

উত্তরাপথঃ লবণ একটি সাধারণ উপাদান যা খাবারের স্বাদ বাড়াতে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু লবণের অত্যধিক ব্যবহার আমাদের স্বাদ এবং আমাদের স্বাস্থ্য উভয়ের উপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যদিও খাবারে ব্যবহৃত এক চিমটি লবণ ক্ষতিকারক বলে মনে নাও হতে পারে, তবে বিজ্ঞানীদের মতে, খাবারে অতিরিক্ত লবণও অনেক সমস্যার কারণ হতে পারে। এর স্বাস্থ্যগত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে পরিচালিত একটি নতুন গবেষণায় দেখা গেছে যে সোডিয়াম সমৃদ্ধ লবণের অত্যধিক ব্যবহার একজিমার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের দ্বারা পরিচালিত এই গবেষণা অনুসারে, প্রতিদিন মাত্র এক গ্রাম অতিরিক্ত সোডিয়াম খেলে একজিমার ঝুঁকি ২২ শতাংশ বেড়ে যায়। আধা চা-চামচ লবণের চেয়ে কম হওয়ায় এই পরিমাণ সোডিয়াম খুব কম বলে মনে হতে পারে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে যে এই পরিমাণও স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রমাণিত হতে পারে।গবেষকদের মতে, বাজারে চলতি বিভিন্ন ফাস্টফুডে নির্ধারিত সীমার থেকে বেশী পরিমাণ লবণ থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক।
আপনাদের অনেকের মনে প্রশ্ন থাকতে পারে, একজিমা কি? একজিমা একটি দীর্ঘস্থায়ী ত্বকের অবস্থা যার ফলে ত্বকের লালভাব সেই সাথে ত্বক শুষ্ক হয়ে যায় এবং ফুসকুড়ি দেখা দেয়, ফলে ত্বকে চুলকানি শুরু হয়। এই অবস্থাকে ‘এটোপিক ডার্মাটাইটিস’ও বলা হয়। পূর্ববর্তী গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে ত্বকে উপস্থিত অতিরিক্ত সোডিয়াম দীর্ঘমেয়াদী জ্বালা, প্রদাহ, একজিমা এবং অটোইমিউন সমস্যার কারণ হতে পারে। এটি লক্ষণীয় যে আমাদের শরীরকে রোগ থেকে রক্ষা করার কাজটি আমাদের ইমিউন সিস্টেম দ্বারা করা হয়। এটি আমাদের শরীরে প্রবেশকারী সমস্ত বিদেশী উপাদানগুলির সাথে লড়াই করে যা আমাদের জন্য ক্ষতিকারক।যদিও একজিমার সঠিক কারণ এখনও অজানা, তবে এটি বিশ্বাস করা হয় যে অত্যধিক লবণ গ্রহণ সহ কিছু খাদ্যতালিকাগত কারণগুলি এই অবস্থাকে খারাপের দিকে নিয়ে যেতে প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে।
কিন্তু যখন আমাদের নিজস্ব ইমিউন সিস্টেম শরীরের কোষকে আক্রমণ করে তখন এই ধরনের ব্যাধিকে অটোইমিউন ডিজিজ বলা হয়।গবেষণায় আরও বলা হয়েছে যে ফাস্ট ফুডের ঘন ঘন ব্যবহার শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে একজিমার ঝুঁকি এবং তীব্রতা বাড়িয়ে তুলতে পারে, কারণ এসব ফাস্ট ফুডে সোডিয়াম থাকে মাত্রাতিরিক্ত।গত কয়েক বছরে উন্নত দেশগুলোতে একজিমার সমস্যা খুবই সাধারণ হয়ে উঠছে। আমেরিকার অবস্থা এমন যে প্রতি দশম আমেরিকান জীবনের কোন না কোন সময় এই রোগের শিকার হচ্ছে। অনুমান করা হচ্ছে যে ৩০ মিলিয়নেরও বেশি আমেরিকান এই রোগে আক্রান্ত। বিজ্ঞানীদের মতে, পরিবেশ ও জীবনযাত্রা বিশেষ করে খাদ্যাভ্যাস এই রোগের ক্রমবর্ধমান ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে।
এই গবেষণায়, গবেষকরা ইউকে বায়োব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ২১৫,০০০ জনেরও বেশি লোকের ডেটা বিশ্লেষণ করেছেন। এর মধ্যে তার প্রস্রাবের নমুনা এবং মেডিকেল রেকর্ড অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সকল ব্যক্তির বয়স ছিল ৩০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে। তাদের প্রস্রাবের নমুনা থেকে জানা যায় তারা কতটা লবণ খাচ্ছেন। এছাড়াও, তারা ‘অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস’-এর শিকার কিনা এবং তাদের সমস্যা কতটা গুরুতর।এই বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে প্রস্রাবের নমুনায় উপস্থিত প্রতিটি অতিরিক্ত গ্রাম লবণের জন্য, একজিমা হওয়ার ঝুঁকি ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও, গবেষকরা ১৩,০০০ আমেরিকান প্রাপ্তবয়স্কদের উপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেছেন, যার ফলাফলে দেখা গেছে যে প্রতিদিন মাত্র এক গ্রাম অতিরিক্ত সোডিয়াম গ্রহণ করলে একজিমার ঝুঁকি ২২ শতাংশ বেড়ে যায়।
প্রতিদিন কত লবণ খাওয়া উচিত?
