কাজী নজরুল ইসলাম: বাংলার বিদ্রোহী কবি

প্রীতি গুপ্তাঃ কাজী নজরুল ইসলাম, যিনি বাংলা সাহিত্যে “বিদ্রোহী কবি” নামে খ্যাত, একজন অসাধারণ কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক এবং সমাজ সংস্কারক ছিলেন । তিনি ১৮৯৯ সালের ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর জীবন ও সাহিত্য বাঙালির সংগ্রাম, বিদ্রোহ এবং মানবতার এক অমর কাহিনী। নজরুলের সাহিত্য শুধু কাব্যের মাধ্যমে নয়, গান, নাটক, প্রবন্ধ এবং গল্পের মাধ্যমেও সমাজের প্রতি তাঁর গভীর দায়িত্ববোধ প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

### প্রাথমিক জীবন

নজরুলের শৈশব ছিল দারিদ্র্য ও সংগ্রামে ভরা। তাঁর বাবা খোদা বক্স ছিলেন মসজিদের ইমাম, এবং মা জাহেদা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। অল্প বয়সে বাবাকে হারানোর পর নজরুল পরিবারের দায়িত্ব নিতে বাধ্য হন। তিনি মক্তবে পড়াশোনা শুরু করলেও অর্থাভাবে তা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কিশোর বয়সে তিনি লেটো দলে যোগ দেন, যেখানে তিনি গান রচনা ও গাওয়ার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এই সময়ে তাঁর সৃজনশীলতার প্রথম পরিচয় পাওয়া যায়।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নজরুল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং সেখানে তাঁর রাজনৈতিক চেতনা আরও তীব্র হয়। সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন তিনি ফারসি, আরবি এবং উর্দু ভাষা শিখেন, যা তাঁর সাহিত্যে বৈচিত্র্য নিয়ে আসে ।

### সাহিত্যে অবদান

নজরুলের সাহিত্য বিদ্রোহ, মানবতা এবং সাম্যের বার্তায় উজ্জ্বল। তাঁর বিখ্যাত কবিতা “বিদ্রোহী” (১৯২২) বাংলা সাহিত্যে একটি মাইলফলক। এই কবিতায় তিনি শোষণ, অত্যাচার এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তাঁর কবিতায় একদিকে যেমন আছে বিদ্রোহের আগুন, তেমনি আছে প্রেম, প্রকৃতি এবং আধ্যাত্মিকতার সুর।

নজরুল শুধু কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন বহুমুখী স্রষ্টা। তাঁর গান, যা “নজরুল গীতি” নামে পরিচিত, বাংলা সংগীতের একটি অমূল্য সম্পদ। এই গানগুলোতে ধ্রুপদী, লোক এবং পাশ্চাত্য সংগীতের মিশ্রণ রয়েছে। তাঁর বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে রয়েছে “কারার ওই লৌহ কপাট” এবং “ধূমকেতু আগুন তুমি”। তিনি প্রায় ৪,০০০ গান রচনা করেছেন, যা বাঙালির সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

নজরুলের উপন্যাস ও নাটকগুলোও সমাজের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেছে। তাঁর উপন্যাস “বাঁধন হারা” এবং নাটক “ঝিলিমিলি” তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রমাণ। তিনি নারী স্বাধীনতা, শ্রমিকের অধিকার এবং ধর্মীয় সম্প্রীতির পক্ষে সবসময় কলম ধরেছেন।

### রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে

নজরুল ছিলেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে একজন অকুতোভয় সৈনিক। তাঁর লেখনী এবং বক্তৃতায় তিনি স্বাধীনতার আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছেন। তাঁর পত্রিকা “ধূমকেতু” ছিল বিপ্লবী চিন্তার একটি মাধ্যম। এই পত্রিকার জন্য তিনি ব্রিটিশ সরকারের রোষের শিকার হন এবং কারাবরণ করেন। তাঁর কবিতা ও গান ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তরুণদের মনে নতুন উদ্দীপনা জাগিয়েছিল।

নজরুল ধর্মীয় সম্প্রীতির একজন প্রবক্তা ছিলেন। তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য কাজ করেছেন এবং তাঁর লেখায় এই বার্তা স্পষ্ট। তাঁর কবিতা ও গানে ইসলাম, হিন্দুধর্ম এবং অন্যান্য ধর্মের সমন্বয় দেখা যায়।

