের ছবি তোলে। আগের গবেষণায় বলা হয়েছে সেলফিগুলি দেখার ফলে ছবির বিষয়গুলি সম্পর্কে দর্শকদের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Fried rice syndrome: আগের দিনের রান্না করা ভাত খেলে হতে পারে এই বিশেষ অসুখটি

উত্তরাপথঃ আপনার কি বাসী ভাত বা পান্তা খাওয়ার অভ্যেস আছে? সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম (Fried rice syndrome) নিয়ে আমরা প্রায়ই অবশিষ্ট খাবার গরম করে আবার খাই। কিন্তু জানেন কি এই অভ্যাস আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। অনেক সময় পর আগের রান্না করা  ভাত খাওয়ার ফলে পেট সংক্রান্ত সমস্যা হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে খাবার পুনরায় গরম করলে এতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, কিন্তু তা নয়। যে খাবারেই স্টার্চ থাকে না কেন, এতে উপস্থিত টক্সিন তাপ প্রতিরোধী। অর্থাৎ খাবার গরম করার পরও ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয় না। ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম নামে এই সমস্যা সম্পর্কিত একটি অবস্থা রয়েছে। আজ আমরা এই ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম অবস্থার লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। ভাত রান্না করার পর, যখন অবশিষ্ট ভাত কয়েক ঘন্টা বা সারারাত ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয় এবং তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে শুরু করে, তখন এই অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top