ড. জীবনকুমার সরকারঃ উত্তর রৈবিক যুগের এক অনন্য মাত্রার কবি জীবনানন্দ দাশ। রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কাব্যভুবনে এক দল কবি রবীন্দ্রআবহ ছেড়ে এবং পূর্বতন কাব্যধারার বাইরে দাঁড়িয়ে আধুনিক-প্রগতিশীল ও সাম্যবাদী কাব্য আন্দোলন শুরু করেন। একথা বাংলা সাহিত্যের পাঠক মাত্রই জানেন। সেটার বিস্তৃত ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন দেখি না। এখানে শুধু এটুকু বলার যে, এই আধুনিক কবিতা আন্দোলনের সেই সময়টা শুরু হয় বিশ শতকের তিরিশের দশক থেকে। আশ্চর্যের বিষয় এই আধুনিক কাব্য আন্দোলনের উত্তাপ জীবনানন্দকে গ্রাস করতে পারলো না। তাহলে কি তিনি আধুনিক নন? অবশ্যই আধুনিক। শুধু আধুনিক নন, আধুনিক কালের শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব হলো, রোমান্টিক মেদুরতায়। রোমান্টিক মেদুরতার আত্মমগ্ন কবি ছিলেন জীবনানন্দ দাশ। আবার প্রখর জীবন ও সময়বোধ ছিলো তাঁর। এই দুইয়ের যুগলবন্দি চেতনা তাঁকে নতুন কাব্যবয়ান নির্মাণে সাহায্য করেছিলো। ফলে প্রগতিশীল ও রক্ষণশীল দুই পক্ষই তাঁকে শাণিত আক্রমণে জর্জরিত করেছিলো। সে আক্রমণ কখনও কখনও ব্যক্তিগত পর্যায়েও দাঁড়িয়ে যেতো।
কাব্যচেতনায় বিভোর, কল্পনা প্রতিভায় অনন্য এবং আত্মনিমগ্ন কবি জীবনানন্দ প্রথম থেকেই সবার থেকে আলাদা হতে শুরু করেন। নানা সমালোচনার মুখে তাঁকে পড়তে হয়েছে। সবই হয়েছে তাঁর অভিনবত্ব কাব্যভাষার সৌজন্যে। বরিশালের নিসর্গে ইন্দ্রিয়তন্ময়তায় একের পর এক যেসব কবিতা সৃজন করেছেন তিনি, তা আমাদের বোধের জগতে নতুন সংকেত দিয়েছে। পারিবারিক স্বপ্নচেতনা, নৈতিক শুদ্ধতার বশবর্তী হবার ফলে তিনি হয়ে ওঠেন নিঃসঙ্গচারী এক পথিক। একটি শক্তিশালী মূল্যবোধ ও নীতিজ্ঞান নিয়ে জীবনকে এগিয়ে নিতে চাইতেন, যেটা তাঁর কাছে ঈশ্বরবোধের মতো হয়ে উঠেছিলো। আলাদা করে ঈশ্বরচিন্তা জীবনানন্দ দাশের ছিলো না। একবার অরবিন্দ গুহের সঙ্গে আলাপচারিতা করার সময় জীবনানন্দ দাশ জানাচ্ছেন — “ আমি ঈশ্বর বিশ্বাস করি না। আমি মানুষের নীতিবোধে বিশ্বাস করি।” ( সূত্র: জীবনানন্দ দাশ নির্জনতম বিভ্রান্তি, সুব্রত রাহা, উত্তরধ্বনি, শিলিগুড়ি, পৃষ্ঠা: ১২)
জীবনানন্দ দাশের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালে। প্রথম কবিতার কাব্যভাষা আর পরবর্তীকালের কাব্যভাষা আকাশপাতাল তফাত। প্রথম কবিতার কাব্যভাষায় নিজস্বতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে ১৯২৫ সালে ’কল্লোল’পত্রিকায় প্রকাশিত ’নীলিমা’ নামক কবিতায় প্রথম স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। আত্মপ্রকাশের স্বকীয় মুহূর্ত হিসেবে এই কবিতাটিকে মাইলস্টোন বলা যেতে পারে। একটু দেখা যাক কবিতাটির কাব্যভাষা:
“অগণন যাত্রিকের প্রাণ
খুঁজে মরে অনিবার, পায়নাকো পথের সন্ধান;
চরণে জড়ায়ে গেছে শাসনের কঠিন শৃঙ্খল;
হে নীলিমা নিষ্পলক, লক্ষ বিধি–বিধানের এই কারাতাল
তোমার ও মায়াদণ্ডে ভেঙেছো মায়াবী!
