তিন “C” এর শহর তালসেরি

তালসেরি ভারতের কেরালায় তিন C এর শহর ছবি – উত্তরাপথ

প্রিয়াঙ্কা দত্তঃ ভারতের কেরালায় আছে ‘ City of 3C s ‘ বা তিন C এর শহর। জানা আছে, এই তিন C আসলে কি? এরা হলো ক্রিকেট, কেক আর সার্কাস (Cricket Cake and Circus) । এই তিন তিনটি বিষয়েই প্রথম স্থান অর্জনের লেবেল সেঁটে বসে আছে যে শহর, তার নাম তালসেরি (পূর্ব নাম তেলিচেরি)। মালাবার উপকূলে অবস্থিত এই বন্দর শহরটির ঝুলিতে আছে আরও অনেক রকম তকমা। এটি হলো কেরালায় একমাত্র ও প্রথম হেরিটেজ শহর।আসুন শিক্ষা, সংস্কৃতি ও শিল্পে সমৃদ্ধ এই শহরটির অন্দরে প্রবেশ করি।

আরব সাগরের তীরে এই শহরটি গড়ে ওঠে আনুমানিক ১৬৮৩ সালে। ভারতীয় মশলা রপ্তানীর জন্য এই তেলিচেরী তেই প্রথম ঘাঁটি গেড়ে বসে ইংরেজরা। যার নিদর্শন স্বরূপ শতাব্দী প্রাচীন একটি দূর্গ আছে এখানে। যা প্রথমে মশলা সংরক্ষণের জন্য গুদামের কাজ করলেও পরে ঔপনিবেশিক শাসনের কেন্দ্র হিসেবে ও কাজ করছে। ফরাসী, পর্তুগিজ, ব্রিটিশ এর মত বিভিন্ন  জাতির সংস্কৃতিক মেলবন্ধন এই শহরকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলেছে ।

এবার আসা যাক, Three C এর প্রথম C ক্রিকেট প্রসঙ্গে। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ওয়েলিংটনের প্রথম ডিউক আর্থার ওয়েলেসলি এই শহরে আসেন এবং এখানকার মাঠে তার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে প্রথম ক্রিকেট খেলেন । অর্থাৎ ভারতবর্ষের অধুনা জনপ্রিয়তম খেলার গৌরচন্দ্রিকা হয় এই তালসেরি শহরেই। ধীরে ধীরে এই খেলা ভারতের মাটিতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং ১৮৩০ সালে এখানে স্থানীয় তালসেরি  ক্রিকেট ক্লাব তৈরি হয়। ১৮৫০ সালে এখানে ভারতের প্রথম ক্রিকেট ক্লাবও (টাউন ক্রিকেট ক্লাব) তৈরি করেন ওয়েলেসলি। ১৯৩০ সালের মধ্যে শহরটি হয়ে ওঠে ক্রিকেটের অন্যতম পীঠস্থান। প্রায়শঃ এখানে রঞ্জি ট্রফির বিভিন্ন ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়।

দ্বিতীয়ত আসা যাক 2nd C অর্থাৎ কেক প্রসঙ্গে। এই শহরেই তৈরী হয় ভারতের প্রথম  ‘ ক্রিসমাস কেক ‘ তাও আবার সম্পূর্ন দেশী পদ্ধতিতে। এর পিছনে অবদান রয়েছে ভারতের অন্যতম বেকারি ব্যবসায়ী মামবলি বাপুর। ১৮৮০ সালে তালসেরি শহরে  বাপু প্রথম তার বেকারি কারখানা ‘ ব্রিক ওভেন বেকারি’ খোলেন। তিনি বার্মায় থাকাকালীন বিস্কুট তৈরির কৌশল শেখেন আর তা প্রয়োগ করেন তাঁর রয়াল বিস্কুট কারখানায়। খুব দ্রুত তার বিস্কুট জনপ্রিয়তা লাভ করে । বাপু প্রায় চল্লিশ ধরনের বিস্কুট, রাস্ক, পাউরুটি, বান প্রভৃতির উৎপাদন শুরু করেন। এরপর ১৮৮৩ সালে ক্রিসমাসের পূর্বে এক ইংরেজ বাগান মালিক মিস্টার মারডক ব্রাউন বাপুর বেকারিতে আসেন । তিনি ব্রিটেনের তৈরি একখানা কেক মামবলি বাপু কে চাখিয়ে দেখান আর ওই ধরনের কেক তৈরির অর্ডার দেন । ব্রাউন সাহেব বাপুকে মাত্র ১০ মিনিটে কেক তৈরির কৌশলের বুঝিয়ে দিয়ে তাঁর হাতে তুলে দেন পাম কেক বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় ড্রাই ফ্রুটস আর ফরাসি রাম। বাপু কিন্তু এখানেই থেমে যাননি।সেই রেসিপিতে তিনি দিয়েছিলেন দেশি তরকা। কেকের ডো তে বাপু মেশান দারুচিনি, লবঙ্গ, বাদাম। আর মেশান স্থানীয় আরক। 20 ডিসেম্বর বাপুর এই অসাধারণ সৃষ্টি টি সাহেবকে পরিবেশন করেন। আর তা খেয়ে সাহেবের দিল খুশ হয়ে যায় । তিনি দরাজ সার্টিফিকেট দেন বাপুকে। তারপর থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি । অচিরেই তালসেরি কেক তৈরির মক্কাতে পরিণত হয়। ১৪২ বছর অতিক্রান্ত ।তবু মামবলি কেকের স্বাদ আজও একই রয়ে গেছে । কারণ সেই পুরনো পদ্ধতিই এখনো অনুসরণ করা হয় । পরবর্তি সময়ে বাপুর উত্তরসূরী মামবলি গোপালিনের উদ্যোগে এই কেক বিদেশ রপ্তানি শুরু হয়।

