ছৌশিল্পী পদ্মশ্রী নেপাল মাহতো ও বিশ্ব মঞ্চে ভারতের লোকনৃত্য

পদ্মশ্রী নেপাল মাহতো ও ছৌনৃত্য দল

গার্গী আগরওয়ালা মাহাতোঃ আমাদের চারিদিকে বিশ্ব দ্রুত বিকশিত হচ্ছে,পরিবর্তিত হচ্ছে শিল্প সাধনার প্রকৃতি। এই পরিবর্তিত শিল্প সাধনার যুগে আমাদের সেই সমস্ত ব্যক্তিদের স্বীকৃতি দেওয়া এবং সম্মান করা অপরিহার্য যারা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রচারে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এমনই একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন ছৌশিল্পী পদ্মশ্রী নেপাল মাহতো নেপাল মাহাতো, যার ছৌনৃত্যের জগতে  দেশে ও বিদেশে অতুলনীয় অবদান তাকে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘পদ্মশ্রী´এনে দিয়েছে।

পদ্মশ্রী নেপাল মাহতোর জন্ম ১৭ জুন ১৯৫৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার বরাবাজার থানার আদাবনা নামে একটি ছোট গ্রামে। তার পিতা স্বর্গীয় নগেন্দ্রনাথ মাহাতো ও মাতা তুষ্ট মাহাতো। তিনি তাদের পঞ্চম সন্তান ছিলেন । জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করলেও তিনি তাঁর পারিবারিক পেশার বাইরে সঙ্গীত চর্চাতে বেশী আগ্রহী ছিলেন।তিনি অল্প বয়সে তার কাকার থেকে সঙ্গীত চর্চার প্রথম অনুপ্রেরনা পান সেই সময় তিনি ঝুমুর গান করতেন।এরপর তিনি ছৌ সম্রাট পদ্মশ্রী গম্ভীর সিংমুড়ার কাছ থেকে ছৌনৃত্যের প্রশিক্ষণ নেন।

পদ্মশ্রী নেপাল মাহতো

নেপাল মাহাতো প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন আদাবনা গ্রামে,এরপর তিনি কাণ্টাডি উচ্চবিদ্যালয়ে পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণী পড়াশুনা করেন।এর মাঝে মাত্র দশ বছর বয়সে তাঁর ছৌনাচে প্রথম হাতে খড়ি হয় ছৌওস্তাদ অনিল মাহাতোর তত্বাবধানে।এরপর তিনি ধীরে ধীরে ছৌ, নাচনী,ঝুমুর এবং বাই নাচের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ান। ছৌনৃত্য অনুশীলনের সময় তিনি  ছৌওস্তাদ অনিল মাহাতোর দলের সাথে বেশ কিছু অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করেন এবং একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত নাচনি শিল্পী সিন্ধুবালা দেবীর সাথে ঝুমুরের বিভিন্ন অনুষ্ঠান করেন।   

পদ্মশ্রী নেপাল মাহতো

তিনি পড়াশুনার পাশাপাশি যথেষ্ট যত্ন সহকারে ছৌনাচের অনুশীলন করতেন ।১৯৭১-৭২ সালে কান্টাডি উচ্চ বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতায় তিনি ঝুমুর পরিবেশন করেন।সেখানে তিনি তাঁর প্রাণবন্ত কন্ঠস্বর এবং হৃদয়গ্রাহী পরিবেশনার মাধ্যমে, শ্রোতাদের বিমোহিত করেন।এরপর বিদ্যালয়ের সম্পাদক অজিত মিত্র, যিনি ছৌ, ঝুমুর ইত্যাদির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, তিনি সেই সময় নেপাল মাহাতোকে প্রশ্ন করেন যে সে আর কি করে? নেপাল মাহাতো অজিত মিত্রকে জানায় সে ছৌনাচও করে। এরপর অজিত মিত্র নেপাল মাহাতোকে তাঁর নিজের ছৌনাচের দল গঠনের জন্য উৎসাহিত করেন।নেপাল মাহাতো সেই সময় নবম শ্রেনীর ছাত্র, তিনি গ্রামের কিছু যুবকদের সঙ্গে নিয়ে তাঁর প্রথম ছৌনাচের দল গঠন করেন এবং শিক্ষা গুরু হিসেবে নিয়ে আসেন চডিদা থেকে পদ্মশ্রী গম্ভীর সিংমুড়াকে। সেখানে একমাস থেকে পুরো দলটিকে গম্ভীর সিংমুড়া প্রশিক্ষণ দেন।

