কতো অজানা রে

মৈত্রেয়ী চৌধুরী

ছবি : সংগৃহীত

ইতিহাস বিষয়ে আলোচনা করতে গেলেই আমাদের মনে যে সব সৌধের প্রসঙ্গ মনে আসে তারমধ্যে পার্লামেন্ট ভবন একটা অবশ্য দ্রষ্টব্য স্থান। বহু পর্যটক এই ভবন দেখতে যান। কিন্তু জানেন কি, এই পার্লামেন্ট ভবনের ডিজাইন কে বানিয়েছিলেন ? ১০ জনকে জিজ্ঞেস করলে ৯ জনই বলতে পারবেন না। যাঁরা খুব ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন অথবা গুগুল সার্চ করে থাকেন, তাঁরা হয়তো উত্তরটা দিতে পারবেন। পার্লামেন্ট ভবনের ডিজাইন বানিয়েছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ স্থপতি এডুইন লুটিয়েন। তাঁর সহকারী ছিলেন আরেক ব্রিটিশ স্থপতি হার্বার্ট বেকার। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে এই ভবনটির নির্মাণ সম্পূর্ণ হয় এবং ব্রিটিশ আমলে এর নাম ছিলো “কাউন্সিল হাউস”। ভারতের ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল এই ভবনটি তাঁর কাউন্সিলের মিটিংয়ের জন্য ব্যবহার করতেন। শুধু পার্লামেন্ট ভবন নয়, দিল্লির আরো অনেক বিখ্যাত ভবন ও বাংলোর ডিজাইন বানিয়েছিলেন লুটিয়েন সাহেব। দিল্লির সব থেকে ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা যেখানে থাকেন সেই জায়গার কথ্য নামই হয়ে গেছে “লুটিয়েন্স বাংলো”। তবে পার্লামেন্ট ভবন কে এডুইন লুটিয়েনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে মনে করা হয়। পার্লামেন্টের ইতিহাস ঘাঁটলে এই তথ্যই পাওয়া যায়। তবে বেশিরভাগ মানুষ ই জানেন না যে এই তথ্য অর্ধ সত্য। পার্লামেন্ট ভবনের ডিজাইন অবশ্যই এডুইন লুটিয়েনের বানানো, তবে এই ডিজাইনটি এডুইন লুটিয়েনের সম্পূর্ণ নিজস্ব মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে লুটিয়েন সাহেব মধ্যপ্রদেশ (তখনকার সেন্ট্রাল প্রভিন্সেস) বেড়াতে যান। সেখানে বর্তমান মোরেনা জেলায় অবস্থিত চৌসাথ যোগিনী মন্দির দেখতে পান। অন্যান্য হিন্দু মন্দিরের থেকে একেবারেই আলাদা স্থাপত্যে নির্মিত এই মন্দির লুটিয়েন সাহেব কে আকর্ষণ করে। মন্দিরটির স্থাপত্য তাঁকে এতটাই মুগ্ধ করে যে তিনি মন্দিরটির একটি স্কেচ বানান। সম্ভবত তাঁর ইচ্ছে ছিলো তাঁর নির্মিত কোনো ভবনে সেই স্কেচটি কাজে লাগাবেন। সেই সুযোগ তিনি পান কাউন্সিল হাউস বা পার্লামেন্ট ভবন তৈরী করার সময়। এই পার্লামেন্ট ভবন বা কাউন্সিল হাউস চৌসাথ যোগিনী মন্দিরের আদলে তৈরী করা হয়েছিল। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে লুটিয়েন সাহেব কখনোই স্বীকার করেন নি যে এই ভবনের ডিজাইনের আইডিয়া তিনি চৌসাথ যোগিনী মন্দির থেকে পেয়েছিলেন। এই সম্পর্কে কোনো নথিপত্রও ব্রিটিশরা রাখে নি। এর পেছনে শুধু যে লুটিয়েন সাহেবের একার কৃতিত্ব নেওয়ার মানসিকতা কাজ করেছিল তাই নয়, ব্রিটিশ ভারতের ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্মারক, গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিল হাউসের ডিজাইনের আইডিয়া কোনো ব্রিটিশের মস্তিষ্কপ্রসূত নয়, বরং একটা নেটিভ হিন্দু মন্দির থেকে নেওয়া হয়েছে – এটা স্বীকার করতে ব্রিটিশ জাত্যাভিমান বাধা দিয়েছিলো। তাই ব্রিটিশরা এটা তাদের কীর্তি বলে চালিয়েছিলো। স্বাধীনতার অনেক পরে একাধিক ভারতীয় স্থপতি ও ইতিহাসবিদ মোরেনার চৌসাথ যোগিনী মন্দিরের ডিজাইনের সঙ্গে পার্লামেন্ট ভবনের ডিজাইনের মিল খুঁজে পান। তারপর অনুসন্ধান করতে করতে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে এডুইন লুটিয়েনের মধ্যপ্রদেশ ভ্রমণের বৃত্তান্ত প্রকাশ পায়। তাই এই বিষয়ে কোনো নথিপত্র না থাকলেও পার্লামেন্ট ভবনের ডিজাইনের আইডিয়া কোথা থেকে এসেছিলো, তা স্পষ্ট হয়। এর পরের বার দিল্লি গিয়ে পার্লামেন্ট ভবন দেখলে এডুইন লুটিয়েনকে পার্লামেন্ট ভবনের জনক হিসেবে ধন্যবাদ জানাবেন না। বরং প্রণাম জানান ১০৫০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত চৌসাথ যোগিনী মন্দির কে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের পার্লামেন্ট ভবনের জননী হিসেবে।