এবার আসি তৃতীয় C অর্থাৎ সার্কাস এর কথায়। তলসেরি শহরেই শুরু হয় ভারতের প্রথম সার্কাস ট্রেনিং স্কুল। হ্যাঁ এখানেই প্রথাগত ভাবে সার্কাসের বিভিন্ন কলা কৌশল ও জিমন্যাস্টিক বা অস্ত্রশস্ত্র শিক্ষা দেওয়া শুরু হয়। এর পিছনে মূল হোতা ছিলেন কেনেরি কুন্থি কানন নামে এক ব্যক্তি। ভারতের সার্কাস কোম্পানির জনক বিষ্ণু পন্থ ছত্রে একবার তালসেরিতে শো করতে আসেন। তখন তিনি দেখেন সেখানে কেলেরির উদ্যোগে স্থানীয় ছেলেরা কালারিপায়াত্তুর  মতো অস্ত্র বিদ্যা অনুশীলন করছেন। সেই দেখে তিনি অনুপ্রাণিত হন এবং তাঁর  সার্কাসের কলাকুশলীদের তা শিখিয়ে দেবার অনুরোধ করেন ।এভাবে শুরু হয় সার্কাসের ট্রেনিং প্রথা। ১৯০১ সালে স্থানীয় কালারিপায়াত্তু  শিল্পীদের নিয়ে কেলেরির উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল ভারতের প্রথম সার্কাস একাডেমি, এই তেলিসেরি শহরে। যার নাম ছিল ‘অল ইন্ডিয়া সার্কাস ট্রেনিং হল’। ধীরে ধীরে এর কলেবর বৃদ্ধি পায়।এখানে বহু বিখ্যাত সার্কাস কলাকুশলীদের নবজন্ম হয়। যারা পরবর্তীকালে আরো নতুন নতুন সার্কাস সংস্থা নির্মাণ করেন। যেমন গ্রেট লায়ন সার্কাস, ফেরারি সার্কাস , গ্রেট বম্বে সার্কাস ইত্যাদি । এমন কি বিখ্যাত জেমিনি সর্কাসের জনক জেমিনি শঙ্করনও এই স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, ভারতের এমন একটি সম্পদ এখন অর্থ ও সরকারি সাহায্যের অভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। আগ্রহী ছাত্র ছাত্রীর অভাব না থাকলেও সঠিক উদ্যোগের অভাবে এই একাডেমি বন্ধ হয়ে পড়ছে।

যাই হোক,ভারতের প্যারিস নামে পরিচিত এই ছোট্ট শহরটি সমৃদ্ধির যে অসাধারণ নিদর্শন রেখেছে তা এক কথায় অতুলনীয়। এখানকার বিরিয়ানী ও একডাকে এখন সবাই চেনেন। এখানে আছে প্রাচীন শিল্প ও স্থাপত্যের বিস্ময়কর সব নিদর্শন। সঙ্গে আরও অনেক অজানা ইতহাস। তাই কেরল ভ্রমণে গেলে অবশ্যই ঘুরে আসবেন তালসেরি।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Electoral Bond এর গোপনীয়তা সরিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে, জানাতে হবে প্রাপ্ত অনুদানের পরিমাণ

