জাদু শঙ্খ

অনসূয়া পাঠক, বাঁকুড়া

ফিল্ম ডিরেক্টর রাইমা মুখার্জি খুব কমসময়ে প্রচুর সাফল্য অর্জন করেছে । তার পুরো ক্রেডিট ফেমাস ফিল্ম প্রোডিউসার তার বাবা আলোক মুখার্জির নয় … রাইমা নিজের প্রচেষ্টায় মুম্বাইয়ে মাটি তৈরী করেছে। বাঙালি হয়েও হিন্দি সিনেমা জগৎ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ।
আলোক মুখার্জির ব্যাঙ্গালোরের এক বন্ধু ফেমাস বিজনেস ম্যাগনেট মি. কে. কে। একদিন আলোক মুখার্জি কে ফোনে জানালেন, তিনি একটি সিনেমা করতে চান, বিশেষ একজনের জীবনী নিয়ে, এই জন্য তিনি রাইমা র সাথে মিট করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং এই সিনেমার ফিফটি পারসেন্ট ইনভেষ্টমেন্ট তিনি করবেন, কোন রকম প্রোফিটের আশা ছাড়াই। আলোক মুখার্জি রাইমা কে বলেন ব্যাঙ্গালোরে মি. কে.কে. র কাছে যেতে।
কোনো এক সানডে রাইমা কেকে র ফ্ল্যাট এ পোঁছে যায়, ডোর বেল বাজাতেই কেকে র নেপালি সিকিউরিটি দরজা খোলে – ব্লু ব্লেজার ও কালো সানগ্লাস পরে কেকে ড্রইং রুমে এসে বসে কফির অর্ডার করে …. কফি ও স্ন্যাকস খেতে খেতে দুজনে গল্প শুরু করে …. রাইমা নিজের মেজাজে বলে, ” আংকল ড্যাডির কথায় আমি মিট করতে এসেছি , বাট স্টোরি র মধ্যে আকর্ষণীয় কিছু না থাকলে আমি এটার ডিরেক্টর থাকতে পারবো না, বিকজ কাজ নিয়ে আমি ভীষণ সিরিয়াস ” … কেকে মুচকি হেসে বলে , “ওকে আগে স্টোরি টা তো শোনো ” … এরপর সরাসরি গল্পে চলে যান কেকে … এই গল্পের শুরু শহর কোলকাতার গড়িয়াহাটের একটি বস্তিতে .. মধ্যবিত্ত কিশোর একটি মার্কেটিং কোম্পানির সেলস বয় … স্ত্রী মালতী ও একমাত্র মেয়ে ঋতু কে নিয়ে তার অভাবের সংসার চলে যায় … বুকের ভেতরে অনেক জমানো স্বপ্ন কিশোরের …. একমাত্র মেয়েকে ভালো স্কুলে ভর্তি করবে, একটা ফ্ল্যাট কিনবে, একটা ছোট গাড়ি থাকবে … দূরে আন্ডার কনস্ট্রাকশন বিল্ডিং এর দিকে আঙুল তুলে ছোট্ট মেয়েকে দেখিয়ে বলে, একদিন আমরা ঠিক গলি ছেড়ে ওই বাড়িতে গিয়ে উঠবো …. কিশোর নিজের কাজ খুব সততা ও দক্ষতা র সাথে করে । অনেক দিন ধরেই শুনছে কোম্পানির বাজার মন্দা। হঠাৎই একদিন অফিসে গিয়ে দেখে গেটের সামনে নোটিশ বোর্ডে হাল্কা জটলা …. বেশ কিছু কর্মীকে কোম্পানি ছাঁটাই করেছে। লিস্ট দেখে চমকে ওঠে কিশোর। একি এই তার ভালো কাজের পুরষ্কার? কোম্পানি তাকেও বাদ দিয়েছে। অভিমানে যন্ত্রণায় কিশোর গঙ্গার তীরে এসে নীরবে চোখের জল ফেলে। সামনে অনিশ্চয়তায় ভরা, কি করবে ? কি খাওয়াবে স্ত্রী-কন্যাকে ? সন্ধ্যা হয়ে আসে, আকাশে কালো মেঘ করেছে।
এবার বাড়ি ফিরতে হবে গঙ্গার তির দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় বালি ও পলি মাটির স্তুপের দিকে হালকা আলোর বিন্দু দেখে তাকায় ….যেনো অসংখ্য জোনাকি এক জায়গায় জমা হয়ে আছে। কাছে গিয়ে কিশোর দেখে একটি সোনালী শঙ্খ পলি মাটি লেপ্টে থাকা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। শঙ্খ টি হাতে নিয়ে উপরের মাটি মুছতে মুছতে দেখে একটি বেগুনি আলোর রশ্মি শঙ্খ থেকে বেরিয়ে আসছে। কিশোর ভয় পেয়ে চমকে ওঠে। শঙ্খটি তার হাত থেকে পড়ে যেতেই সেও দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে। অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে একটি সাড়ে তিন ফুট লম্বা নীল চেহারার সাদা আলখাল্লায় মোড়া হাতে একটা সোনালী ছড়িবালা লোক কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলছে, কেয়া হুকুম মেরে আকা…. কিশোর তখনও ঠক ঠক করে কাঁপছে। নীল লোকটি বলে, “ভয় নেই জাঁহাপনা আমি এই যাদু শঙ্খের জিন, একশো বছরে একবার বাইরে আসি … আর এসেই যে কোন একজন মানুষের একটি ইচ্ছা পূরণ করে থাকি, বিনিময়ে আমার একটি ছোট্ট শর্ত থাকে, আমি সময় হলে সেটি চেয়ে নেবো, এক পক্ষ কাল আমি লোকালয়ে থাকবো, কিন্তু আপনি ছাড়া আমায় কেও দেখতে পাবে না, এবার বলুন জাঁহাপনা ,আপনার জন্য আমি কি করতে পারি? ভেবে বলবেন কিন্তু, যে কোন একটি ইচ্ছা পূরণ ” …..
