ড. সায়ন বসু* , জোহানেসবার্গ
শেষবার মানুষ যখন চাঁদের মাটিতে পা রেখেছিল ১৯৭২ সালে, তখন ভারতবর্ষের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৫৮ কোটি| ৫১ বছর পর আবার নাসার হাত ধরে আমরা স্বপ্ন দেখছি চাঁদের মাটিতে পা রাখার আর্টেমিস মিশনের মাধ্যমে| এই মিশনের অন্যতম লক্ষ্য হল চাঁদের মাটিতে ভবিষ্যতে জনবসতি গড়ে তোলা সাথে মঙ্গলগ্রহে পাড়ি দেওয়াও বটে| নাসার এই মিশনে আমেরিকার সাথে কাজ করছে আরও ২৩টি দেশ যাদের মধ্যে অন্যতম হল কানাডা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রাজিল-এর মতো দেশ| নাসার এই মিশনের নামকরণ করা হয়েছে গ্রীক দেবী আর্টেমিসের নামে যিনি গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী চাঁদের দেবীও বটে এবং মনে করা হয় তিনি অ্যাপোলোর যমজ বোন| আপাতত এই মিশনের চারটি পর্যায়ঃ আর্টেমিস১, আর্টেমিস২, আর্টেমিস৩, এবং আর্টেমিস৪| এই চারটি পর্যায়ের মধ্যে এখনও অব্দি আর্টেমিস ১ পুরোপুরি সম্পন্ন যেখানে একটি মহাকাশযানকে (মহাকাশচারী ছাড়া) পাঠানো হয় চাঁদের কক্ষপথে এবং তারপর সেটিকে পৃথিবী ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়| মহাকাশযানটিকে আমেরিকার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয় গতবছর ১৬ই নভেম্বর এবং তা পৃথিবীতে ফিরে আসে ১১ই ডিসেম্বর| আর্টেমিস২ মিশনে চারজন মহাকাশচারীকে পাঠানো হবে চাঁদের কক্ষপথে এবং তাদের আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হবে | আর্টেমিস ৩ মিশনে মহাকাশচারীরা চাঁদে অবতরণ করবেন এবং নানান পরীক্ষামূলক কাজ কর্ম করে পৃথিবীতে ফিরে আসবেন ৭ দিন পর| আর্টেমিস ৪ মিশনে আরও নতুন মহাকাশচারীদের পাঠানো হবে| এই চারটি পর্যায়ে আর্টেমিস মিশন শেষ হতে সময় লাগবে আনুমানিক ৮ বছর এবং এই মিশনের খরচা বাবদ প্রতি বছর প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকা) ধার্য করা হয়েছে |
কিন্তু প্রশ্ন হল, চাঁদে পাড়ি দেওয়া এত কেন গুরুত্বপূর্ণ? এটার ছোট একটা উত্তর হল, আমাদের পৃথিবীকে বুঝতে বা চিনতে হলে চাঁদকে আমাদের জানতেই হবে| বিজ্ঞানীদের মধ্যে বেশ বড় একটা অংশ মনে করেন যে, আজকে থেকে প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে যখন আমাদের সৌর-মণ্ডল নেহাতই “তরুণ” তখন মঙ্গলগ্রহের সমান আকারের একটি বস্তু পৃথিবীর উপর আছড়ে পরে প্রবল বেগে এবং এরপর ওই বস্তুটি থেকে সাথে পৃথিবীর উপরিভাগ থেকেও প্রচুর পরিমাণে পদার্থ মহাকাশে উড়ে যায় এবং ওই ধ্বংসাবশেষের কিছু অংশ একসাথে মিলেই সৃষ্টি হয় চাঁদের| তাই চাঁদের মাটি যদি ভালো ভাবে পরীক্ষা করা যায় তাহলে হয়তো এটা জানা যাবে যে সৌর-মণ্ডল তৈরি হওয়ার সময় আমাদের এই পৃথিবীর মাটি বা আমাদের গ্রহ তৈরির উপাদান কেমন ছিল|