উত্তরাপথঃ বুধবার, নির্বাচনী বন্ড (Electoral Bond)প্রকল্পের আইনি বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের শুনানি হয়। শীর্ষ আদালত তার মন্তব্যে বলেছে, 'নির্বাচনী বন্ডগুলি রাজনৈতিক দলগুলিকে বেনামী অর্থ প্রদান করে, কারণ তাদের কেনাকাটা সম্পর্কিত রেকর্ডগুলি স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কাছে উপলব্ধ যা শুধুমাত্র তদন্তকারী সংস্থাগুলি অ্যাক্সেস করতে পারে৷ এর আগে নির্বাচনী বন্ড’ (Electoral Bond) সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টে (Supreme Court) কেন্দ্র দাবি করেছিল, রাজনৈতিক দলগুলির আয়ের উৎস জানার অধিকার নেই জনতার।এবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তৎপর হল নির্বাচন কমিশন (Election Commission of India)।বুধবার বিকেল ৫টার মধ্যে যাবতীয় হিসেব জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কমিশনের তরফে।নির্বাচনী বন্ডের (Electoral Bond)মামলায় কেন্দ্রের আর্জি সত্বেও সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক দলগুলিকে আয়ের উৎস জানাতে বলেছিল। আদলত নির্দেশ দিয়েছিল, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক দল কত অনুদান মিলেছে, সেই তথ্য বন্ধ খামে জানাতে হবে।এর আগেও নির্বাচনী বন্ডের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একাধিক মামলা হয়েছে শীর্ষ আদালতে। মামলাকারীরা অভিযোগ করেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলি এই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ বিদেশ থেকে পেতে পারে এর ফলে গণতন্ত্র ধ্বংস হবে। যদিও কোনও রাজনৈতিক দলই এই দাবি মানতে চায়নি। ৩ অক্টোবর মামলার শুনানিতে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সব তথ্য দিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এই রায়ের পরেই তৎপর হল কমিশন। .....বিস্তারিত পড়ুন

সেলফির উচ্চ রেটিং কি আপনাকে আরওপাতলা হতে উৎসাহিত করছে ?

উত্তরাপথঃ সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে সেলফি তোলা এবং নিজেকে পাতলা হিসাবে দেখানোর মধ্যে একটি সম্পর্ক থাকতে পারে। যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক সেন্ট জন ইউনিভার্সিটির রুথ নাইট এবং ইউনিভার্সিটি অফ ইয়র্কের ক্যাথরিন প্রেস্টন সম্প্রতি PLOS ONE জার্নালে তাদের ফলাফল প্রকাশ করেছেন।সেখানে সেলফির উচ্চ রেটিং এবং আমাদের শরীরের গঠনের মধ্যে যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।    বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ায় সেলফি হল এক জনপ্রিয় ছবি দেওয়ার ধরন। যিনি সেলফি তোলেন তিনি ক্যামেরাকে তাদের শরীর থেকে দূরে রেখে নিজেই নিজের ছবি তোলে। আগের গবেষণায় বলা হয়েছে সেলফিগুলি দেখার ফলে ছবির বিষয়গুলি সম্পর্কে দর্শকদের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন

সম্পাদকীয়-  রাজনৈতিক সহিংসতা ও আমাদের গণতন্ত্র

সেই দিনগুলো চলে গেছে যখন নেতারা তাদের প্রতিপক্ষকেও সম্মান করতেন। শাসক দলের নেতারা তাদের বিরোধী দলের নেতাদের কথা ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন।  আজ রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে।  কেউ কারো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়।  আগ্রাসন যেন রাজনীতির অঙ্গ হয়ে গেছে।  রাজনৈতিক কর্মীরা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খুন বা মানুষ মারার মত অবস্থার দিকে ঝুঁকছে। আমাদের দেশে যেন রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না।আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে বেশি মানুষ নিহত হচ্ছেন।  ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) অনুসারে, ২০১৪ সালে, রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৪০০ জন প্রাণ হারিয়েছিল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২০০০ জন মারা গিয়েছিল।  আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য গর্বিত হতে পারি, কিন্তু এটা সত্য যে আমাদের সিস্টেমে অনেক মৌলিক সমস্যা রয়েছে যা আমাদের গণতন্ত্রের শিকড়কে গ্রাস করছে, যার জন্য সময়মতো সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Vijay Stambh : চিতোরগড় দুর্গে বিজয় স্তম্ভ হিন্দু – মুসলিম সহাবস্থানের প্রতীক

উত্তরাপথঃ খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে মৌর্য রাজবংশ কর্তৃক স্থাপিত চিতোরগড় দুর্গ সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গ তার বিশাল কাঠামো, রাজপ্রাসাদ, একাধিক  সুদৃশ্য মন্দির সহ সুন্দর জলাশয়ের জন্য বিখ্যাত।৭০০-একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এই দুর্গটিতে প্রায় ৬৫টি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে যা রাজপুত এবং ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীর সূক্ষ্মতার প্রমান দেয়। বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh)) হল এই দুর্গে অবস্থিত,সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কাঠামো।এই আশ্চর্য-অনুপ্রেরণামূলক স্তম্ভটি কেবল তার উচ্চতার জন্য বিখ্যাত নয়,এটি রাজপুতদের অদম্য সাহস এবং অধ্যবসায়ের গল্পও বলে যা চিতোরগড় দুর্গেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে।বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh), নাম থেকে বোঝা যায়, বিজয়ের প্রতীক।  প্রাচীনকালে যে কোনো যুদ্ধ অভিযানের সাফল্যের পর সেই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে রাজারা মন্দির, স্তূপ, স্মৃতিস্তম্ভ ও স্তম্ভ নির্মাণ করতেন।  ৯ তলা এই বিজয় স্তম্ভটি ১৯৪০ থেকে ১৪৪৮ সালের মধ্যে মহারানা কুম্ভ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top