কিশোর যেনো স্বপ্ন দেখছে , একি তবে ঈশ্বরের দূত … কিশোর বলে, ঠিক আছে , আপনি যদি আমার একটি ইচ্ছা পূরণ করতেই চান, তবে আমাকে সবচেয়ে বড়ো মার্কেটিং কোম্পানির মালিক বানিয়ে দিন। নীল লোকটি সাথে সাথেই বলে ওঠে, “যো হুকুম মেরে আকা, কিন্তু মনে রাখবেন এক পক্ষ কালের মধ্যে আমার একটা ইচ্ছা পূরণ আপনাকে করতে হবে”। সহসা কিশোর দেখে সে একটি ত্রিশ তলা বিশিষ্ট নীল কাঁচে ঢাকা একটি বহুতল অফিসের এয়ার কন্ডিশনার রুমে রিভলভিং চেয়ারে বসে আছে। চোখের সামনে তার সব কর্মচারীরা তার হুকুমের অপেক্ষায়। কালো কাঁচে মোড়া টেবিলের উপর একটা ট্রফি জ্বলজ্বল করছে, তাতে লেখা, বেস্ট মার্কেটিং কোম্পানি অফ দ্যা ইয়ার। মালিকের জায়গায় লেখা কিশোর কাঞ্জিলাল। এমন সময়ে ড্রাইভার এসে বলে, স্যার এবার বেরুবেন কি? কিশোর নিজের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে, কালো কোর্ট, নীল টাই, হাতে জাপানি কোম্পানির বেস্ট ব্র্যান্ডের রিস্ট ওয়াচ। সাদা মার্সিডিজ গাড়িতে এসে উঠে কিশোর। গাড়িটি একটা সুন্দর ছিমছাম বাংলোর সামনে এসে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে তার স্ত্রী মালতী ছুটে এসে বলে, এ কি স্বপ্ন গো, একজন মানুষ আমাদের বস্তির বাড়ি থেকে এখানে এনে বলে, এবার থেকে আপনারা এখানেই থাকবেন। কিশোর তখন বলে লোকটা কে ছিলো বলো তো? মেয়ে ঋতু তখন বাইরে বেরিয়ে এসে বলে বাবা একটা কাকু আমাদের এখানে নিয়ে এলো, বললো এই বাড়িটা আমাদের। কিশোর এবার সব ঘটনা খুলে বলে মালতী কে …. সময় এগিয়ে চলে। কিশোর এখন ব্যাবসা, চেম্বার অফ কমার্স এর মিটিং, ফরেণ ট্যুর এসব নিয়েই বিজি। মেয়ে ও ভালো স্কুলে ভর্তি হয়েছে। একদিন ডিনার পার্টিতে কোম্পানির সব ডিরেক্টররা হাজির হয়েছেন। এমন সময় কিশোর দেখে সেই নীল লোকটি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাকে বাইরে আসার জন্য বলছে। কিশোর সম্মোহিতের মতো তার পেছনে পেছনে বাগানে একটি দেবদারু গাছের নীচ এসে দাঁড়ায়। এবার নীল লোকটি বলে ওঠে “আমার শর্ত টা খেয়াল আছে তো ? ” … চমকে ওঠে কিশোর। আমতা আমতা করে বলে, বলুন , আপনি কি চান? যাদু শঙ্খ থেকে বেরোণো সেই নীল লোকটা বলে ওঠে ,” আমি চাই তোমার সবচেয়ে প্রিয় একটি জিনিস, তোমার মেয়েকে আমায় দাও ” .. চমকে ওঠে কিশোর। একটা আর্ত চিৎকার ধ্বনিত হয় , না …. এ কি করে সম্ভব, সব তুমি ফিরিয়ে নাও, আমার কিছু চাই না, আমার মেয়ে আমার জীবন। ওকে ছাড়া কি করে বাঁচবো আমি? ম্লান হেসে নীল লোকটি বলে , “ফেরত তো কিছুই নেওয়া যাবেনা, হাজার বছর আগের এক শাপভ্রষ্ট রাজা আমি। প্রতি একশো বছরে যে কোন একজনের ইচ্ছা পূরণ করে তার একটি প্রিয় জিনিস নিয়েই আমি একটু একটু করে শাপমুক্ত হই …. আর দুশো বছর পর আমি মুক্তি পাবো। আমার শরীরের একটা চোখ আর একটা পা এখনো আমার নিতে হবে, তোমার মেয়েকে পেলে আমি এবছর ই শাপমুক্ত হতে পারতাম। কেননা সৎ এবং নির্লোভ আত্মাই আমাকে মুক্তি দিতে পারে …. “
কিশোর বলে, তবে দ্বিধা না করে আমার একটা চোখ আপনি নিন…. নীল লোকটা বলে, ঠিক আছে জাঁহাপনা আপনার বাম চক্ষু টি আমি নিলাম “-
কিশোরের যখন জ্ঞান ফেরে তখন দেখে কোলকাতার সবচেয়ে বড়ো নার্সিং হোমে সে শুয়ে আছে। স্ত্রী মালতী পাশে বসে …. বাঁ চোখে ব্যান্ডেজ। সামনে টেলিভিশন এ ব্রেকিং নিউজ চলছে , বিশিষ্ট শিল্পপতি মি কিশোর কাঞ্জিলাল এক আকস্মিক দুর্ঘটনায় তাঁর বাম চক্ষুটি হারিয়েছেন।
রাইমা রুদ্ধশ্বাস এই গল্প শুনে মি. কে কে র দিকে তাকিয়ে বলে, ডান … তখন মি. কে কে রাইমা র দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চোখের কালো চশমা টা খুলে উঠে দাঁড়ায় । রাইমা স্থির দৃষ্টিতে দেখে মি. কে কে র বাম চোখটা নীল পাথরের।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