জনতার কোলাহলে একা বসে ভাবি
কোন দূর জাদুপুর–রহস্যের ইন্দ্রজাল মাখি
বাস্তবের রক্ততটে আসিলে একাকী;
লক্ষ কোটি মুমূর্ষুর এই কারাগার,
এই ধূলি — ধূম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার
ডুবে যায় নীলিমায় — স্বপ্নায়ত মুগ্ধ আঁখিপাতে,
শঙ্খশুভ্র মেঘপুঞ্জে, শুক্লাকাশে নক্ষত্রের রাতে;
ভেঙে যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক
তোমার চকিত স্পর্শে, হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক।”
( নীলিমা)
এরপর ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের প্রথম বাক্যগ্রন্থ ’ঝরা পালক’। এই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর জীবনানন্দ দাশ রবীন্দ্রনাথের নজরে আসেন বিশেষভাবে। রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ দাশের কবিতা পরে তাঁর কবিত্ব শক্তি নিয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করেন। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ’ধূসর পাণ্ডুলিপি’ প্রকাশের পর রবীন্দ্রনাথ এই কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিলেন, সেটা এখানে তুলে ধরা সমীচীন মনে করছি:
“তোমার কবিতাগুলি পড়ে খুশি হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।” ( উৎস: প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা: ১৩)
’তাকিয়ে দেখার আনন্দ’ কথাটি কিন্তু যথেষ্ঠ তাৎপর্যপূর্ণ। রবীন্দ্রবাচনের এই শব্দমোহে আটকে না থেকে ধূসর ’পাণ্ডুলিপি’র ’নগ্ন নির্জন হাত’ কবিতার কাছে আমরা আশ্রয় নিতে পারি:
“আবার আকাশে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠছে:
আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার।
যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে
অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি,
সেই নারীর মতো
ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠছে।
মনে হয় কোন বিলুপ্ত নগরীর কথা
সেই নগরীর এক ধূসর প্রাসাদের রূপ জাগে হৃদয়ে।
ভারতসমুদ্রের তীরে
কিংবা ভূমধ্যসাগরের কিনারে
অথবা টায়ার সিন্ধুর পারে
আজ নেই, কোনো এক নগরী ছিল একদিন,
কোন্ এক প্রাসাদ ছিল;…
ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনী,
অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা,
লুপ্ত নাশপাতির গন্ধ,
অজস্র হরিণ ও সিংহের ছালের ধূসর পাণ্ডুলিপি,
রামধনু রঙের কাচের জানালা,
ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায়…
পর্দায়, গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ,
রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ!
তোমার নগ্ন নির্জন হাত;
তোমার নগ্ন নির্জন হাত।”
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতার ভাষা, ছন্দ, চিত্রকল্প ও বোধ দেখেই উপর্যুক্ত মন্তব্যটি করেছিলেন। রূপ–লাবণ্যে ভরপুর তাঁর কবিতার দিকে তাকিয়ে থাকাটাই স্বাভাবিক। সমকালে না হলেও আজ গোটা বাংলার কন্যাভুবন তাঁর দিকে তাকিয়ে। বরং, সমকালে ছিলো অপরিসীম উপেক্ষা। 633
জীবনানন্দের কবিতার ঘ্রাণই আলাদা, যেখানে কেবল বাংলার নিজস্ব চিত্ররূপময় জীবনের আর প্রাণের ছড়াছড়ি। বাংলার বিচিত্র রূপ, মাঠঘাট, নদীনালা, খালবিল, পাখপাখালি আর রূপসী নারীকে তিনি কবিতায় এমন করে বিছিয়ে দিয়েছেন যে, বাংলা কবিতার যে কোনো মগ্ন পাঠক মুহূর্তেই রূপলোকের বাসিন্দা হয়ে ওঠেন :
“মেঠো চাঁদ
মেঠো চাঁদ রয়েছে তাকায়ে
আমার মুখের দিকে,— ডাইনে আর বাঁয়ে
পোড়ো জমি — খড়–নাড়া — মাঠের ফাটল,
শিশিরের জল!