পদ্মশ্রী নেপাল মাহতোর ছৌনাচের দল

সেই সময় থেকেই নেপাল মাহাতোর শৈল্পিক যাত্রা ধীরে ধীরে শুরু হয় বিভিন্ন গ্রামে বিভিন্ন ছোট- বড় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।১৯৮০ সাল নাগাদ অজিত মিত্রের সহযোগিতায় পূজার সময় কলকাতার ডাইমণ্ড হারবারে একটি অনুষ্ঠান করেন এবং বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। সেই সময় Indian Council for Coultural Relation থেকে কে এস মাথুর নেপাল মাহাতোকে প্রথম ১৯৮২ সালে লন্ডন-এ রয়্যাল ক্লাবে রানী Elizabeth এর সামনে অনুষ্ঠান করার সুযোগ করা দেন। সেখানে রানী Elizabeth তাঁর নৃত্য দক্ষতায় খুশী হয়ে ভারত সরকারকে বলেন তাঁকে ভারতের কোনও বড় সাংস্কৃতিক পুরস্কার দেওয়ার জন্য । রানী Elizabeth এর সুপারিশে ১৯৮৩ সালে তিনি ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘পদ্মশ্রী´পান।

পদ্মশ্রী পুরষ্কার

১৯৮৫ সালে ছোটনাগপুর নৃত্য অনুষ্ঠানে তিনি প্রথম পুরস্কার পান।সেই সময় তিনি দেশের বাইরে বিভিন্ন স্থানে যান অনুষ্ঠান করতে। ১৯৮৬ সালে তিনি ৯০ দিনের জন্য আমেরিকা যান। ১৯৮৭ সালে ৬০ দিনের জন্য সুইডেন যান ,১৯৮৯ সালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠান করেন। এরপর থাইল্যান্ড ,কানাড়া,লন্ডন এবং ২০১৫ সালে শেষবারের জন্য রাশিয়া যান। ১৯৯৪ সালে তিনি আম্বেদকর স্কলারশিপ পান।

নেপাল মাহাতোকে যা আলাদা করে তা কেবল একজন লোকশিল্পী হিসেবে তার প্রতিভা নয়, ছৌনৃত্য শিক্ষার প্রতি তার আন্তরিকতা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।তিনি ২০১৪ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত CCRT এর কোর কমিটির সদস্য ছিলেন। এই কমিটির কাজ ছৌশিল্পের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের স্কলারশিপ প্রদান করা। এছাড়াও তিনি ছৌনাচের একটি স্বীকৃত সার্টিফিকেট কোর্স যা সিধু কানু বিরসা মুন্ডা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় তাঁর সিলেবাস তিনি তৈরি করেন।

২০১৯ সালে নেপাল মাহাতোর মৃত্যুর পর তাঁর তৈরি ছৌনৃত্যের দল আদাবনা তরুণ সঙ্ঘ ছৌ ডান্স একাডেমীকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর দুই পুত্র সুব্রত মাহাতো ও সৌগত মাহাতো।নেপাল মাহাতোর পাশে থেকে যে মানুষটি তাঁকে সারা জীবন সব কাজে উৎসাহ এবং সহযোগিতা করলেন তিনি তাঁর স্ত্রী রানী মাহাতো ।

ছৌনাচের বিশেষ মুহূর্ত

আগামীদিনে ছৌশিল্পী পদ্মশ্রী নেপাল মাহতো’র অবদানগুলি একটি অনুস্মারক হিসাবে কাজ করবে, যে আমাদের ঐতিহ্য এবং রীতিনীতিগুলি অতীতের ধ্বংসাবশেষ নয় বরং জীবন্ত ধন যা লালন এবং উদযাপনের যোগ্য।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


বিশ্বকাপ ২০২৩: পাকিস্তানকে হারিয়ে Afghanistan এ ঈদের মতো পরিস্থিতি

আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০২৩-এর ২২ তম ম্যাচে আফগানিস্তান পাকিস্তানকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছে। সেই ম্যাচে পাকিস্তানকে ৮ উইকেটে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে আফগানিস্তান। এই প্রথম ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে হারাল আফগানিস্তান আর এই পাকিস্তানকে হারিয়ে আফগানিস্থানে(Afghanistan)এখন ঈদের মতো পরিস্থিতি।এক আফগানিস্থানি সমর্থকের মতে এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এবং নিজেদের মত করে তারা তাদের এই খুশী উদযাপন করেছেন। এক্স হ্যান্ডেলে এক সমর্থকের মতে, সেদিন উদযাপন ছিল, পার্টি ছিল। এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এছাড়াও, এটি ছিল ২০২৩ বিশ্বকাপের তৃতীয় বড় আপসেট । টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় বাবর আজমের দল। প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান দল ২৮২ রান করে। জবাবে আফগানিস্তান দল ২৮৩ রান তাড়া করে ৪৯ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্য অর্জন করে। এই ম্যাচে হারের পর বেশ ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল অধিনায়ক বাবর আজমকে। ম্যাচ-পরবর্তী উপস্থাপনার সময়, তিনি দলের ত্রুটিগুলি তালিকাভুক্ত করেছিলেন এবং পরাজয়ের জন্য নিজেদের দায়ী করেছিলেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Fried rice syndrome: আগের দিনের রান্না করা ভাত খেলে হতে পারে এই বিশেষ অসুখটি