আগামী ৩ বছরে শূন্য বর্জ্য হওয়ার পথে রাজস্থানের প্রথম গ্রাম

উত্তরাপথঃ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের একটি প্রকল্পের আওতায় আঁধি গ্রামে এই পরিবর্তন করা হচ্ছে।জয়পুর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আন্ধি গ্রাম।আগামী তিন বছরে এই গ্রাম শূন্য বর্জ্য হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে ।আন্ধি গ্রামের এই সম্পূর্ণ রূপান্তরটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের একটি প্রকল্পের অধীনে করা হচ্ছে।  এই প্রকল্পটি সবুজ প্রযুক্তির হস্তক্ষেপ ব্যবহার করে আন্ধি গ্রামকে জিরো ওয়েস্ট মডেলে রূপান্তরিত করার কাজ চলছে ।  এই প্রকল্পটি ২১ মার্চ ২০২২ এ শুরু হয়েছে,  প্রকল্প পরিচালক বলেন, এ গ্রামের অবস্থা আগে খুবই খারাপ ছিল।আগে এই গ্রামের লোকেদের কঠিন বর্জ্য আলাদা করার কোনও ধারনা ছিল না । .....বিস্তারিত পড়ুন

মানব-চালিত রোবট ARCHAX এর সাথে দেখা করুন

উত্তরাপথঃসাম্প্রতিক বছরগুলিতে, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি আমাদের এক ধাপে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে এসেছে, আজ রোবটগুলি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্বয়ংক্রিয় সহকারী থেকে স্ব-ড্রাইভিং গাড়ি পর্যন্ত,সর্বত্র আজ রোবটের অবাধ উপস্থিতি। ARCHAX মানব-চালিত এই রোবট  এমনই এক উদ্ভাবন যা বিজ্ঞানী এবং সাধারণ জনগণ উভয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে । অটোনোমাস রোবোটিক কম্প্যানিয়ন উইথ হিউম্যান অ্যাসিসট্যান্সের সংক্ষিপ্ত আর্ক্যাক্স, এর একটি যুগান্তকারী সৃষ্টি যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) বুদ্ধিমত্তাকে একজন মানব অপারেটরের দক্ষতা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার সাথে একত্রিত করে তৈরি করা হয়েছে।জাপানের Tsubame Industries ARCHAX তৈরি করেছে।এটি একটি মানুষের আকারের ককপিট সহ একটি বিশাল ট্রান্সফরমার রোবট। .....বিস্তারিত পড়ুন

সুপার পটেটোর অনুসন্ধান - বিজ্ঞানীরা আলু সুপার প্যানজেনোম তৈরি করেছেন

উত্তরাপথঃ আলু বহু শতাব্দী ধরে রান্নার বহুমুখীতা এবং উচ্চ পুষ্টির মানের জন্য খাদ্যের একটি প্রধান উৎস। আলু আজ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি কোণে উৎপাদিত হয়, যা আলুকে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ফসলগুলির মধ্যে একটি করে তুলেছে । বছরের পর বছর ধরে, বিজ্ঞানীরা আলুর ফলন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং পুষ্টি উপাদান উন্নত করার জন্য এবং আরও ভাল আলুর জাত প্রজননের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। আলুর জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবেষকরা আলু সুপার প্যানজেনোম তৈরি করেছেন যা আলু গবেষণা এবং প্রজননে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক চিহ্নিত হবে বলে বিজ্ঞানীদের আশা । .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top