মেঠো চাঁদ — কাস্তের মতো বাঁকা, চোখা —…
মেঠো চাঁদ বলে :
’আকাশের তলে
ক্ষেতে ক্ষেতে লাঙলের ধার…
একা —একা!— ডাইনে আর বাঁয়ে
খড়–নাড়া — পোড়ো জমি — মাঠের ফাটল,—
শিশিরের জল।”
(মাঠের ফসল)
আবহমান বাংলার স্নিগ্ধ–কোমল–সবুজ বনানীর আত্মমগ্ন সাধক না হলে নিসর্গের এমন চিত্র উচ্চারণ করা দূরূহ। বরিশাল সহ পূর্ব বাংলার নিবিড় মাঠঘাট, ক্ষেত, প্রান্তর, নদীর অনাবিল সৌন্দর্যে ললিতা ছিলো তাঁর মনোজগৎ। নিসর্গতন্ময়তায় আপ্লুত জীবনানন্দ আমাদের জন্য রেখে গেছেন একের পর এক এইসব কবিতা:
“যখন ক্ষেতের ধান ঝরে গেছে — ক্ষেতে ক্ষেতে পড়ে আছে খড়
আম বাঁশ ডুমুরের পাতাগুলো মাঠে মাঠে করে মর্মর
ফাল্গুন ঘাসের ঘ্রাণে ফড়িং এ জীবনের গন্ধ ভালোবাসে…
হলুদ–জর্দা–সাদা প্রজাপতি —হলুদ–জর্দা–নীল–লাল
দুপুরের মাঠে শুয়ে এই পল্লি— নিস্তব্ধতা — এই পোড়ো চাল —
ভূতুড়ে স্বপ্নের মতো ডালপালা — নীরব নরম দাঁড়কাক —
তেরছা ডানার ছায়া: চিল বুঝি? — লাল বনে শালিখের ঝাঁক —”
( যখন ক্ষেতের ধান ঝরে গেছে)
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় আবহমান বাংলার কত কী যে চোখে পড়ে তার ইয়ত্তা নেই। তাঁর কবিতার ভেতরে ঢুকলেই যেন থোকা থোকা রূপবতী বাংলাদেশ উঠে আসে। আমরা প্রবিষ্ট হই গভীর অনাবিল চিত্রকল্পের দেশে। ফলে আমাদের মননে ও পাঠকৃতিতে তৈরি হয়ে যায় অনায়াসে এক দুর্নিবার আকর্ষণ। কাব্যপাঠান্তে আমরা পৌঁছে যাই দুর্নিবার বাস্তব ও পরাবাস্তবের দ্বিবাচনিকতায়। এই প্রসঙ্গে আমরা তাঁর ’রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের সেই কবিতাটির উদ্দেশে যেতে পারি :
“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর: অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে
চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে বসে আছে
ভোরের দোয়েল পাখি — চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ
জাম–বট–কাঁঠালের–হিজলের– অশত্থের করে আছে চুপ;
ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে;
মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে
এমনই হিজল–বট–তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ
দেখেছিল; বেহুলার একদিন গাঙুরের জলে ভেলা নিয়ে —
কৃষ্ণা দ্বাদশীর জ্যোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চরায়—
সোনালী ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল, হায়,
শ্যামার নরম গান শুনেছিল— একদিন অমরায় গিয়ে
ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিলো ইন্দ্রের সভায়
বাংলার নদী মাঠ ভাটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিলো পায়।”
এই কবিতার ভাষা এবং বিষয় আধুনিক জীবনের জটিল অভিঘাত থেকে সরিয়ে নিসর্গের অফুরন্ত সংযোগের দিকে নিয়ে যান আমাদের। পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখের কথা কবি জানেন। তবু বাংলার লোকায়ত ঐতিহ্যই যেন কবির কাছে চিহ্নায়ক হিসেবে বারবার ফিরে এসেছে। তাছাড়া শেক্সপিয়রের মতো তাঁর লৌকিক জ্ঞানের পরিধি ছিলো যথেষ্ঠ প্রসারিত। বিদেশের বহু ফুল–পাখি–নদী–গাছপালা ইত্যাদির নাম জীবনানন্দের জানা ছিলো, সমকালীন কবিরা যা তাঁদের কবিতায় ব্যবহার করতেন। কিন্তু জীবনানন্দ এখানেই ব্যতিক্রম। সমকালের সকল সহ–কবিদের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত না করে সম্পূর্ণ দেশজচেতনায় আবহমান বাংলার ঐতিহ্য পুনর্নির্মাণ করে গেলেন।