উত্তরাপথঃ আপনার কি বাসী ভাত বা পান্তা খাওয়ার অভ্যেস আছে? সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম (Fried rice syndrome) নিয়ে আমরা প্রায়ই অবশিষ্ট খাবার গরম করে আবার খাই। কিন্তু জানেন কি এই অভ্যাস আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। অনেক সময় পর আগের রান্না করা  ভাত খাওয়ার ফলে পেট সংক্রান্ত সমস্যা হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে খাবার পুনরায় গরম করলে এতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, কিন্তু তা নয়। যে খাবারেই স্টার্চ থাকে না কেন, এতে উপস্থিত টক্সিন তাপ প্রতিরোধী। অর্থাৎ খাবার গরম করার পরও ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয় না। ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম নামে এই সমস্যা সম্পর্কিত একটি অবস্থা রয়েছে। আজ আমরা এই ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম অবস্থার লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। ভাত রান্না করার পর, যখন অবশিষ্ট ভাত কয়েক ঘন্টা বা সারারাত ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয় এবং তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে শুরু করে, তখন এই অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম। .....বিস্তারিত পড়ুন

ফ্লিম রিভিউ -ওপেনহাইমার

উত্তরাপথ: বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান দ্বারা পরিচালিত”ওপেনহাইমার” একটি মাস্টারপিস মুভি। ছবিতে জে. রবার্ট ওপেনহেইমার, এক নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পারমাণবিক বোমার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।এই সিনেমায় ওপেনহাইমার এর জটিল জীবনকে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই হিসেবে 'ওপেনহাইমার'কে বায়োপিক বলা যেতে পারে।  কারণ এটি একজন মানুষের গল্প। এই ছবির গল্প তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত।ছবির শুরুতে পারমাণবিক বোমা তৈরির আবেগের কথা বলা হয়েছে।  যেখানে নায়ক কিছু না ভেবে নিবেদিতপ্রাণভাবে এমন একটি অস্ত্র তৈরিতে নিয়োজিত থাকে যা বিশ্বকে ধ্বংস করতে পারে।  অস্ত্র তৈরি হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে নায়ক তার কাজের ফলাফল দেখে অপরাধবোধে পূর্ণ হয়।  এবং তৃতীয় পর্যায়টি হল রাজনীতি  যা ওপেনহাইমারকে মোকাবেলা করতে হয়েছে।  পুরো সিনেমাটি রঙিন হলেও রাজনৈতিক অংশ সাদা-কালো রাখা হয়েছে।  এই তিনটি সময়কালে যা কিছু ঘটছে, তা সবই একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। .....বিস্তারিত পড়ুন

PAN-Aadhar link: কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে নিষ্ক্রিয় করেছে

উত্তরাপথ : আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link)করার সময়সীমা শেষ হওয়ার পরে কেন্দ্রীয় সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ড নিষ্ক্রিয় করেছে৷ আপনি যদি এখনও প্যান কার্ডের সাথে আধার কার্ড লিঙ্ক না করে থাকেন, তাহলে আপনি সরকারের এই কঠোর পদক্ষেপের আওতায় এসেছেন। আপনি যদি আপনার আধার কার্ডকে প্যানের সাথে লিঙ্ক করতে চান তবে আপনি জরিমানা দিয়ে এটি সক্রিয় করতে পারেন। কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে আধারের সাথে লিঙ্ক না করার কারণে নিষ্ক্রিয় করেছে। একটি আরটিআই-এর জবাবে, সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস জানিয়েছে যে আধার কার্ডের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link) করার সময়সীমা ৩০ জুন শেষ হয়েছে। যারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আধার কার্ড এবং প্যান কার্ড লিঙ্ক করেননি তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দেশে ৭০ কোটি প্যান কার্ড বর্তমানে ভারতে প্যান কার্ডের সংখ্যা ৭০.২ কোটিতে পৌঁছেছে। এর মধ্যে প্রায় ৫৭.২৫ কোটি মানুষ আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক করেছেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top