### ব্যক্তিগত জীবন ও শেষ জীবন

নজরুল ১৯২২ সালে প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করেন। তাঁদের চার পুত্র ছিল, কিন্তু দুঃখজনকভাবে দুজন অল্প বয়সে মারা যান। ১৯৪২ সালে নজরুল একটি রহস্যজনক রোগে আক্রান্ত হন, যার ফলে তিনি কথা বলার এবং লেখার ক্ষমতা হারান। এই সময় থেকে তিনি নীরব জীবনযাপন করেন। তাঁর স্ত্রী প্রমীলা দেবী তাঁর সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার নজরুলকে ঢাকায় নিয়ে আসে এবং তাঁকে “জাতীয় কবি” “জাতীয় কবি” হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

কাজী নজরুল ইসলাম শুধু একজন কবি বা সংগীতজ্ঞই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি যুগের প্রতীক। তাঁর সাহিত্য ও গান আজও বাঙালির মনে স্বাধীনতা, সমতা ও মানবতার বার্তা বহন করে। তাঁর অগ্নিঝরা কবিতা ও সুরেলা গানের মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে দিয়েছেন। নজরুলের জীবন ও কর্ম আমাদের শেখায়, কীভাবে প্রতিকূলতার মধ্যেও সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে হয়।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Vijay Stambh : চিতোরগড় দুর্গে বিজয় স্তম্ভ হিন্দু – মুসলিম সহাবস্থানের প্রতীক

উত্তরাপথঃ খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে মৌর্য রাজবংশ কর্তৃক স্থাপিত চিতোরগড় দুর্গ সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গ তার বিশাল কাঠামো, রাজপ্রাসাদ, একাধিক  সুদৃশ্য মন্দির সহ সুন্দর জলাশয়ের জন্য বিখ্যাত।৭০০-একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এই দুর্গটিতে প্রায় ৬৫টি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে যা রাজপুত এবং ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীর সূক্ষ্মতার প্রমান দেয়। বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh)) হল এই দুর্গে অবস্থিত,সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কাঠামো।এই আশ্চর্য-অনুপ্রেরণামূলক স্তম্ভটি কেবল তার উচ্চতার জন্য বিখ্যাত নয়,এটি রাজপুতদের অদম্য সাহস এবং অধ্যবসায়ের গল্পও বলে যা চিতোরগড় দুর্গেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে।বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh), নাম থেকে বোঝা যায়, বিজয়ের প্রতীক।  প্রাচীনকালে যে কোনো যুদ্ধ অভিযানের সাফল্যের পর সেই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে রাজারা মন্দির, স্তূপ, স্মৃতিস্তম্ভ ও স্তম্ভ নির্মাণ করতেন।  ৯ তলা এই বিজয় স্তম্ভটি ১৯৪০ থেকে ১৪৪৮ সালের মধ্যে মহারানা কুম্ভ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

Free Gift in Politics: ভারতের নির্বাচন ও ফ্রি গিফট সংস্কৃতি

উত্তরাপথঃ ফ্রি গিফট (Free gift in politics)এর রাজনীতি সম্প্রতি ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করছে। বিনামূল্যে কোটি কোটি জনগণকে উপহার প্রদান যা রাজকোষের উপর অতিরিক্ত বোঝা ফেলবে এই সত্যটি জানা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক দলগুলি ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য ফ্রি গিফট (Free gift in politics) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনের দৌড়ে একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।এক সময় প্রয়াত তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতা বিনামূল্যে শাড়ি, প্রেসার কুকার, ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন সেট ইত্যাদির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের আগে যে বিনামূল্যের সংস্কৃতি শুরু করেছিলেন তা পরবর্তী কালে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি দ্রুত অনুসরণ করেছিল। এরপর ২০১৫ সালে আম আদমি পার্টি নেতৃত্ব দিল্লির ভোটারদের কাছে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, জল, বাস ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক

উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই  সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন

Fructose: নতুন গবেষণায় ফ্রুক্টোজকে স্থূলতার কারণ বলা হয়েছে

উত্তরাপথঃ একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় জোরালো প্রমাণ দেওয়া হয়েছে যে ফ্রুক্টোজ (Fructose), সাধারণত প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং পানীয়গুলিতে থাকা এক ধরনের চিনি, যা স্থূলতার প্রাথমিক চালক। বছরের পর বছর ধরে, পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা , পাশ্চাত্য খাদ্যে, স্থূলতার মূল কারণ নিয়ে বিতর্ক করেছেন, কেউ কেউ অত্যধিক ক্যালোরি গ্রহণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, অন্যরা কার্বোহাইড্রেট বা চর্বি জাতীয় খাবারকে দায়ী করেছেন। Obesity জার্নালে সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে ফ্রুক্টোজকে স্থূলতার প্রকৃত চালক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।The University of Colorado Anschutz Medical Campus এর Dr. Richard Johnson এবং তার দলের মতে, ফ্রুক্টোজ হল একটি সাধারণ চিনি যা ফল এবং মধুর প্রাথমিক পুষ্টি। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top