স্বাস্থ্য জার্নাল জামা ডার্মাটোলজিতে প্রকাশিত এই গবেষণার ফলাফলগুলি ইঙ্গিত দেয় যে খাদ্যতালিকায় সোডিয়াম গ্রহণ সীমিত করা একজিমা রোগীদের রোগ নিয়ন্ত্রণের একটি সহজ উপায় হতে পারে।সাধারণ ভাবে বলা হয়ে থাকে যে খাবারে কোনও কিছুর আধিক্য খারাপ, এটি লবণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আপনি যদি আপনার খাবারে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করেন তবে এটি আপনার স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) একজন ব্যক্তির কতটা লবণ খাওয়া উচিত সে বিষয়ে একটি নির্দেশিকা জারি করেছিল, যে অনুযায়ী একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির প্রতিদিন পাঁচ গ্রামের কম লবণ খাওয়া উচিত।
লবণে সোডিয়াম ক্লোরাইড থাকে। যা এক ধরনের খনিজ। এটি শরীরে জলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। WHO এর মতে, আমাদের প্রতিদিন দুই গ্রামের কম সোডিয়াম খাওয়া উচিত।ডব্লিউএইচওর মতে, খাবারে অতিরিক্ত সোডিয়ামের কারণে রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে। পরিসংখ্যান অনুসারে, বিশ্বব্যাপী অসংক্রামক রোগের মধ্যে প্রায় ৩২ শতাংশ মানুষের মৃত্যুর জন্য কার্ডিওভাসকুলার রোগ দায়ী। এছাড়াও অতিরিক্ত সোডিয়াম সেবন স্থূলতা, কিডনি সংক্রান্ত রোগ এবং গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের সাথে যুক্ত। প্রতি বছর বিশ্বে ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ অতিরিক্ত সোডিয়াম সেবনের কারণে প্রাণ হারাচ্ছেন।
এমতাবস্থায়, আমরা ভারতীয়রা যে লবণ খায় তা নিয়েও একটি বড় প্রশ্ন ওঠে। আমরা ভারতীয়রাও কি নির্ধারিত মানের চেয়ে বেশি লবণ খাই? এই প্রশ্নের উত্তর ICMR এবং AIIMS, দিল্লির গবেষকদের দ্বারা পরিচালিত একটি সমীক্ষায় প্রকাশ একজন গড় ভারতীয় নির্ধারিত মানগুলির চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি লবণ গ্রহণ করছেন।পুরুষদের কথা বললে, তারা এক্ষেত্রে মহিলাদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে, তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে ৭৮ শতাংশ বেশি লবণ খাচ্ছে। গবেষণা অনুসারে, একজন ভারতীয় গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৮ গ্রাম লবণ খান। যদি আমরা ভারতীয় পুরুষদের কথা বলি, তারা প্রতিদিন গড়ে ৮.৯ গ্রাম লবণ খান, যা নির্ধারিত মানগুলির চেয়ে প্রায় ৭৮ শতাংশ বেশি।
সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (সিএসই) তার গবেষণায় জাঙ্ক ফুড এবং টিনজাত খাবার সম্পর্কেও সতর্ক করেছিল। সিএসইর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ধরনের খাবার খেয়ে আমরা জেনে-বুঝে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং কিডনির সমস্যাগুলির সাথে নিজেকে যুক্ত করে দিচ্ছি।আমরা যেভাবে উন্নত দেশগুলির পথে, নিজেদের খাদ্য ও জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত করে তুলছি তাতে ভারতীয়দের মধ্যেও ফাস্টফুড এবং জাঙ্ক ফুডের প্রবণতা দ্রুত বাড়ছে তাতে ভারতকেও খুব দ্রুত এ ধরনের রোগের থেকে বাঁচার কথা ভাবতে হবে। ।
একজিমা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির ঝুঁকি কমাতে, আমাদের লবণ খাওয়ার বিষয়ে সচেতন হওয়া এবং লবণাক্ত খাবারের ব্যবহার সীমিত করার চেষ্টা করা গুরুত্বপূর্ণ।আমাদের যতটা সম্ভব তাজা, ভেষজ মশলা এবং অন্যান্য স্বাদযুক্ত খাবারের জন্য বেছে নেওয়া দরকার। আমাদের খাদ্যাভ্যাসে ছোটখাটো পরিবর্তন করে, আমরা আমাদের স্বাদ এবং স্বাস্থ্য উভয়কেই অতিরিক্ত লবণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করতে পারব।
আরও পড়ুন
জলবায়ু পরিবর্তন আমাজনের রেইনফরেস্টের কিছু অংশকে সাভানাতে রূপান্তরিত করতে পারে