চাঁদে যেসমস্ত খাদ, গর্ত দেখা যায় সেগুলো তৈরি হয়েছে আজ থেকে বহু কোটি বছর আগে গ্রহাণু, ধূমকেতু এসব আছড়ে পড়ার ফলে এবং গবেষণাতে দেখা গেছে ওই একই সময়ে পৃথিবী সমেত আরও অনেক গ্রহেই ওই ধরনের ঘটনা ঘটেছে| যেহেতু আমাদের পৃথিবীর মধ্যে টেকটনিক প্লেটের নড়াচড়া চলছে সাথে ভূক্ষয় বা বৃষ্টি এসবও লেগেই আছে, তাই ওই গ্রহাণু বা ধূমকেতুর আছড়ে পড়া থেকে তৈরি হওয়া খাদগুলির সন্ধান পাওয়া প্রায় একপ্রকার অসম্ভব| অন্যদিকে চাঁদে যেহেতু বায়ুমণ্ডল নেই, তাই ভূক্ষয় বা বৃষ্টি এসবও কিছুই নেই তাই একই ভাবে তৈরি হওয়া খাদগুলি আজও রয়ে গেছে| তাই ভবিষ্যতে যখন মহাকাশচারীরা চাঁদ থেকে পাথর বা অন্য কোনও উপাদান নিয়ে আসবেন তখন সেগুলি পরীক্ষা করে আমরা জানতে পারবো যে আজকে থেকে সেই সময়ে আমাদের পৃথিবীতে ঠিক কি হয়েছিল| এক কথায় বলতে গেলে চাঁদ মোটামুটি একটা টাইম-মেশিন আমাদের কাছে| পৃথিবীতে কি ভাবে প্রাণের শুরু সে খবরও দিতে পারে চাঁদের মাটি| যেহেতু এত কোটি বছর পরেও চাঁদের উপরিভাগে কোনও কিছুরই পরিবর্তন হয়নি তাই চাঁদ থেকে পাওয়া উপাদান সংগ্রহ করে বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতে আমাদের দিশা দিতে পারেন পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার কিভাবে হয়েছিল সেই ব্যাপারে| যদিও চাঁদের উপরিভাগের তেমন কিছুই পরিবর্তন হয়নি, কিন্তু আমাদের পৃথিবীর মতো চাঁদেও অগ্ন্যুৎপাত হয়েছে (সেটা খুবই বিরল) তাই মহাকাশচারীরা ভবিষ্যতে যখন চাঁদের কোনও আগ্নেয়ুগিরি থেকে নমুনা নিয়ে আসবেন, সেসব পরীক্ষা করে জানা যাবে আমাদের পৃথিবীতে যেসমস্ত অগ্ন্যুৎপাত হয় বা আগ্নেয়গিরি আছে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য| বিগত দু’দশকে নাসা এবং ভারতীয় সংস্থা ইসরো মিলে চাঁদের গোলার্ধে জলের সন্ধান পেয়েছে (যদি তা আছে বরফের আকারে)| ভবিষ্যতে চাঁদে যখন স্থায়ী জনবসতি গড়ে উঠবে তখন ওই বরফ থেকে জল পাওয়া যাবে এবং সাথে রকেটের জ্বালানিও তৈরি করা সম্ভব হবে |
সবকিছু মিলিয়ে সামনের কয়েকবছর মহাকাশ বিজ্ঞানীরা বেশ উৎসুক এবং উৎকণ্ঠার সাথে তাকিয়ে থাকবেন আর্টেমিস মিশনের দিকে, সাথে আমরা আশায় বুক বাঁধবো কবে ‘চাঁদের বুড়ীর’ পাশে বসে কেউ চাঁদের পাহাড় থেকে এক টুকরো পাথর পৃথিবীতে নিয়ে আসবে সেই দিকে |
*Center for Astrophysics, University of the Witwatersrand, Johannesburg, South Africa
Pingback: Indian Astronomy: ভারতবর্ষ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা (প্রথম কিস্তি) - উত্তরাপথ