তাঁর কবিতায় উল্লিখিত আবহমান বাংলার গাছপালার নামগুলো একটু দেখে নেওয়া যাক, নানা কবিতায় এসবের ব্যবহার আমাদের কাছে ভিন্ন স্বাদ ও আবহ সৃষ্টি করেছে। যেমন: অপরাজিতা, করবী, জামরুল, বট, সজনে, বেত, মাদার, আকন্দ, কাটাবাহর, পলাশ , ঝাউ, ডুমুর, চালতা, শেয়ালকাঁটা, হেলেঞ্চা, মধুকুপি ঘাস, কামরাঙা, আম,জাম,কাঁঠাল, আমলকি,শাল,পিয়াশাল, হিজল, নারকেল, অশ্বত্থ, দেবদারু, হরিতকি, সুপারি, নাটাফল, পরথুপি,বাসক ভেরেণ্ডা, লিচু, ফণীমনসা, কলমিশাক, নিম, শিরীষ, বাসমতী চাল, শিমুল, চালতা, বঁইচি, তাল,তমাল, মৌরী, চন্দ্রমল্লিকা, বেগুন, চোরকাঁটা, নাগেশ্বর ইত্যাদি। আবার যতসব পশুপাখি ও পতঙ্গের নাম পাওয়া যায়, তার সবই বাংলার গ্রামীণ অনুষঙ্গকে তুলে ধরে। যেমন: শালিক, কাঁচপোকা, হরিণ, সুদর্শন, নিমপাখি, শ্যামকল, লক্ষ্মীপেঁচা, সজারু, চিতল, দাঁড়কাক, গঙ্গাফড়িং, শ্যামাপোকা, শঙ্খচিল, চিল, দোয়েল, ঘুঘু, বক, হাঁস, বুনো হাঁস, চড়াই, গাঙচিল, গাঙ শালিক, মাছরাঙা, টিয়া,শ্যামা,তোতা,পায়রা, মনিয়া, নীলগাই,শম্বর,পাম, নীলকণ্ঠ,মাছি, কাঁচপোকা ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে আমরা একটি কবিতার উদহারণ আমরা দেখে নিতে পারি:
“কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে
সে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,
বলিল, তোমারে চাই :
বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি — কুয়াশার পাখনায় —
সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক
জোনাকির দেহ হতে — খুঁজেছি তোমারে সেইখানে —
ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে—
ধানসিড়ি বেয়ে বেয়ে
সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে
তোমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।…
কড়ির মতো সাদা মুখ তার,
দুইখানা হাত তার হিম;
চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম
চিতা জ্বলে: দখিন শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়
সে আগুনে হায়।”
(শঙ্খমালা)
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে, কবিতাটি আদ্যপান্ত একটি প্রেমের কবিতা। অথচ তার মধ্যেও ঢুকিয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন গাছপালা এবং পাখিদের নাম। সেসব দিয়ে সংযোগ স্থাপন করেছেন সময় ও ঐতিহ্যের পরিসরকে। প্রকৃতিচেতনায় বেশি মাত্রায় সংবেদনশীল ছিলেন বলে তাঁর কাব্যবয়ান এমন হলেও আমাদের বড়ো বিস্ময় লাগে কীভাবে এতো নিখুঁত বুননে তিনি কবিতা নির্মাণ করেছেন। ছোটো একটি কবিতা ’হায় ছিল’ কী অসাধারণ দ্যুতি নিয়ে আমাদের কাছে আজও সৌন্দর্যে মুখর করছে গোটা বাংলার আকাশ–বাতাস :
“ হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে!
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার তাহারে কেনো ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে
বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!
হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর উড়ে উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিড়ি নদীটির পাশে।”
বাঙালির প্রিয় বাসভূমি আজ ত্রিখণ্ডিত। তিন ভুবনে আজ তিন ধরনের জটিলতা এবং তিন ভুবনের সব বাঙালিই পরস্পরের প্রতি অনীহা,অশ্রদ্ধা, সন্দেহ, উপেক্ষা আর উদাসীনতা নিয়ে বেঁচে আছে। বাংলা ভাষার অনেক কবিদেরই আমারা এপার ওপার ভাগ করে নিয়েছি। বাঙালির প্রথম ভুবন বাংলাদেশে তবুও এখানকার কবিরা অনেকেই কলেজ– বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত। সে তুলনায় বাঙালির দ্বিতীয় ভুবন পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের অনেক ভালো কবিরা আবার ব্রাত্য। পশ্চিমবঙ্গের নতুন প্রজন্ম তাঁদের নামই জানে না। পশ্চিমবঙ্গে শুধু বাংলাদেশের কবিরা ব্রাত্য নন। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে, যেমন: আসাম, ত্রিপুরা, বিহার, আন্দামান, ঝাড়খণ্ড, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি, উড়িষ্যা ইত্যাদিকে বলা হয় তৃতীয় ভুবন; এই তৃতীয় ভুবনের বাঙালিরা কে কেমন কী লিখছেন — তার খবরও রাখতে অনীহা। এমনই এক নির্মম আত্মঘাতী পথ প্রসারিত করছি আমরা। জীবনানন্দ এই অধঃপতিত সময়ে টিকে আছেন কেবল লোকায়ত বাংলার ঐতিহ্য পুনর্নির্মাণ করে গেছেন বলে। না–হলে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের তুমুল উপাসনাকারী বাঙালিরা জীবনানন্দকেও ভাগাভাগি করে নিতেন।
আজ আমরা যেভাবে বিভাজিত সময়ের বাসিন্দা হিসেবে নিজেদের দাঁড় করিয়েছি, কৃত্রিম সত্য বাস্তব সত্যকে দখল করে নিয়েছে। ফলে আজ শিল্প–সাহিত্য–সংস্কৃতির নামে সময় শাসন করছে অপজগতের বাসিন্দারা। এইজন্য কি জীবনানন্দ ’অদ্ভুত আঁধার এক’ নামক কবিতায় এই সময়ের প্রবল দহন থেকে রক্ষা পেতে এমন কাব্যিক উচ্চারণে আমাদের সংকেত দিয়েছেন:
“অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই —
প্রীতি নেই — করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।”1719
এই সময়ে দাঁড়িয়ে ভাবি, এই কবিতাটি কত অমোঘ সত্যের উপস্থাপন করছে! আসলে জীবনানন্দ তো রূপসী বাংলার ক্ষত–বিক্ষত চেহারা দেখে গেছেন। বাঙালিরা কীভাবে আত্মহননে হিন্দু–মুসলমান পরিচয়কে বড়ো করে তিন হাজার বছরের ইতিহাসকে মুছে দিলো মাত্র কয়েক বছরের আত্মপ্রতারক উদ্যমে। বাঙালির মতো আত্মহন্তরক জাতি এই পৃথিবীতে নেই। বাঙালি আজও যেভাবে তার সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ও ভাষিক সত্তা ছেড়ে অপজগতের সাধনায় মত্ত হয়ে উঠেছে, তাতে সন্দেহ হয় জীবনানন্দের মতো কবিকেও না একদিন কৃষ্ণবিবরে টেনে নেয়। উৎকেন্দ্রিক সময়ের বিরুদ্ধে আমাদের চেতনার সূর্য জেগে থাক। বাংলার তিন ভুবনের পথে–ঘাটে–মাঠে–নদী–নালায়–খালেবিলে জীবনানন্দ অনেকার্থদ্যোতনা নিয়ে বেঁচে থাক। হে কবি, আবার আসুন ফিরে — এই ভাঙা বাংলার তীরে, আমাদের বাঙালি করতে; আমাদের মানুষ করতে।
আরও পড়ুন
তৃণমূলের রাজ্যসভা প্রার্থী