উত্তরাপথঃ আমাজন রেইনফরেস্ট, যাকে "পৃথিবীর ফুসফুস" হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুত্তন্ত্র যা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।সম্প্রতি প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেসের বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে একটি নতুন তত্তের বর্ণনা করা হয়েছে ,সেখানে বলা হয়েছে কীভাবে বর্ষার মৌসুমে বিকল্প বন্যা এবং শুষ্ক মৌসুমে খরা, যাকে ডবল-স্ট্রেস বলা হয়, বন প্রতিষ্ঠাকে সীমিত করছে।উদ্বেগজনক গবেষণাতে আরও বলা হচ্ছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন-প্ররোচিত খরা আমাজন রেইনফরেস্টের কিছু অংশকে সাভানাতে রূপান্তরিত করতে পারে, যা জীববৈচিত্র্য এবং সামগ্রিকভাবে গ্রহের জন্য সম্ভাব্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি আনতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন
ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বাড়ছে বাংলাদেশে ইলিশের দাম, প্রভাব রাজ্যেও
উত্তরাপথঃ বাংলাদেশ ও ইলিশ এই দুটি নাম একে অপরের পরিপূরক মনে হলেও বাস্তব কিন্তু বলছে অন্য কথা। সূত্র মাধ্যমে পাওয়া খবরে জানা যাচ্ছে প্রকৃতির অপার দান হলেও শিকার থেকে শুরু করে বাজারজাত হওয়া পর্যন্ত ব্যয় বৃদ্ধির কারণেই বাড়ছে বাংলাদেশে ইলিশের দাম। এর সঙ্গে মধ্যস্বত্বভোগীদের লাভের অঙ্ক যোগ হয়ে তা চলে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।পরিস্থিতি এমন যে গরিব তো দূর থাক মধ্যবিত্তের পাতেও এখন আর জুটছে না ইলিশ। বুধবার বরিশালের পাইকারি বাজারে এক কেজি সাইজের ইলিশ বিক্রি হয় ৬০ হাজার টাকা মন দরে। ৪২ কেজিতে মন হিসাবে প্রতি কেজির দাম পড়ে প্রায় সাড়ে ১৪শ টাকা। খুচরা বাজারে গিয়ে যা বিক্রি হয় ১৬ থেকে ১৮শ টাকা। যে কারণে জাতীয় এই মাছ এখন শুধু বিত্তশালীদের খাদ্যে পরিণত হয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন
বিক্রম সারাভাই: ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার একজন দূরদর্শী পথিকৃৎ
উত্তরাপথঃ ডঃ বিক্রম সারাভাই ছিলেন ভারতের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী। তিনি একজন বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক, শিল্পপতি এবং স্বপ্নদর্শীর ভূমিকা সমন্বিত, ভারতীয় মহাকাশ কর্মসূচির জনক হিসাবে বিখ্যাত।তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় ভারত মহাকাশ অনুসন্ধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ISRO) এর প্রতিষ্ঠা ছিল তার অন্যতম সেরা সাফল্য। তিনি রাশিয়ান স্পুটনিক উৎক্ষেপণের পর ভারতের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য মহাকাশ কর্মসূচির গুরুত্ব সম্পর্কে সরকারকে সফলভাবে বোঝান।এরপর ডঃ হোমি জাহাঙ্গীর ভাভা, যিনি ভারতের পারমাণবিক বিজ্ঞান কর্মসূচির জনক হিসাবে পরিচিত, ভারতে প্রথম রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র স্থাপনে ডঃ সারাভাইকে সমর্থন করেছিলেন। .....বিস্তারিত পড়ুন
শারদোৎসবের প্রস্তুতি শুরু কলকাতা পুরসভা এবং বন্দর কতৃপক্ষের
উত্তরাপথঃ শারদোৎসবের প্রস্তুতি শুরু প্রশাসনের, প্রতিমা বিসর্জনে এ বার বিশেষ বন্দোবস্ত করছে কলকাতা পুরসভা।এ বছর ২১ অক্টোবর দুর্গা পুজা শুরু এবং ২৪ অক্টোবর বিজয়া দশমী। বিজয়া দশমীর পর আরও দু’দিন প্রতিমা বিসর্জন করা যাবে বলে প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে। তাই সেই প্রতিমা বিসর্জন পর্ব মসৃণ করতে কলকাতা বন্দর এবং পুরসভা কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে চলেছে। সোমবার কলকাতা পুরসভায় প্রাক্-পুজোর বৈঠকে পুরসভার বিভিন্ন বিভাগের আধিকারিকদের পাশাপাশি, ছিলেন কলকাতা পুলিশ, সিইএসসি-সহ একাধিক সরকারি দফতরের আধিকারিকেরা। .....বিস্তারিত পড়ুন