মোরেনার চৌসাথ যোগিনী মন্দির আসলে একটি শিব মন্দির। মন্দিরে শিবের সঙ্গের চৌষট্টি যোগিনীর পুজো করা হতো। এই চৌষট্টি যোগিনীর থেকেই সম্ভবত চৌসাথ যোগিনী মন্দির নামটি এসেছে। বর্তমানে Archaeological Survey of India রক্ষনাবেক্ষণ করে।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


সম্পাদকীয়-  রাজনৈতিক সহিংসতা ও আমাদের গণতন্ত্র

সেই দিনগুলো চলে গেছে যখন নেতারা তাদের প্রতিপক্ষকেও সম্মান করতেন। শাসক দলের নেতারা তাদের বিরোধী দলের নেতাদের কথা ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন।  আজ রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে।  কেউ কারো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়।  আগ্রাসন যেন রাজনীতির অঙ্গ হয়ে গেছে।  রাজনৈতিক কর্মীরা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খুন বা মানুষ মারার মত অবস্থার দিকে ঝুঁকছে। আমাদের দেশে যেন রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না।আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে বেশি মানুষ নিহত হচ্ছেন।  ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) অনুসারে, ২০১৪ সালে, রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৪০০ জন প্রাণ হারিয়েছিল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২০০০ জন মারা গিয়েছিল।  আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য গর্বিত হতে পারি, কিন্তু এটা সত্য যে আমাদের সিস্টেমে অনেক মৌলিক সমস্যা রয়েছে যা আমাদের গণতন্ত্রের শিকড়কে গ্রাস করছে, যার জন্য সময়মতো সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। .....বিস্তারিত পড়ুন

ফ্লিম রিভিউ -ওপেনহাইমার

উত্তরাপথ: বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান দ্বারা পরিচালিত”ওপেনহাইমার” একটি মাস্টারপিস মুভি। ছবিতে জে. রবার্ট ওপেনহেইমার, এক নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পারমাণবিক বোমার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।এই সিনেমায় ওপেনহাইমার এর জটিল জীবনকে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই হিসেবে 'ওপেনহাইমার'কে বায়োপিক বলা যেতে পারে।  কারণ এটি একজন মানুষের গল্প। এই ছবির গল্প তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত।ছবির শুরুতে পারমাণবিক বোমা তৈরির আবেগের কথা বলা হয়েছে।  যেখানে নায়ক কিছু না ভেবে নিবেদিতপ্রাণভাবে এমন একটি অস্ত্র তৈরিতে নিয়োজিত থাকে যা বিশ্বকে ধ্বংস করতে পারে।  অস্ত্র তৈরি হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে নায়ক তার কাজের ফলাফল দেখে অপরাধবোধে পূর্ণ হয়।  এবং তৃতীয় পর্যায়টি হল রাজনীতি  যা ওপেনহাইমারকে মোকাবেলা করতে হয়েছে।  পুরো সিনেমাটি রঙিন হলেও রাজনৈতিক অংশ সাদা-কালো রাখা হয়েছে।  এই তিনটি সময়কালে যা কিছু ঘটছে, তা সবই একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। .....বিস্তারিত পড়ুন