উত্তরাপথ: রাজ্যসভার প্রার্থী অবশেষে ঘোষণা করল শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস।আগামী ২৪ জুলাই রাজ্যসভা নির্বাচন। আজ ৬ প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে দিলো দল । এরা হলেন সুখেন্দুশেখর রায়,ডেরেক ও’ব্রায়েনও দোলা সেন।এরা গত রাজ্যসভা নির্বাচনেও প্রার্থী হয়েছিলেন। এই ৩ জন যে পুনরায় টিকিট পাবেন তা নিয়ে কোন দ্বিমত ছিল না । জল্পনা চলছিল বাকি ৩ টি আসনে তৃণমূল কাদের পাঠাবে সেই নিয়ে। বাকি ৩ টি আসনের জন্য প্রার্থী করা হয়েছে সমিরুল ইসলাম, প্রকাশ চিক বরাইক এবং সাকেত গোখলেকে। তৃণমূল কংগ্রেস শান্তা ছেত্রী এবং সুস্মিতা দেবের জায়গায় .....বিস্তারিত পড়ুন
Sustainable Energy: সূর্যের আলো এবং বায়ু,থেকে বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড-ব্রেকিং বৃদ্ধি
উত্তরাপথ: সম্প্রতি একটি রিপোর্ট সামনে এসেছে তাতে সূর্যের আলো এবং বায়ু,থেকে সারা বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড-ব্রেকিং বৃদ্ধি ১২% উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। এই পুনর্নবীকরণযোগ্য সম্পদের ব্যবহার আমাদের অ নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারের বিকল্পের দিকে ক্রমবর্ধমান বিশ্বব্যাপী পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করছে। সৌর এবং বায়ু শক্তির ব্যবহারের দ্রুত বৃদ্ধি বিভিন্ন কারণ দ্বারা চালিত হয়েছে। প্রথমত, প্রযুক্তির অগ্রগতি পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ এবং সাশ্রয়ী করে তুলেছে। সৌর প্যানেল এবং বায়ু টারবাইনগুলি এখন আগের চেয়ে আরও দক্ষতার সাথে সূর্য এবং বায়ু থেকে শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম, যার ফলে বিশ্বব্যাপী পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উৎপাদন বৃদ্ধি .....বিস্তারিত পড়ুন
জোছনা রাতে
অসীম পাঠক: পূর্ণিমার মায়াবী চাঁদের আলোয় বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস। পুরুলিয়ার পান্ডব বর্জিত এক গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে গ্রামের শৌখিন যাত্রার আসরে পঙ্গপালের মতো ছুটে চলেছে সব মানুষজন। গোপালপুরে যাত্রা তাও আবার ঐতিহাসিক পালা। ঝলমলে পোশাকের মেলা আর গ্রাম্য বিনোদনের এক অফুরন্ত ভান্ডার, সাথে মেলা জুয়ার আসর, দেশী মহুয়ার চনমনে নেশা। কাঁচের গ্লাসে ফেনায়িত মদ আর ঝালঝাল চাখনা ছোলা মটর বাদাম। আহা রে- জিভ চকচক করে হরিপদর। বেশ রসিক মানুষ হরিপদ কর্মকার, তার রসের ভান্ডারে কতো বিচিত্র অভিজ্ঞতা র গল্প। নাম করা গুনীন, সাপের বিষ না .....বিস্তারিত পড়ুন
Gond Tribe: মধ্য প্রদেশে গোন্ড উপজাতির সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ
গার্গী আগরওয়ালা মাহাতো: গোন্ড উপজাতি(Gond tribe) বিশ্বের বৃহত্তম উপজাতি গোষ্ঠীগুলির মধ্যে একটি। এটি ভারতের বৃহত্তম উপজাতি । এদের গায়ের রং কালো, চুল কালো, ঠোঁট মোটা, নাক বড় ও ছড়ানো। তারা অলিখিত ভাষা গোন্ডি ভাষাতে কথা বলে, যা দ্রাবিড় ভাষার সাথে সম্পর্কিত। গোন্ড উপজাতির একটি দীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে, বিশ্বাস করা হয় যে তাদের শিকড় প্রাক-আর্য যুগে্র । গোন্ডদের সবচেয়ে গৌরবময় রাজা ছিলেন সংগ্রাম শাহ এবং দলগত শাহ, যারা ম্ধ্যপ্রদেশের গন্ডয়ানা রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকায় অনেকগুলি দুর্গ তৈরি করেছিলেন। মাত্র ৩০ বছর বয়সে দলগত .....বিস্তারিত পড়ুন