ওজন হ্রাস (weight loss) মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে

উত্তরাপথঃ এপ্রিলে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, শাকসবজি, সামুদ্রিক খাবার এবং গোটা শস্য সমৃদ্ধ একটি ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য খাওয়া - এমনকি শুধুমাত্র খাদ্যের নির্দেশিকা অনুসরণ করে   ওজন হ্রাস (weight loss)মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে বলে মনে করা হয়।সাম্প্রতি ডিউক ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত, একটি  গবেষণায় দেখা গেছে যে ওজন হ্রাস মস্তিষ্কে বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ৯ মাস পর্যন্ত ধীর করে (aging process) দিতে পারে। গবেষণায় ৬০ থেকে ৭৮ বছর বয়সের মধ্যে ৪৭ জন অংশগ্রহণকারীকে জড়িত করা হয়েছিল, যাদের প্রত্যেকেরই ওজন বেশি বা স্থূল ছিল এবং তাদের অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যগ্রহণ  ছিল। তাদের এলোমেলোভাবে একটি ক্যালোরি-সীমাবদ্ধ গ্রুপ বা একটি নিয়ন্ত্রণ গ্রুপে বরাদ্দ করা হয়েছিল।ক্যালোরি-সীমাবদ্ধতা গোষ্ঠীর সদস্যদের একটি খাদ্য পরিকল্পনা অনুসরণ করে, যার লক্ষ্য ছিল তাদের আনুমানিক প্রয়োজনের চেয়ে ১০ – ১৫% কম ক্যালোরি গ্রহণ করা। অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রণ গ্রুপ তাদের খাদ্য পরিবর্তন করেনি .....বিস্তারিত পড়ুন

Roop Kishor Soni: একটি আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য তুলে ধরেছেন

উত্তরাপথঃ রাজস্থান মানেই ওজনদার রূপার গহনা ,আর তার উপর কারুকাজ। প্রচলিত এই ধারনা ভেঙ্গে আজ রূপোর গহনাকে আধুনিকতার সাথে শিল্পের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন যে ব্যক্তি তিনি হলেন রূপ কিশোরী সোনী(Roop Kishor Soni)।তিনি ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে তার অসাধারণ শিল্প কর্মের জন্য জাতীয় পুরুস্কার পান। রাজস্থানের জয়সলমেরের শহরের এই শিল্পী ৩.৮ গ্রাম ওজনের ০.৯ সেমি চওড়া রৌপ্য আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য খোদাই করেছেন।এই ছোট রূপার আংটিতে শিল্পী তাজমহল, সিডনি অপেরা হাউস, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, চীনের গ্রেট ওয়াল, আইফেল টাওয়ার, বিগ বেন, পিসার হেলানো টাওয়ার এবং মিশরীয় পিরামিডের চিত্র এক সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন।এছাড়াও তিনি আরও দুটি পৃথক ডিজাইনের অত্যাশ্চর্য আংটি  তৈরি করেছেন।৮.৬ গ্রাম ওজনের একটি রিংয়ে তিনি সূর্যাস্তের সময় ভারতীয় উট সাফারি সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভারতীয় বিশেষত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন,এবং অন্যটিতে বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবী ছবি এবং মন্দির খোদাই করেছিলেন। শিল্পী বলেছেন যে তিনি তার বাবার কাছ থেকে তার শৈল্পিক দক্ষতা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সেই সাথে তিনি বলেন "আমার বাবাও একজন জাতীয় পুরুস্কার প্রাপ্ত শিল্পী ছিলেন। তিনি আমাকে শিল্পের এই দক্ষতা শিখিয়েছিলেন কারণ তিনি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে শিল্পের ফর্মটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।" .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top